এক জন সরাসরি সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন। অন্য জন নাম না করে বার্তা দিয়েছেন।
এক জন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অন্য জন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর রঘুরাম রাজন।
অমর্ত্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দুষে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ থেকে নিজের নাম তুলে নিতে চেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বোর্ডের কাছে লেখা তাঁর চিঠি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে এ নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। মোদী সরকার অবশ্য বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা করতে চাইছে না। আজ বিদেশ মন্ত্রকের তরফে দাবি করা হয়েছে, অমর্ত্য সেনের মেয়াদ সম্প্রসারণ আটকানোর কোনও চেষ্টাই করেনি সরকার।
রঘুরাম নাম করে মোদী সরকারকে বেঁধেননি। কিন্তু আজ গোয়ায় গণতন্ত্র নিয়ে একটি বক্তৃতায় তিনি যা বলেছেন, তার লক্ষ্য বতর্মান কেন্দ্রীয় সরকার বলেই মনে করা হচ্ছে। রঘুরাম বলেছেন, শক্তিশালী সরকার মানেই যে ভাল সরকার তা সব সময় নয়। বরং শক্তিশালী আর পঙ্গুর মাঝামাঝি একটা অবস্থান খুঁজে নেওয়া দরকার। হিটলারি জমানা এবং জরুরি অবস্থার সময়ের কথা উল্লেখ করে রঘুরাম বলেন, “ট্রেন ঠিক সময়ে চলাটাই সব নয়। ট্রেনটা কাঙ্খিত সময়ে সঠিক দিকে যাচ্ছে কি না, সেটা দেখা সবার আগে দরকার।”
রঘুরাম এই কথাগুলো বললেন, এমন একটা সময়ে যখন শিক্ষায় সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে সরব হয়েছেন অমর্ত্য। নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে যাঁর মতান্তর কোনও নতুন ঘটনা নয়।
নালন্দার আচার্য পদে অমর্ত্যবাবুর মেয়াদ শেষ হচ্ছে জুলাই মাসে। তার আগে গত মাসের ১৩ ও ১৪ তারিখেই গভর্নিং বোর্ড ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রস্তাব নিয়েছিল, আচার্য পদে অমর্ত্যর নামই দ্বিতীয় বারের জন্য পাঠানো হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটর, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে সেই নাম পাঠানোও হয়। কিন্তু মোদী সরকার অনুমোদন দিতে গড়িমসি করেছে বলে বিষয়টি এখনও ঝুলে রয়েছে বলে অভিযোগ।
এই পরিস্থিতিতে গত কালই অমর্ত্য গভর্নিং বোর্ডের কাছে চিঠি লিখে আচার্য পদ থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সরাসরি মোদী সরকারের দিকে আঙুল তুলেই তিনি লেখেন, “আচার্য হিসেবে সরকার যে আমাকে চায় না, আমার পক্ষে তেমনটা না ভাবাই কঠিন।” সেই সঙ্গে দেশ জুড়েই শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলছে বলে খেদ জানান তিনি। নালন্দাও তার বাইরে নয় বলেই তাঁর মত। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের গভনিং বোর্ড এই ধরনের অসহযোগিতার মুখোমুখি হয়েছে বলে জানিয়ে অমর্ত্য অভিযোগ করেছেন, সরকার এর মধ্যে কাউকে কিছু না বলে গোটা বোর্ডই পুনর্গঠন করার চেষ্টা করেছিল।
এমনিতে নালন্দার আইন অনুযায়ী, গভর্নিং বোর্ড আচার্যের নাম প্রস্তাব করে সরাসরি ভিজিটর তথা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়। রাষ্ট্রপতিই নামটি অনুমোদন করবেন। এ ক্ষেত্রে জানুয়ারির মাঝামাঝি নাম পাঠানোর পরে মাসখানেক কেটে গিয়েছে। কিন্তু প্রণববাবুর কাছ থেকে এখনও অনুমোদন আসেনি। অমর্ত্য তাঁর চিঠিতে লিখেছেন, “দৃশ্যতই মনে হচ্ছে, সরকার রাজি হচ্ছে না বলেই রাষ্ট্রপতি তাঁর অনুমোদন জানাতে পারছেন না।...নালন্দার কাজকর্ম যাতে দ্রুত এগোয়, রাষ্ট্রপতি বরাবরই তার জন্য ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী হয়ে এসেছেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের ধরে নিতে হবে, এ বার কোনও নির্দিষ্ট কারণেই তাঁর পক্ষে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া শক্ত বা অসম্ভব হয়ে উঠছে।”
রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রেও এ দিন জানানো হয়েছে, সরকার অনুমোদন না করলে রাষ্ট্রপতি আচার্যের নামে সবুজ সঙ্কেত দিতে পারেন না। সরকার যা বলবে, সেই মোতাবেকই চলবেন রাষ্ট্রপতি। যদি রাষ্ট্রপতির মত ভিন্ন হয়, তা হলে সরকারের কাছে তিনি ব্যাখ্যা চাইতে পারেন।
আজ বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরুদ্দিন অবশ্য দাবি করেছেন, সরকারের তরফে আলাদা করে কোনও গড়িমসি করা হয়নি। আচার্য পদে অমর্ত্যকে রাখার ব্যাপারে সরকার কোনও আপত্তিও জানায়নি। আকবরুদ্দিনের বক্তব্য, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বোর্ডের চূড়ান্ত প্রস্তাব এখনও এসেই পৌঁছয়নি। এ মাসের ১৩ তারিখ একটি খসড়া প্রস্তাব এসেছে মাত্র। সেই প্রস্তাব অনুমোদন করার জন্য দু’সপ্তাহের সময়সীমা এখনও ফুরোয়নি।
এর উত্তরে বোর্ডের সদস্য সুগত বসু বলছেন, “বিদেশ মন্ত্রক বলছে ১৩ ফেব্রুয়ারি গভর্নিং বডির খসড়া সিদ্ধান্ত পাঠানো হয়েছে। সেটি অন্যান্য বিষয়ের খসড়া। অমর্ত্য সেনকে পুনরায় চ্যান্সেলর করার ব্যাপারে বোর্ডের সিদ্ধান্ত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়েই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এক মাস হয়ে গেলেও সরকার কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে।”
আকবরুদ্দিন এও দাবি করছেন, খসড়া প্রস্তাবে শুধু অমর্ত্যর নাম রয়েছে এমন নয়। তিনি বলেন, “খসড়ায় দুটি বিকল্পের কথা বলা হয়েছে। হয় অমর্ত্য সেনকে ফের চ্যান্সেলর করা হোক অথবা নতুন তিন জনের নাম খুঁজে কাউকে বেছে নেওয়া হোক।” কিন্তু বোর্ড সদস্যদের মতে, প্রস্তাবে আদৌ কোনও বিকল্পের কথা বলা হয়নি। যদি কোনও ভাবে অমর্ত্য রাজি না হন, সে ক্ষেত্রে কী হতে পারে, সেটাই বলা হয়েছে। তা না হলে অমর্ত্য সেনের নাম ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছে এবং কেন এই সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া জরুরি সেটিও তুলে ধরা হয়েছে। অনেকের মতে, অতীতে নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করেছেন অমর্ত্য। মোদীকে যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান না, সে কথাও প্রকাশ্যে বলেছেন। সে কারণেই হয়তো মোদী এখন অমর্ত্যকে চাইছেন না। তবে অমর্ত্য নিজে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “এমন কথা বললে আমি নিজেকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলব। সুতরাং সেটা করতে চাই না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy