Advertisement
১৯ মে ২০২৪

কাব্যিক দ্যোতনায় ভরে থেকেও কিছু অতৃপ্তি

বিশ্বখ্যাত শিশুশিল্পী নয়। আজকের কলকাতায় অপরাজিত এক জীবনকে তুলে আনল এই ছবি। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তীবিশ্বখ্যাত শিশুশিল্পী নয়। আজকের কলকাতায় অপরাজিত এক জীবনকে তুলে আনল এই ছবি। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ২২:১৭
Share: Save:

সকলেই পরিচালক নন। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ পরিচালক!

জীবনানন্দের বহু-প্রচলিত উক্তিটিকে নিয়ে একটু জাগলারি করতেই হল। কারণ, ‘অপুর পাঁচালী’ অনেকটা কবিতার মতো। অনুভূতি নিয়ে খেলা। এক শিশু-অভিনেতা, বড় হয়ে জীবনের নানা দুর্ঘটনার অভিঘাতে সে নিজেকে গুটিয়ে নিল, নিজের চাকরি এবং সমাজজীবনে তথাকথিত ‘সাফল্য’ পেল না, উল্টে স্ত্রীর মৃত্যু এবং নানা বিষয়ে কাল্পনিক চরিত্রটি তাকে সারা জীবন তাড়া করল। এই সব ক্লান্ত, খিন্ন চরিত্ররাই তো সারা জীবন কালীদহে বেনোজলে পার করে দেয়, তার পর শূন্য করে চলে যায় জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার। এরাই কখনও সুতীর্থ, কখনও মাল্যবান, কখনও বা কুঁদঘাটের সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়।

অনুভূতি নিয়ে খেলা কথাটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় এক জন দুনিয়াখ্যাত শিশুশিল্পী, ‘পথের পাঁচালী’র অপু। কৌশিকের ছবিতে একটি দৃশ্য আছে। বোড়ালের সেই বিখ্যাত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুবীর বলছেন, ‘এটা ছিল আমাদের বাড়ি। পিসিমার ঘরটা এ দিকে। দিদির মৃত্যুর পর ওই যে কুলুঙ্গিতে নারকেলের মালা, এই জানলায়।’ ভাঙাচোরা ওই বাড়িটি আদতে সুবীরবাবুদের নিজস্ব বাড়ি নয়। যাবতীয় অভিমান সত্ত্বেও, বালক অপু কি ওই সংলাপে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল প্রৌঢ় সুবীরবাবুর অন্দরে?

কিংবা তরুণ সুবীরবাবু ছাদে সিগারেট টানছেন। সামনে খবরের কাগজের হেডিং: হাসপাতালে চারু মজুমদারের মৃত্যু। তার পরই নীচে হইহই। তরুণ সুবীর ছাদের পাঁচিলে গিয়ে দাঁড়ান। নীচে তখন সাদা-কালো ‘অপরাজিত’ ছবিতে গঙ্গার ঘাট থেকে উঠতে গিয়ে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড়িয়ে পড়া। বারাণসীর গলি দিয়ে তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে লোকে। তার পরই ‘কাট’, রাস্তায় সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত সুবীরবাবুর বাবা। তিনটি মৃত্যু নিঃশব্দে দর্শকের হৃদয়ে জুড়ে যায়, তৈরি হয় কাব্যিক দ্যোতনা।

এই কবিতার উপাদান ‘অপু ট্রিলজি’র বিভিন্ন দৃশ্য, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুর এবং শীর্ষ রায়ের ক্যামেরা। ইন্দ্রদীপ যে ভাবে রবিশঙ্করের স্টক মিউজিক ছুঁয়ে বেরিয়ে এসেছেন, তৈরি হয়েছে অনন্য অভিঘাত। শীর্ষর ক্যামেরা এক জায়গায় টপ শটে ধরেছে সুবীরবাবুর সদ্যোজাত শিশুসন্তানের মৃত্যু। অভিনেতারা নেই, ওপর থেকে বৃষ্টির মতো মাটি ঝরছে। সব শিশু-অভিনেতাকেই কি জীবন এই ভাবে সমাধি দেয়? ‘বাইসাইক্ল থিফ’-এর শিশুটি যেমন আজ শিক্ষকজীবনের শেষে অবসর নিয়েছে, ‘দ্য কিড’-এর শিশুটি কোথায় কেউ জানে না। সব মুকুল বড় হয়ে কুশলসংবাদ দেয় না, সব বিট্টুরা বড় হয়ে সোহম বনে যেতে পারে না, কিংবা সব ‘মাসুমকন্যা’ বড় হয়ে উর্মিলা-হিল্লোল তোলে না। পথের ধারে ঝরে-যাওয়া, ভুলে-যাওয়া, ক্ষয়ে-যাওয়া, হারিয়ে-যাওয়া জীবনের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন কৌশিক। সেটিই কবিতা।

এই কবিতার অন্যতম নির্যাস বয়স্ক সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়। ছবিতে ঋ

ত্বিক স্বল্প পরিসরেও নজর কাড়েন, পার্নো দক্ষতার সঙ্গে নিজের অভিনয়ক্ষমতা তুলে ধরেছেন, গৌরব প্রতিটি ছবিতে হতবাক করে দিচ্ছেন, তরুণ সুবীর হিসেবে পরমব্রত যথাযথ, সবই ঠিক। কিন্তু অর্ধেন্দুবাবু না থাকলে ছবিটা দাঁড়াত কি না সন্দেহ! তিনি যে ভাবে চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন, তা বোঝানোর জন্য কোনও প্রশংসাবাক্যই যথেষ্ট নয়।

দিনের শেষে এটি পরিচালকের ছবি, আর সেখানেই কিছু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। অনুভবের কবিতার চিত্রায়ণ এ ছবির সামর্থ্য, এবং সেখানেই তার দুর্বলতা। এ ছবিতে প্রথম ট্রেন দেখা গেল পরমব্রতর শ্বশুরবাড়ি যাত্রায়। আদিগন্ত ধানখেত, পরম সেখানে পার্নোকে নিয়ে রেলের খাম্বায় কান পেতে ট্রেন আসার আওয়াজ শুনছেন। অপু-দুর্গারা যে ভাবে শুনত। অভিঘাতটাই তৈরি হল না। অপু ট্রিলজির অন্যতম চরিত্র ছিল রেলগাড়ি। ‘পথের পাঁচালী’তে ভাইবোন কাশবনের মধ্য দিয়ে ছুটে রেলের রাস্তা দেখতে যায়। সেখানে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য বিভূতিভূষণের গল্পের সময়ক্রম বদলে তৈরি করে দেয় সিনেমাটিক মাস্টারপিস। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে ইন্দির ঠাকরুন অনেক আগে মারা যায়। সত্যজিতের ছবিতে অপুরা যে দিন রেলের রাস্তা দেখে, সে দিনই যেন পুরনো যুগ শেষ হয়, ইন্দির ঠাকরুন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে।

‘অপরাজিত’ শুরুই হয় বারণসীর রেলব্রিজে। তার পর বহু বার রেলগাড়ি বেরিয়ে গিয়েছে, একাকী অসুস্থ সর্বজয়া ছেলের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। ‘অপুর সংসার’-এর রেললাইন এই ছবিতে আছে ঠিকই, কিন্তু তা পুরনো ছবির ক্লিপিংস হয়েই থেকে গেল। জীবনের চলমান প্রতীক হয়ে উঠল না!

এমন নয় যে, সত্যজিৎ রেলগাড়ি দেখিয়েছেন বলে কৌশিককেও তাই দেখাতে হবে। একটি দৃশ্যে আধুনিক জীবন এসেছিল। বোড়ালের ভাঙা ইটের বাড়ি, সত্যজিৎ রায়ের হাতে পোঁতা জবাগাছ। আর তার সামনে সাদা স্যান্ট্রো। ওইটুকুই! কিন্তু ক্যামেরা এক বারও আজকের বোড়াল, অটো রিকশার ভিড়, একের পর এক ঘুপচি ফ্ল্যাটবাড়ির জঙ্গল ধরল না? তা হলেই ছবিটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে যেত। একদা গ্রাম, যেখানে কাশফুল ফুটত, পদ্মপাতায় বৃষ্টি নামত, মেঠো পথ ধরে মিঠাইওয়ালা ছুটে যেত, সেখানেও কংক্রিটের জঙ্গল। অপুর পৃথিবী বদলে গিয়েছে, সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বদলের নিঃসঙ্গ দর্শক।

মোদ্দা কথা একটাই। কৌশিক অপুর সঙ্গে সুবীরের জীবনের সমান্তরাল রেখা টানার চেষ্টা করেছেন। হরিহরের মতোই সুবীরবাবুর বাবার মৃত্যু, অপর্ণার মতোই পার্নোর মৃত্যু। পুলুর মতোই অভিন্নহৃদয় বন্ধু ঋ

ত্বিক। এই ভাবে আদৌ হয়? অপর্ণার মৃত্যুর পর অপু নিজেকে গুটিয়ে নেয়, চিরিমিরির জঙ্গলে চলে যায়। অপুর সময় ওটি মানা যেত। কিন্তু সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমশ একাকীত্বের সুড়ঙ্গে ঢুকে গেলেন কেন? বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক দায়? মৃত্যুশোক? ব্যর্থতাবোধ? পরিবার-পরিজন-বন্ধু পরিবৃত হয়েও তো লোকে অনেক সময় ভিতরে ভিতরে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। ছবিটি সুবীরবাবুর একাকীত্ব নিয়ে, অথচ একটি ফ্রেমেও তাঁকে একা দেখা গেল না!

এই তিনটি কথা মনে এল একটি কারণেই। ‘অপুর পাঁচালী’ নামটি এক ভদ্রলোকের অবদান। তিনি বিভূতিভূষণের বন্ধু। লেখক উপন্যাসটি পড়ে শোনানোর পর পরামর্শ দিয়েছিলেন, লেখাটার নাম রাখুন অপুর পাঁচালী। বিভূতিবাবুর সেই বন্ধুও বিশ্বখ্যাত, বাঙালি তার ক্ষুদ্র গণ্ডির ছকবাঁধা মানসিকতায় কী বলছে, না-বলছে থোড়াই কেয়ার করতেন। তাঁর নাম নীরদচন্দ্র চৌধুরী!

এই ছকবাঁধা মানসিকতা ভেঙে বেরোনোর ক্ষমতা কৌশিকেরও বাংলা বাজারে এই খোলামুখ বয়ান তৈরি হয় না বলেই অপুর পাঁচালী একটি ব্যতিক্রমী, ভরসা-জাগানো ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gautam chakraborty apur panchali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE