মহিষাদল রাজবাড়ির সামনে পদাতিক নাট্যগোষ্ঠীর নাটকের মহড়া। ছবি:আরিফ ইকবাল খান।
এক সময় দুর্গাপুজোয় কলকাতার নাট্যদলের নাটক দেখতে ভিড় জমত মহিষাদল রাজবাড়ির অন্দরে। সেই সময় রাজবাড়িতে ঢুকে নাটক দেখার সুযোগ ছিল না সাধারণ মানুষের। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে রাজবাড়ি থেকেই মহিষাদলে নাট্যচর্চার সূত্রপাত। রাজপরিবারের শুভানুধ্যায়ীরাও সেই সময় বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করতেন। ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে রাজবাড়ির নাট্যচর্চার ঐতিহ্য। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন ফের নাট্যমোদী মানুষেরা ভিড় জমিয়েছিলেন রাজ দালানে। ‘মহিষাদল রাজ কালচারাল ক্লাব’-এর ব্যানারে ওইদিন নাটক মঞ্চস্থ হয় রাজবাড়িতে। বর্তমানে মহিষাদলের বিভিন্ন নাটকের দল রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ঘরানার নাটক মঞ্চস্থ করে। তবে মহিষাদলে ভাল হল না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে নাট্যচর্চা।
মহিষাদলে সাকুল্যে রবীন্দ্র পাঠাগার ও প্রজ্ঞানানন্দ ভবন নামে দু’টি হল থাকলেও সেগুলি নাটকের অনুপযোগী। উপায় না থাকায় বিভিন্ন সময় সেখানেই নাটকের আসর বসে। অনেকক্ষেত্রে প্যান্ডেল করেও হয় নাটক। তমলুকের সাংসদ তথা হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ (এইচডিএ)-এর চেয়ারম্যান শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “এইচডিএ-র পক্ষ থেকে মহিষাদলের রবীন্দ্র পাঠাগারের সংস্কার করা হয়েছে। মহিষাদলে একটি মুক্ত মঞ্চ তৈরির কাজও চলছে। তাছাড়াও মহিষাদল রাজবাড়ি চত্বরে সরকারি যে খাস জমি রয়েছে, তা এইচডিএকে হস্তান্তরের জন্য ভূমি দফতরে আবেদন জানানো হয়েছে। সেই জমি হাতে পেলে সেখানে কমিউনিটি হল তৈরি করা হবে।”
মহিষাদল রাজপরিবারের সদস্য শঙ্করপ্রসাদ গর্গ জানান, উনবিংশ শতকের শেষের দিকে রাজবাড়িতে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল। কুমার গোপালপ্রসাদ গর্গের আমলে নাট্য চর্চার প্রসার ঘটে। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে রাজবাড়িতে নাট্যচর্চা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। আনুমানিক ১৯৫০ সাল নাগাদ তা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর কথায়, “গত বছর থেকে ফের রাজ কর্মচারী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছে। গতবার পুজোর সময় তাঁরাই নাটকে অভিনয় করেছেন। অন্ততপক্ষে প্রতি বছর পুজোর সময় নাটক মঞ্চস্থ করার লক্ষ্য রয়েছে।”
স্থানীয় ও রাজ পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, মহিষাদলের রাজা লছমনপ্রসাদ গর্গ থেকে শুরু করে রাজা সতীপ্রসাদের ভাই নাট্যমোদি ছিলেন। ১৮৯০ সাল থেকে দুর্গাপুজো ও রথের সময় কলকাতার জনপ্রিয় নাট্যদলগুলি রাজবাড়িতে আসত। ১৯১০ সাল নাগাদ রাজা সতীপ্রসাদ গর্গের ভাই গোপালপ্রসাদ গর্গ ‘মহিষাদল রাজ ড্রামাটিক ক্লাব’ গড়ে তোলেন। রাজবাড়িতে দুর্গা মন্দিরের পাশে রাজ কর্মচারীদের অভিনয়ের জন্য রঙ্গমঞ্চও তৈরি করেছিলেন তিনি। অভিনয়ের জন্য ব্যবস্থা ছিল বার্ষিক অনুদানেরও। রাজপরিবারের শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে নাট্যচর্চার পুরোধা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
আনুমানিক ১৯২৪ সাল নাগাদ সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় রাজবাড়িতে নাট্যচর্চা শুরু হয়। রাজবাড়ির পাশাপাশি নিজের গ্রাম মহিষাদলের সুন্দরাতেও তিনি নাট্যমঞ্চ তৈরি করেন। এ ছাড়াও নাট্যমঞ্চের উপকরণ তৈরি করে সেগুলি অন্য গ্রামের নাট্যমোদিদের অল্প টাকায় ভাড়া দিয়ে নাট্যচর্চায় উত্সাহ দিতেন সুরেন্দ্রনাথবাবু। এ ভাবেই ক্রমে রাজপরিবারের বাইরে নাট্যচর্চার প্রসার ঘটে। ১৯৪৫ সাল নাগাদ গোপাল মণ্ডল ‘মহিষাদল যুব সম্মিলনী’ নামে একটি সংস্থা গড়ে নাট্যচর্চা শুরু করেন। সরকারি আধিকারিকরাও ১৯৫০ সালে ‘মহিষাদল পাবলিক ক্লাব’ গঠন করে মন দেন নাট্যচর্চায়। ১৯৭১ সালে সুরেন্দ্রনাথবাবুর ছেলে সতুগোপাল ভট্টাচার্যের উদ্যোগে ‘মল্লার’ নামে নাটক দল তৈরি হয়। এখনও মল্লার গোষ্ঠী নাটকের জগতে স্বমহিমায় বিরাজমান। সতুগোপালবাবু বলেন, “রাজবাড়ির উত্সাহেই মহিষাদলের সাধারণ মানুষ নাট্যচর্চা শুরু করেন। এখনও মহিষাদলে অনেক নাট্যসংস্থা নাট্যচর্চা করে। তবে নাট্যচর্চার জন্য মহিষাদলে একটি আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ গড়ে উঠলে ভালো হয়।” ১৯৭৭ সালের শেষের দিকে তপন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তৈরি হয় সোপান নাট্য গোষ্ঠী।
মহিষাদলের ‘সমকাল’ নামে নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সুখেন্দু বেরা বলেন, “মহিষাদলে নাট্যচর্চার আঁতুড়ঘর রাজবাড়ি। প্রথমে রাজবাড়িতে নাটক দেখতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার না থাকলেও পরবর্তীকালে সেই নিষেধাজ্ঞা আর ছিল না। মহিষাদলের মতো ব্লক সদরে এখনও অনেকগুলি নাটকের দল নিয়মিত নাট্যচর্চা করে। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় নাটক করতেও যায়।” তাঁর আক্ষেপ, “মহিষাদলে অনেকগুলি নাচ, গান ও নাটকের দল রয়েছে। তবে এখানে নাটক বা সংস্কৃতি চর্চার মতো আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ নেই। ফলে খুব সমস্যা হয়।” “সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর উদ্যোগে রবীন্দ্র পাঠাগারের সংস্কার হয়েছে। তবে ওই হলটি ছোট হওয়ার কারণে দর্শকাসন কম। তাই বাইরে প্যান্ডেল করে নাটক মঞ্চস্থ করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা ভাল প্রেক্ষাগৃহ তৈরির দাবি জানিয়ে আসছি।” বলেন সুখেন্দুবাবু। রবীন্দ্র পাঠাগার পরিচালন সমিতির সভাপতি প্রাক্তন অধ্যাপক হরিপদ মাইতি বলেন, “আমাদের এই হলে ২৫০-৩০০ জন দর্শক বসার জায়গা রয়েছে। ছোট আলোচনাসভা, সেমিনার এই হলে ভালভাবে হয়। তবে এই হল নাটকের উপযুক্ত নয়।” বুধবার থেকে রাজবাড়ি চত্বরে ‘মহিষাদল নাট্য উত্সব ওয়েলফেয়ার কমিটি’-এর উদ্যোগে শুরু হল পাঁচ দিন ব্যাপী নাট্য উত্সব।
‘শিল্পকৃতি’ নাট্যসংস্থার সঙ্গে যুক্ত সুরজিত্ সিংহ, ‘মল্লার’ নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত শশাঙ্ক মাইতি বলেন, “মহিষাদলে নাটকের ঐতিহ্য আমরা বজায় রেখেছি। কিন্তু নাট্যচর্চার উপযোগী পরিকাঠামো এখানে গড়ে ওঠেনি। মহিষাদলে উন্নতমানের প্রেক্ষাগৃহ তৈরি হলে শুধু নাটক নয়, অন্যান্য সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করারও সুযোগ মিলবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy