Advertisement
০২ জুন ২০২৪

স্বাধীনতা দলিত দরিদ্র মানুষের কাছে মহান কিছু নয়

মুষ্টিমেয় মানুষের আহ্লাদী স্বাধীনতা আমার জীবন থেকে দেশভাগের খড়্গ চালিয়ে কেড়ে নিয়েছে অহঙ্কার। লিখছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারীমুষ্টিমেয় মানুষের আহ্লাদী স্বাধীনতা আমার জীবন থেকে দেশভাগের খড়্গ চালিয়ে কেড়ে নিয়েছে অহঙ্কার। লিখছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

স্বাধীনতা দিবস! শতাংশের হিসাবে হয়তো পাঁচ-দশ, তত সংখ্যক মানুষ আজ মাতবে হুল্লোড়ে। অঢেল অপচয়ের আয়োজন হবে আজ। রাত যত বাড়বে উপচে পড়বে মদিরালয়ের ভিড়। স্বল্পবসনা সুন্দরী নর্তকীর শরীরী বিভঙ্গে রঙিন হবে রাত। আজ গেলাসের সঙ্গে গেলাস ঠুকে চিয়ার্সের বদলে— দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনেতা, ঘুষখোর অফিসার, ওষুধে-খাবারে ভেজাল মেশানো ব্যবসাদার আহ্লাদী গলায় বলবে, ‘বন্দেমাতরম-জয় হিন্দ’। আজ তারা স্বাধীন। যার যা ইচ্ছা করতে পারে। তাদের বলার মতো কেউ নেই। এই স্বাধীনতা তাদের প্রাপ্ত হয়েছে ঊনসত্তর বছর আগে। প্রাপ্তির ভাঁড়ার এমন টইটম্বুর যে ভার বহন করতে সানন্দে সম্মত হয়েছে বিদেশের ব্যাঙ্ক। এরা আজ উৎসবে মাতোয়ারা হবে না তো কে হবে?

উল্টোদিকে দেশের যে লক্ষকোটি নিরন্ন বুভুক্ষ মানুষ খালি পেট-খালি পা-খালি গা-রুক্ষ চুল-কোটরে বসা চোখ-মাথায় দুনিয়ার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে যাবে। গত কাল, গত পরশু— দিনের পর দিন যেমন ঘুমোতে যায়। আজ সকালে যেমন সূর্য উঠেছিল, কালও তেমন উঠবে। তবু এককণা আলো প্রবেশ করবে না তার জীবনে। প্রতিদিন গাঢ় থেকে গাঢ় হবে অকুল অন্ধকার।

আমি এই মানুষদের প্রতিনিধি। এদের কথা বলার জন্য এগিয়ে আসা। আর কলমকে ধারালো চাকুর মতো বাগিয়ে ধরা। কারণ আমিও যে না-খাওয়া, না-পাওয়া সব-হারানো মানুষেরই একজন। এই স্বাধীনতা যাদের জীবনে বয়ে নিয়ে এসেছে অভিশাপ। চরম সর্বনাশ।

তাই আমি বন্দে মাতরম, জয় হিন্দ বলতে পারি না। সবার সুরে সুর মিলিয়ে সারে জাঁহাসে আচ্ছা গাইতে পারি না। এই স্বাধীনতা আমার চিত্তে দোলা দেয় না। আমি এই দেশের প্রেমে পড়তে পারিনি।

আমি যেমন দেশপ্রেমী নই, দেশদ্রোহীও নই। এ দুটোর কোনও একটা হতে গেলে আর কিছু না হোক তার কাছে একটা দেশ থাকতে হবে। আমি তো দেশ-ভিখারি। কোনও দেশই যে নেই আমার। মুষ্টিমেয় মানুষের আহ্লাদী স্বাধীনতা আমার জীবন থেকে দেশভাগের খড়্গ চালিয়ে কেড়ে নিয়েছে সেই অহঙ্কার। এখন ও পারে আমার পরিচয়— কাফের-বধযোগ্য প্রাণী। এ পারে আমার পরিচয় রিফিউজি-উদ্বাস্তু-শরণার্থী-অনুপ্রবেশকারী-বহিরাগত বাঙাল। যাকে যে কোনও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করায় কোনও বাধা নেই। জেলেও ঠুসে দেওয়া চলে। তাই আমি কোনও দেশের নই। কোনও দেশও আমার নয়।

আমার বাবা সেই উনিশশো তিপ্পান্ন সালে এসেছিলেন এ পার বাংলায়। তাঁকে রাখা হয়েছিল বাঁকুড়া জেলার শিরোমণিপুর রিফিউজি ক্যাম্পে। লেখাপড়া জানতেন না তিনি। তাই কোন কাগজ বানিয়ে রাখা দরকার, কোন কাগজ যত্ন সহকারে গুছিয়ে রাখা দরকার, তা উনি জানতেন না। তাই আমার কাছে তেমন কোনও পোক্ত প্রমাণপত্র নেই যাতে বলা চলে আমি এই দেশের নাগরিক। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড নাকি নাগরিকদের যথেষ্ট প্রমাণ নয়।

প্রায় সাত বছর আমরা থাকি ওই ক্যাম্পে। এর পর আমাদের নাম কাটা যায়। সরকার আমাদের কোনও সাহায্য দিতে, দায়দায়িত্ব বহন করতে অস্বীকার করে। কারণ, আমরা পাহাড় পাথর মুরোম মাটির যোগাযোগবিহীন আস্বাস্থ্যকর জলহীন জঙ্গল— দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসনের নামে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হইনি।

এর ফলে আমাদের জীবনে নেমে এল চরম দুরবস্থা, অরন্ধন, অনাহার, উপবাস। আর খাদ্যের সন্ধানে পাগলের মতো স্থান থেকে স্থানান্তরে যাযাবর যাত্রা। সেই সময়ে যখন কোনও বাচ্চা বই বগলে স্কুলে গিয়ে অআকখ শ্লেটে শেখার কথা, আমার ভাগ্য আমাকে পাঠাল ছাগল থেকে গরু চড়াতে। একটু বড় হয়ে চায়ের দোকানে গেলাস ধোয়া, আর একটু বড় হয়ে মুটে-মজুর, রিকশা চালানো। এই যে জীবন— মহান স্বাধীনতা আমাকে যে জীবনযাপনে বাধ্য করেছে, তার শেষ পরিণতি কী হতে পারে?

পাহাড় শীর্ষ থেকে যে জল গড়িয়ে আসে, কোনও বাধা না পেলে স্বাভাবিক ছন্দে সে চলে যাবে সাগরে। কিন্তু মাঝে একটা বাঁধ দিয়ে দিলে প্লাবিত করে দেবে দু’পার। আমি সাবলীল স্বাভাবিক গতিতে বইতে পারিনি। তাই একদিন নিজেকে আবিষ্কার করলাম অনেক অভিশাপের কেন্দ্রে। অনেকের অনেক আর্তনাদ, ক্ষয়ক্ষতির কারণ হিসেবে।

এই জীবন যে ভাবে আর যেখান থেকে শুরু হোক, শেষ হবে হয় লাশ-কাটা ঘরের লাশ-গাদায়, নয় জেলখানার কোনও কাল কুঠুরিতে। একদিন দেখলাম, আমি সেই কুঠুরিতে পৌঁছে গেছি। শুনেছি ঋষি অরবিন্দ নাকি জেলের সেলে বসে ভগবত দর্শন পেয়েছিলেন। আমি সেখানে পেলাম একজন মানুষকে, যিনি ঘোর নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন আলোকময় অক্ষরধামের দিকে। পরম মমতায় জেলখানার মাটিতে একটা কাঠির আঁচড় দিয়ে শেখালেন বর্ণমালার সব ক’টা অক্ষর। আ-কার, ই-কার।

অনেক দিন পর যখন আমি জেল থেকে বের হলাম, শেখার যে আগ্রহ তা সেখানে ফেলে আসতে পারিনি। মারাত্মক নেশার মতো আঁকড়ে ধরেছিল আমাকে। তাই বাইরে এসে খুব বই পড়তাম। শত শত বার বলেছি, লিখেছি, ভারতবর্ষের প্রথম শ্রেণির প্রায় সব সংবাদপত্রে তা বের হয়েছে। ফলে আর কারও অজানা নেই যে সেই সব দিনে আমি রিকশা চালাতাম। আর আমি একদিন সওয়ারি পাবার আশায় রিকশা নিয়ে বসেছিলাম বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজের সামনে। এই কলেজে অধ্যাপনা করতেন মহাশ্বেতা দেবী। উনি আমার রিকশায় উঠেছিলেন। আমি তখন ওনাকে চিনতাম না। তাই একজন অধ্যাপিকা ভেবেই প্রশ্ন করেছিলাম, জিজীবিষা শব্দের মানে। সেই প্রথম পরিচয়, সে দিন উনি সেই অর্থ বলেছিলেন আর দিয়েছিলেন জীবনের বেঁচে থাকার এক নতুন অর্থ। প্রস্তাব রেখেছিলেন তাঁর পত্রিকা ‘বর্তিকা’য় লেখার জন্য।

সেই একটা লেখা— হাজার-বারোশো শব্দের ছোট্ট একটা লেখা ঘুরিয়ে দিয়েছিল জীবনের মোড়। রত্নাকর রূপান্তরিত হয়েছিল লেখকে। সেই ১৯৮১ থেকে ২০১৬ দীর্ঘ লড়াইয়ের পর এখন আমার ঝুলিতে দশ খানা বই। অনেক খ্যাতি, যশ-সহ অনেক পুরস্কার। কিন্তু ৩৫ বছরের এই অসম্ভব লড়াইয়ের শেষে নিজেকে নিজে পাই সেই কঠিন প্রশ্নের সামনে— এতে কী খাড়াইলো?

জীবন শুরু করেছিলাম ছাগল চড়ানো দিয়ে, শেষ করলাম এক হস্টেলের রাঁধুনি হয়ে। আর কঠিন পরিশ্রমের কাজ পারি না। দুটো হাঁটু ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে আবার সেই অর্ধাহার, অনাহার এগিয়ে আসছে আমাকে খাবে বলে। এই দেশ সমাজ রাজনেতা কেউ এগিয়ে এসে বলছে না— তুই লেখ, লিখে যা তুই। তোর দায়িত্ব আমি নিলাম।

এই জীবন কারও কাছে প্রণত হতে পারে না। উচ্চারণ করতে পারে না ‘কৃতজ্ঞ’ শব্দটা। না খাওয়া মানুষের গলায় বাঁশির সুর বেসুরো বাজে। সে কী করে বলবে, মেরা দেশ মহান? কী করে বলবে স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়!

আমি জেলখানায় দেখেছি, কেউ না খেতে চাইলে সেপাই তাকে জোর করে নাকে নল ঢুকিয়ে খাওয়ায়। অথচ এই মুক্ত স্বাধীন দেশের রেলস্টেশনে, ফুটপাথে আমার মতো কত শত দলিত-দরিদ্র মানুষ খিদের জ্বালায় ককিয়ে মরে। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। স্বাধীনতার এত বছর পরও খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা তো দূরস্থান— সামান্য সম্মান, তা থেকেই বঞ্চিত হয়ে আছি আমরা— জন্মজনিত অপরাধে।

পরিসর কম, না হলে আমি শতেক যুক্তি-তথ্য দিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারি যে, আমি যদি দলিত সমাজের না হতাম, যদি আমার পদবিটা ব্যাপারী না হত, আমার সহায়তায় আমার পাশে এসে দাঁড়াবার মানুষের অভাব হত না। সরকার আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারত না।

তাই আজ এ কথা বলার কোনও অসুবিধা নেই—এই দেশ, দেশের স্বাধীনতা যার কাছেই প্রেয় এবং শ্রেয় হোক, আমার কাছে, আমার মতো অসংখ্য দলিত দরিদ্র মানুষের কাছে মহান কিছু নয়।

আমি দলিত সমাজের মানুষ। ১৯১১ সালের আগে আমাদের অচ্ছুৎ চণ্ডাল বলা হত। নাম বদলে এখন নমঃশূদ্র বলা হচ্ছে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেই বর্ণঘৃণার বিষ নির্মূল হয়নি। নির্মূলকরণের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্যরা সেটা টের পায় না। টের পাই আমরা— যারা নিয়ত ওই বিষে জর্জর হই। বুঝতে পারি তখন, যখন যোগ্যতা সত্ত্বেও বঞ্চিত করা হয় ন্যায্য প্রাপ্য থেকে।

অনেকে বলে থাকেন বাংলায় কোনও বর্ণবাদ নেই। আমরা জানি যে বিহার, ইউপি-র মতো উগ্রতায় নয়— অন্তঃশীলা ফল্গুর মতো বঙ্গ সমাজে সে বহমান। তেতো ওষুধকে যেমন ক্যাপসুলের মিষ্টি খোলায় ঢেকে দেয়, এখানে উঁচু পাত, নিচু পাত— এই বিভাজনকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ভদ্দরলোক আর ছোটলোক, এই শব্দের অবগুণ্ঠনে। ছোটলোক আর ছোট জাত— সমার্থক এখানে।

তাই সারা বাংলায়, সারা ভারতে আজ যা কিছু উৎসব আনন্দ উল্লাস— তার সবটাই উঁচুজাত, বিত্তবান, ভদ্দরলোক শ্রেণির নিজস্ব বিষয়। আজকের এই আনন্দযজ্ঞ ছোটজাত, ছোটলোক দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষের কাছে অনাবশ্যক অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়।

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Manoranjan Byapari independence day 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE