তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত মেয়েটি। মূর্তিকে ঈশ্বর বলে মানতে চায়নি। পা দিয়ে ভেঙে ফেলেছিল সরস্বতীর মূর্তি। কয়েক বছর পর বঙাল খেদাও আন্দোলনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল সেই মেয়েরই নিরপেক্ষ কলম।
কর্মক্ষেত্র থেকে সংসার— বার বার রক্তাক্ত হয়েও ভেঙে পড়েননি তিনি। বরং একের পর এক গল্প-উপন্যাসে লিপিবদ্ধ করেছেন মানবজীবনের অনন্য দলিল।
সাহিত্যিক, সাংবাদিক নিরুপমা বড়গোঁহাইয়ের সেই জীবন-কাহিনিকেই ১৪৭ পাতায় বাঁধলেন সূপর্ণা লাহিড়ী বরুয়া। আগামী কাল গুয়াহাটি গ্রন্থমেলায় ‘নদীর নাম নিরুপমা’র প্রকাশ অনুষ্ঠানে। নিরুপমাদেবীর পাশে হাজির থাকার কথা সাহিত্যিক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য ও হীরেণ গোঁহাইয়ের। হীরেণবাবুকেও বঙাল খেদাও আন্দোলনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
নিছক জীবনী নয়, ‘নদীর নাম নিরুপমা’ কখনও এক নাবালিকার আত্মকথা, কখনও কলেজছাত্রীর রোম্যান্টিসিজম। কখনও তিনি বিপ্লবী, কখনও প্রেম, সংসারের সামনে নতজানু। জীবনজুড়ে নিরুপমাদেবীর সব ওঠাপড়ার সাক্ষী হয়ে থেকেছে পাগলাদিয়া, কখনও ভোগদৈ, কখনও কুলসি, ব্রহ্মপুত্র। তাঁর সব লেখায় তাই জলছবির অনিবার্য উপস্থিতি। সাক্ষাৎকার থেকে স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ থেকে স্বগতোক্তি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলতে হয় নিরুপমাদেবীর এই জীবনচরিত।
কলেজ জীবনে মাতৃভাষায় গল্প লিখে প্রথম হওয়া নিরুপমা তামুলি একই সঙ্গে বাংলাতেও গল্প লিখে দ্বিতীয় হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে বান্ধবীদের নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করেছেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে প্রথম বার গুয়াহাটি ছেড়ে আসা নিরুপমার জবানবন্দিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে পঞ্চাশ দশকের মহানগর। ছাদে বসে পড়শি সুচিত্রা সেনকে দেখা, কলেজ ম্যাগাজিনে গল্প মনোনীত না হওয়ার আক্ষেপ, বামপন্থী আন্দোলনে আকর্ষিত হওয়া আবার ধর্মতলার হলে ইংরেজি সিনেমা, বন্ধুদের সঙ্গে দূরের সফর— সব মিলিয়ে কলকাতা নিরুপমাকে জড়িয়ে ফেলেছিল সজোরে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের প্রতি প্রেম। বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যে বন্ধন এখনও অটুট। মনেপ্রাণে বামপন্থী হয়েও তার সশস্ত্র দিক কখনও মানতে পারেননি নিরুপমাদেবী, যেমন নারীবাদী হলেও মানেন না নারীবাদের নামে স্বেচ্ছাচার বা উগ্রতা।
সাহিত্যিক হোমেন বড়গোঁহাঞিয়ের সঙ্গে প্রেম ও সংসার জীবনের লম্বা পর্বটা কেটেছে বিভিন্ন জেলায় যাযাবরের মতো। নারীবাদী লেখিকা হিসেবে পরিচিত হলেও নিরুপমাদেবী কিন্তু সংসারের স্বার্থে সব সময় নিজের চাকরি ছেড়েছেন। স্বামীর মতে উৎসাহ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নতুন ‘সাপ্তাহিক নীলাচল’কে দাঁড় করানোর সাধনায়। হোমেনবাবুর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সেই নীলাচলের সামান্য বেতন তাঁর একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়ায়। দুই ছেলেকে মানুষ করার ভার তখন কাঁধে। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও কর্তৃপক্ষের মতের তোয়াক্কা না করে বঙাল খেদাও আন্দোলনের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন নিরুপমা। বিভিন্ন শিবিরে ঘুরে তুলে এনেছিলেন হিংসা-দুর্দশার ছবি। ফলে খোয়ালেন চাকরি। কিন্তু মাথা নত করেননি। দুই ছেলের কাছে এখনও মা যেমন আদর্শ, তেমনই নিরুপমার কাছেও, সাহিত্য অকাদেমি বা অন্য পুরস্কারের চেয়েও বেশি আদরের ছিল গত বছর ১৫ অগস্ট গুয়াহাটিতে পাওয়া ‘আদর্শ জননী’র পুরস্কার। প্রতিবাদে, আদরে, আদর্শে, সৃজনে বাংলার আশাপূর্ণাদেবীর সঙ্গে তাঁর মিল। আর কাকতালীয় ভাবে নিরুপমার আদরের ডাকনামও ‘বকুল’। যে উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পাওয়া সেই ‘অভিযাত্রী’ উপন্যাস অসমে নারী আন্দোলনের পুরোধা চন্দ্রপ্রভা শইকিয়াকে নিয়ে। প্রথম প্রকাশিত গল্প সংকলন ১৯৬১ সালে ‘অনেক আকাশ’। প্রথম উপন্যাস পরের বছরেই ‘এই নদী নিরবধি’। মামণি রয়সম গোস্বামীর মতে তাঁর সেরা উপন্যাস ‘এজন বুড়া মানুহ’। আর খোদ নিরুপমাদেবীর কাছে নিজের সেরা সৃষ্টি ‘ইপারর ঘর, সিপারর ঘর’।
গোটা বইকে স্বপ্ন, সংগ্রাম আর সততা— এই তিন ভাগে ভাগ করে নিরুপমাদেবীকে তুলে ধরেছেন সূপর্ণাদেবী। সঙ্গে আছে দুষ্প্রাপ্য ছবি, নিরুপমা দেবী সম্পর্কে বিভিন্ন গুণীজনের মূল্যায়ন, ডায়রির অংশ। শুধু এক লেখিকাকে জানা নয়, অসমের কয়েক দশকের সাহিত্য, সাংবাদিকতা, মনন ও সমাজবদলের ধারাও অভিনব ভাবে ধরা পড়েছে সেই বইয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy