Advertisement
০৬ মে ২০২৪

রবীন্দ্রনাথ... ফার্স্ট লেডি... এক সন্ধ্যা

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় মঞ্চে না-থেকেও বাঙালির প্রাণের ঠাকুরকে জানিয়ে গেলেন প্রণাম। সাক্ষী রইলেন সঙ্গীতা ঘোষ।রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় মঞ্চে না-থেকেও বাঙালির প্রাণের ঠাকুরকে জানিয়ে গেলেন প্রণাম। সাক্ষী রইলেন সঙ্গীতা ঘোষ।

বাড়িতে গানের মহড়ার ফাঁকে শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। ছবি: সঙ্গীতা ঘোষ।

বাড়িতে গানের মহড়ার ফাঁকে শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। ছবি: সঙ্গীতা ঘোষ।

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৪ ১৬:০১
Share: Save:

নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপ।

সেই বেষ্টনী ভেদ করে ভারতের ফার্স্ট লেডি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের মোটরকেড পৌঁছল রবীন্দ্রসদন চত্বরে।

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শুভ্রা প্রণাম করলেন রবীন্দ্রনাথের মূর্তিকে। তারপর পুলিশ-কমান্ডো-সামরিক অফিসারের বৃত্তের মধ্যে দিয়ে সটান ঢুকে পড়লেন প্রেক্ষাগৃহে। সিটে বসা মাত্র সব কিছু উপেক্ষা করে তাঁর আশপাশে ছোটখাটো ভিড় জমে গেল।

‘‘ও মাসি কেমন আছ?” “দিদি ক’দিন আছেন কলকাতায়?” “ও বৌদি, আপনি গাইবেন না? কেন?..”

প্রশ্নের বান ডেকে গেল যেন। তারই মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম। হাতে হাত রাখা। কোনও কোনও বর্ষীয়ান মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদও করে গেলেন ফার্স্ট লেডিকে। ‘ভিভিআইপি’-র আবরণ গেল মুহূর্তের মধ্যে খসে।

“আমার গ্রুপ ‘গীতাঞ্জলি’-র শিল্পীরা অনুষ্ঠান করলেও আমি নিজে অংশ নিচ্ছি না। আমি অনুষ্ঠানের ‘স্পেশ্যাল গেস্ট অব অনার’। গাইতে আসিনি, তোমাদের মতোই গান শুনব, নাচ দেখব।” হাসতে হাসতে জানিয়ে দিলেন নক্শা করা লালপেড়ে সাদা ঢাকাই শাড়ি পরা শুভ্রা। কপালে সিঁদুর। নিতান্তই আটপৌরে ঘরোয়া সাজ। তাঁর সাজ, ব্যবহারের আম্তরিকতায় আদব-কায়দা-নিয়ম-কানুন তুচ্ছ হয়ে গেল মুহূর্তে। কবিপক্ষের আগেই কবিকে প্রণাম জানাতে এসে ফার্স্ট লেডি মুছে দিলেন সব ব্যবধান।

পৌনে দু’বছর ধরে রাষ্ট্রপতি ভবনের নতুন ঠিকানায় প্রোটোকল যত আঁকড়ে ধরছে, ততই যেন তিনি আঁকড়ে ধরছেন রবীন্দ্রনাথকে। কর্তা প্রণব রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর প্রোটোকলে বাঁধা না-থেকে কবিপক্ষে মঞ্চে উঠে রবীন্দ্রগান গেয়েছেন গিন্নি শুভ্রা। যে গান তাঁর কথায় “নিছক গান নয়, ঈশ্বরেরই সাধনা।” প্রোটোকল মাফিক ফার্স্ট লেডি ‘এন্টারটেইন’ করতে পারেন না, তিনি ‘এন্টারটেইন্ড’ হতে পারেন। অর্থাৎ যা কিছু বিনোদনমূলক নাচগান, আবৃত্তি, নাটক তাতে অংশ নিতে পারেন না ফার্স্ট লেডি। এমনটাই নিয়ম। কিন্তু শুভ্রার বক্তব্য, “রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আমি ঈশ্বরকেই তো খুঁজি। এটা ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ বা বিনোদন নয়। আমার কাছে পূজা, নিভৃত প্রাণের দেবতার কাছে প্রার্থনা, আত্মসমর্পণ।” শুভ্রা গেয়ে উঠলেন এক কলি, “তোমার নয়ন আমায় বারে বারে বলেছে গান গাহিবারে... ব্যথার মাঝে লুকায় কথা, সুর যে হারাই অকূল পারে...”।

চলুন ফিরে যাই রবীন্দ্রসদনে, যেখানে ভারতের ফার্স্ট লেডি কুশল বিনিময় করছেন সকলের সঙ্গে। বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ‘আরে বাবা, আমি কিছুই না। এই ছেলেমেয়েরাই রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের সব আয়োজন করে আমাকে নেমন্তন্ন করেছে।” তারই মধ্যে এসে পৌঁছলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। এসে পৌঁছলেন রাষ্ট্রপতি-ফার্স্ট লেডির পারিবারিক বন্ধু স্বপ্না দেব, ভ্রাতৃবধূ শুভ্রা ঘোষ, সস্ত্রীক ও সকন্যা হাওড়ার মেয়র ডা. রথীন চক্রবর্তী, ওড়িশি নৃত্যশিল্পী সুতপা তালুকদার, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শৈলেন্দ্রপ্রসাদ তালুকদার, সত্যম রায়চৌধুরী, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, গায়ক অভিজিৎ। পাশাপাশি সাধারণ মানুষও। ছিলেন রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে অনেকেই। ভরা প্রেক্ষাগৃহ সাক্ষী রেখে শুভ্রা আর রাজ্যপাল নারায়ণন প্রদীপ জ্বালালেন শুভ্রারই আঁকা রবীন্দ্র প্রতিকৃতির সামনে।

কিন্তু হঠাৎ কলকাতাতেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন কেন? “কলকাতা আমার পুরনো জায়গা। কত বন্ধুবান্ধব এখানে। দিল্লিতে তো অনুষ্ঠান করিই মাঝেমধ্যে। সামনেই কবিপক্ষ। তার উপর বসন্ত বিদায় নিতে চলেছে। সব মিলিয়ে সময়টাই যে বড় রাবীন্দ্রিক। আর কবির কথা ভাবলেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির শহর আমাকে বড়ই টানতে থাকে। শরীরটা আমার বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। তাই কবিপক্ষ আসার আগেই ওঁকে প্রণাম জানিয়ে গেলাম,” স্মিত হেসে বললেন ফার্স্ট লেডি।

‘স্পর্শ নাট্য রং’-এর উপস্থাপনায় ‘গীতাঞ্জলি’ পরিবেশন করল ‘দখিন হাওয়ায় পথ ও পথিক’। কবির বসন্তের গানের সংকলন থেকে কয়েক’টি বাছাই করা গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করলেন ‘গীতাঞ্জলি’-র শিল্পীরা। “বসন্ত ঋতু যেন এক পথিক। চলার পথে সে ছড়িয়ে দিয়ে যায় তার রং-রূপ-স্পর্শ-গন্ধ। সেই রং-রূপ নিয়েই থাকে পরের বসন্তের প্রতীক্ষা। এই ভাবনা মাথায় রেখেই কয়েক’টি গান বেছে নেওয়া হয়েছে। আর বৌদিই (শুভ্রা) মূলত বেছেছেন,” জানালেন ‘গীতাঞ্জলি’-র সঙ্গীত আয়োজক দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নাচের ক্ষেত্রেও পারদর্শী শুভ্রা। কোরিওগ্রাফার ও ড্রেস ডিজাইনার অনুরাধা কৃষ্ণন জানালেন, “নাচের মুদ্রা, শাড়ির রং বাছা যেমন গেরুয়া, লালচে, ঘিয়ে রঙের বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, এ সবই শুভ্রাদির ভাবনা থেকে এসেছে।”

কেমন লাগল এই অনুষ্ঠান? সুতপা তালুকদারের ছাত্রী অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত জানালেন, “রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আর সৌন্দর্য মিশেছে একটা অন্য দিগন্তে। সঞ্চালনা আর সঙ্গীতের অনবদ্য সংমিশ্রণ...। ভাল লাগল সন্ধ্যার আবেশটা। শুভ্রাদেবীকে ধন্যবাদ।” নাচ কতটা মনোগ্রাহী লাগল সুতপা তালুকদারের? “পরিচ্ছন্ন অনুষ্ঠান। বাঙালিয়ানা অটুট। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির উপস্থাপনা যে ভাবে আমরা আশা করি, শাড়ি পা পর্যন্ত, গলায় ফুলের মালা, ছিমছাম সুন্দর পোশাক। নাচে যে দারুণ ফুটওয়ার্ক তা নয়, কিন্তু সব মিলিয়ে ছন্দোময়। রাবীন্দ্রিক মাধুর্য বলতে যা বোঝায় তা সবটাই ছিল।”

অনুষ্ঠানের পর দিন বিকেলের উড়ানেই দিল্লি যাওয়ার কথা। দুপুরে ঢাকুরিয়ার বাড়িতে নিজের ঘরে সাবেকি খাটে বসেই সমস্ত অতিথিকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করছিলেন শুভ্রা। “কালকের অনুষ্ঠানের পর আবারও অনুষ্ঠানের ডাক পেয়েছি। এ বার ‘ভানুসিংহের পদাবলী’।” ফার্স্ট লেডির গলায় যেন কিশোরীর উচ্ছ্বাস, “আবার আসব কবি রবির গান শোনাতে, গান শুনতে।”

বসন্তের মধুমাসে তাঁর কবিকেই ডাক দিয়ে গেলেন রবি অনুরাগিণী শুভ্রা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sangita gosh subhra mokhopadhya first lady
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE