Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

প্রশ্ন রেখেই বরফ-উপত্যকায় ফিরল রেলগাড়ি

অনন্তনাগ জেলা হাসপাতালের তরুণী নার্স রিফাত ট্রেনে আমার সহযাত্রিণী।

ভিড়: বানিহালগামী ট্রেন ঢুকছে শ্রীনগর স্টেশনে। রবিবার। ছবি: পিটিআই।

ভিড়: বানিহালগামী ট্রেন ঢুকছে শ্রীনগর স্টেশনে। রবিবার। ছবি: পিটিআই।

সাবির ইবন ইউসুফ
নওগাম (শ্রীনগর) শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৯ ০২:২৪
Share: Save:

জানলা দিয়ে ধু-ধু বরফের দিকে চেয়ে রিফাত আরা বললেন, ‘‘কাল থেকে আর রাতে হাসপাতালে থাকতে হবে না। সকাল সওয়া ৯টার ট্রেন ধরে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব হাসপাতালে।’’

অনন্তনাগ জেলা হাসপাতালের তরুণী নার্স রিফাত ট্রেনে আমার সহযাত্রিণী। গত ৫ অগস্ট উপত্যকায় নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া ইস্তক টানা ১০৪ দিন বন্ধ থাকার পরে আজই সেই অর্থে ‘পুরোপুরি’ চালু হল কাশ্মীরের রেল। শ্রীনগর স্টেশন থেকে ৩৫ টাকা দিয়ে বানিহালের টিকিট কেটে চড়ে পড়েছিলাম ট্রেনে। কামরায় আলাপ রিফাতের সঙ্গে। বললেন, তাঁদের হাসপাতালে কর্মীর সংখ্যা এখন হাতে-গোনা হলেও ডাক্তার-নার্সদের তো যেতে হচ্ছেই। এই বন্‌ধের মতো পরিস্থিতিতে দরকারমতো বাস বা গাড়ি পাবেন কোথায়! শ্রীনগরের রিফাত তাই গত তিন মাস ধরে প্রায়ই রাত্রিবাস করছিলেন হাসপাতালে। কিন্তু রেল চালু হওয়ায় আপাতত তিনি চিন্তামুক্ত। আগেও ট্রেনে যাতায়াত করতেন। সময় আর টাকা, দু’টোই বাঁচত।

কাজ়িগুন্দের কলেজ শিক্ষক উমের মেহরাজও ছিলেন আমাদের কামরায়। তিনিও ডেলি-প্যাসেঞ্জার, অবশ্যই যদি ট্রেন চলে। ভাবুক হয়ে গেলেন মাস্টারমশাই— ‘‘কাশ্মীর তো স্বর্গ! বাইরে তাকিয়ে দেখুন, চতুর্দিকে স্বর্গের ছোঁয়া।’’

আরও পড়ুন: রুটিরুজির সমস্যাই অস্ত্র বিরোধীদের

সত্যিই বাইরেটা ছবির মতো লাগছিল। মাটিতে পুরু বরফ, দূরে পাহাড়গুলোর মাথায় তুষারের মুকুট, গাছগুলোর মাথা দুলছে হালকা হাওয়ায়, তার মধ্যে দিয়ে ঝুকঝুক করে চলছে আমাদের ডিএমইউ। শূন্য ডিগ্রির নীচে ঠান্ডা আর কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির যৌথ প্রভাবে ট্রেনে যাত্রী তেমন বেশি নয়। কেউ কেউ জ্বলন্ত কাঠকয়লার ঝুড়ি (কাংড়ি) নিয়ে উঠেছেন। যেমন বৃদ্ধ আসাজ জ়ু। বললেন, ‘‘আমার স্মার্ট কার্ড আছে। মাটানে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে ট্রেনেই যাই। আমার মতো গরিবের এতেই সুবিধে।’’

ট্রেনে বেশি ভিড় নেই, যদিও শ্রীনগর স্টেশনে অনেক মানুষ এসেছিলেন আজ, যাকে আমরা নওগাম স্টেশনও বলি। তবে একটা কথা বলি। মুখে ‘পুরোদস্তুর’ বলা হলেও কাশ্মীরে আজ পুরো রুটে ট্রেন চলেনি। ১৩৭ কিলোমিটার লাইন পাতা আছে বারামুলা থেকে বানিহাল পর্যন্ত। কিন্তু নিরাপত্তা পরিস্থিতির যুক্তিতে ট্রেন চলেছে শ্রীনগর থেকে বানিহাল পর্যন্ত। বেলা ১২টা ৪০-এ আমাদের ট্রেন শ্রীনগর ছেড়েছে। তার পর চারটে স্টেশন— পাম্পোর, অনন্তনাগ, মাটান, কাজ়িগুন্দ পেরিয়ে বানিহাল পৌঁছেছি ২টো ৫০-এ। এই লাইন ধরে এগিয়েই এশিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম পির পাঞ্জাল রেল-সুড়ঙ্গের কাজ শেষ হলে ভারতীয় রেল মানচিত্রে জুড়ে যাবে শ্রীনগর। এখন গাড়িতে শ্রীনগর-জম্মু যাতায়াতে রোজ অন্তত ৫০০ টাকার ধাক্কা। রেল চললে কিছুটা সাশ্রয় হয়। বানিহাল পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে বাসে উধমপুর যাওয়া যায়, সেখান থেকে আবার ট্রেনে জম্মু।

মজার কথা হল, কাশ্মীরের রেলকে সামনে রেখে পর্যটক টানার কথা ভাবে প্রশাসন। আর সেই রেলই ২০১৬ থেকে আজ পর্যন্ত তিনশোরও বেশি দিন বন্ধ থেকেছে। কারণটা অধিকাংশ সময়েই আইনশৃঙ্খলার অবনতি। রেলের চিফ এরিয়া ম্যানেজার বিপিন পুরোহিত বলছিলেন, ‘‘গড়ে আমাদের দৈনিক আয় প্রায় দু’লাখ টাকা। কাজেই সাম্প্রতিক অতীতে এক কোটি টাকা ক্ষতি তো হয়েছেই। সেই সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মীদের বেতনের খরচ আছে। বোঝা তো বেড়েছেই।’’

বরফঢাকা লাইনে লাল-নীল রেলগাড়ির স্বপ্নের মতো গড়িয়ে যাওয়াটাও কিন্তু অস্বস্তিকর প্রসঙ্গগুলোকে ঢাকতে পারল না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE