আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ওঠা-নামা আগে থেকে বলে দেওয়া মুশকিল। রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা, অর্থনীতি, এমনকী প্রকৃতির অতি জটিল মিশ্রণের মাঝে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ। নেতা-মন্ত্রী থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী থেকে শিল্পমহল, এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষ— এই ওঠাপড়ার পরতে পরতে জড়িয়ে। তাঁদের পাওয়া, না পাওয়া, দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ— ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তবে পিছনের সময়কে তো পিছে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ভবিষ্যতের নানা সম্ভাবনা, আশা, আশঙ্কার বীজ সেখানেই রয়ে গিয়েছে।
নতুন বছরের নতুন সূচনা আমেরিকায়। ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু ট্রাম্প কী করবেন? এখানে জমে রয়েছে এক রাশ আশঙ্কা আর উদ্বেগ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরের এক মাস লক্ষ করলে বোঝা যায় এই আশঙ্কা অমূলক নয়। ওবামা-র অনেক নীতি, পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হাঁটবেন ট্রাম্প। কোথাও কোথাও প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে আমেরিকা। যার প্রভাব সুদূর প্রসারী।
জলবায়ু চুক্তি: প্যারিসে জলবাযু চুক্তির অন্যতম রূপকার ছিলেন ওবামা। আমেরিকার নানা শিল্প সংস্থা থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম বড় কারণ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন ট্রাম্প। জলবায়ু চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন শিল্পের ‘গলা টিপে ধরা’র তীব্র বিরোধী ভাবী প্রেসিডেন্ট। তিনি যে বিশ্ব উষ্ণায়নকেই বানানো গপ্পো বলে মনে করেন, ট্রাম্পের ভাবী ক্যাবিনেটের দিকে তাকালেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ট্রাম্পের এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন এজেন্সির মাথায় বসছেন স্কট প্রুইট। দীর্ঘ দিন ধরে জীবাশ্ম জ্বালানির পক্ষে লড়ে গিয়েছেন প্রুইট। অন্য দিকে এনার্জি সেক্রেটারি হচ্ছেন রিক পেরি। উনিও তেল সংস্থার পক্ষে দীর্ঘ দিন প্রচার চালিয়েছেন। প্রশ্ন উঠে গেছে- এত সময়, এত আলোচনার পরে জলবায়ু চুক্তির রূপায়ণ আদৌ হবে তো? যদি না হয়, এতে যেমন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে, তেমনই আলোচনার উপরে আস্থাও উঠে যাবে।
আমেরিকা
মধ্য এশিয়ায় মার্কিন নীতি: বছর শেষে বিষিয়ে উঠেছে ইজরায়েল ও আমেরিকার সম্পর্ক। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে নেওয়া প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়নি আমেরিকা। বরং ভোট দেওয়া থেকেই বিরত থেকেছে। যার তীব্র সমালোচনা করেছে ইজরায়েল। বিরোধিতা করেছেন ট্রাম্পও। পাল্টা বলেছেন বিদায়ী বিদেশসচিব জন কেরি। তুরস্কও বেসুরে গাইতে শুরু করেছে।
ওবামা কিন্তু নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন। ইরাক, আফগানিস্তান থেকে সেনা ফিরিয়ে এনেছেন। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে মার্কিন সেনা। পরিচিত ছক ভেঙে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা ওবামার অন্যতম কূটনৈতিক সাফল্য। কিন্তু বাকি ছবিটি ব্যর্থতায় ভরা। আমেরিকার প্রকাশ্য বিরোধিতা সত্ত্বেও সিরিয়ায় বাসার আল-আসাদের আসন শক্ত হয়েছে। ঝড়ের মতো উত্থান হয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর। পরবর্তীতে শক্তিক্ষয় হলেও, নির্মূল করা যায়নি আইএস-কে। রাশিয়া মধ্য এশিয়ার অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবের মতো সুন্নি বন্ধুদেশগুলি দূরে সরে গিয়েছে।
ট্রাম্প কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য ভাবে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। ইরানের সঙ্গে সমঝোতা ট্রাম্প আদৌ মানবেন না তা তাঁর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার। ট্রাম্পের বিদেশ সচিব হচ্ছেন রেক্স টিলারসন। ‘এক্সন মোবিল’ কর্তা হিসেবে মধ্য এশিয়া চষে ফেলেছেন টিলারসন। পাশাপাশি তিনি রাশিয়ার অন্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ট্রাম্প এক দিকে যেমন পুরনো বন্ধুদের পাশে টানার চেষ্টা করবেন, তেমনই রাশিয়ার সঙ্গে মিলে মধ্য এশিয়ার ছকটি ভাঙার চেষ্টা করবেন। কিন্তু মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার বন্ধু আর আমেরিকার পুরনো বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্ক সাপে নেউলে। তাদের মধ্যে কী ভাবে পথ খুঁজবেন ট্রাম্প সে দিকে সবাই তাকিয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন, আরও স্মার্ট হবে ২০১৭, কিন্তু বাড়ছে বিপদও
রাশিয়া
২০১৬-এ পুতিনের সাফল্যের ঝুলি উপচে পড়ছে। মধ্য এশিয়ায় আমেরিকাকে কোণঠাসা করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দুর্বল হয়ে পড়ছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইউক্রেন নিয়ে এক চুল পিছনে হঠেননি পুতিন। আর বছরের শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী পছন্দের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। যে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার হ্যাকারদের ভূমিকার প্রমাণ পেয়েছে সিআইএ। যার জবাবে বছরের শেষে ৩৫ জন রুশ কূটনীতিবিদকে বহিষ্কারও করেছে আমেরিকা। সেই সঙ্গে রুশ দূতাবাসের নিউ ইয়র্ক ও মেরিল্যান্ডের কেন্দ্র দু’টিকে বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। জবাবে রাশিয়াও মস্কোয় অ্যাংলো-আমেরিকান স্কুলগলিকে বন্ধ করতে বলেছে। কিন্তু ট্রাম্প তো বলেই রেখেছেন বিদ্বেষ ভুলে এগিয়ে যেতে হবে। পুতিনও নতুন করে শুরু করতে চান। দুইয়ে মিলে ২০১৭-র বিশ্ব-রাজনীতির জন্য নতুন চমকও থাকতে পারে।
ন্যাটো
ফাঁপড়ে পড়েছে ন্যাটো। ট্রাম্প ন্যাটোয় অংশ নিতে আগ্রহী নন। আমেরিকাকে ছাড়া ন্যাটোর অস্তিত্বই সমস্যায় পড়ে যাবে। আর দুর্বল ন্যাটো পুতিনের স্বপ্ন।
সিরিয়া
বছরের শেষে সিরিয়ায় আসাদপন্থীরা ও বিরোধীরা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন। এই যুদ্ধবিরতির শর্ত মানা হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্বে তুরক্স ও ইরান। বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। কিন্তু সেই বিরোধীদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই আইএস নেই। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পাঁচ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। পাঁচ লক্ষের বেশি প্রাণহানি হয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ মধ্য এশিয়াকেই টালমাটাল করে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে অনেক সমীকরণ। সম্প্রতি আলেপ্পোর পতনের পরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের হাত শক্ত হয়েছে। অন্য দিকে, যৌথ বাহিনীর আক্রমণে কিছুটা কোণঠাসা আইএস। তার পরে এই সমঝোতার প্রস্তাব। কিন্তু এই সমঝোতা কি টিকবে? দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ এত তীব্র যে, প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।
ইউরোপ
ব্রিটেনের জনতার ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে দুর্বল করেছে। ২০১৭-তে ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ছেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটির রূপরেখা সম্পর্কে একটা আভাস পাওয়া যাবে। সামনেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। গোটা ইউরোপ জুড়েই দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান হচ্ছে। দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি কিন্তু ইইউ বিরোধী। ফলে ইইউ-কে বড় চ্যালেঞ্জের সামনের পড়তে হবে। পাশাপাশি সন্ত্রাস বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে। সিরিয়ায় আইএস যত দুর্বল হবে, ততই ইউরোপে আঘাত হানার প্রবণতা বাড়বে। ২০১৬ সালে অনেক ক্ষেত্রেই কোনও সংগঠিত উদ্যোগ ছাড়াই হামলা হয়েছে। এই ধরনের হামলার আভাস পাওয়া কার্যত অসম্ভব। শরণার্থীর যে স্রোতের সামনে ইউরোপ বেসামাল হয়ে পড়েছিল, তা খানিকটা স্তিমিত। কিন্তু মধ্য এশিয়া যে কোনও সময়ে টালমাটাল হলেই আবার শরণার্থীর ঢল নামবে। সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপটে সেই সমস্যার সঙ্গে কী ভাবে মোকাবিলা করা হবে সেটা বড় প্রশ্ন।
চিন
ট্রাম্প কিন্তু শুরুই করলেন চিনকে চটিয়ে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে বার্তালাপ করলেন। চিন তীব্র ক্ষোভ জানায়। ট্রাম্প মনে করেন, মার্কিন শ্রমিকদের চাকরি খেয়েছে চিনের সস্তার শ্রমিক। সেই চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ট্রাম্প। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্মুখ সমরের আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ চিন সাগরে অধিকার ছাড়তে নারাজ চিন। রাষ্ট্রপুঞ্জের আদালতের রায় চিনের বিরুদ্ধে যাওয়া সত্বেও পেশিশক্তির আস্ফালন চলছে। আমেরিকাও কিন্তু জমি ছাড়তে নারাজ। ট্রাম্প আরও কড়া অবস্থান নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।
উত্তর কোরিয়া
কিম জং উন কী করতে পারেন সে সম্পর্কে কারও কোনও ধারণা নেই। ক্রমাগত দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা ও পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করে চলেছেন কিম। হাজারো নিষেধাজ্ঞা, প্রায় ভেঙে পড়া অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ— এত কিছুর পরেও কিমের আস্ফালন বন্ধ হয়নি। এমনকী বিরক্ত হয়েছে চিনও। নতুন বছরে কিম কী করতে পারেন তা আন্দাজ করা কঠিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy