বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী। জেঠুও লড়েছেন স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু আদালতের রায়ে হঠাৎই একদিন সেই মহিলা হলেন ‘বিদেশিনী’। যেতে হল ডিটেনশন শিবিরে। গোয়ালপাড়ার রোশেনারা বেগমের এমন পরিণতিতে ক্ষুব্ধ কংগ্রেস। গত কাল কোকরাঝাড় ডিটেনশন শিবিরে গিয়ে রোশেনারাদেবীর সঙ্গে দেখা করেন বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়া, কংগ্রেস মুখপাত্র আবদুল খালেক, বিধায়ক রূপজ্যোতি কুর্মী, এ কে রশিদ আলম, আবদুল রশিদ মণ্ডল, আবদুল হাই নাগরি ও ওয়াহব আলি চৌধুরী। পরে তাঁর বাড়িও যান কংগ্রেস বিধায়করা। আগামী কাল বিধানসভায় প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতে পারেন তাঁরা।
গোয়ালপাড়ার পাইকান দ্বিতীয় খণ্ডের বাসিন্দা মণিপুর ইসলামের স্ত্রী রোশেনারার বিরুদ্ধে গোয়ালপাড়া বর্ডার ব্রাঞ্চের পুলিশ বিদেশি সন্দেহে মামলা দায়ের করেছিল। বিদেশি শণাক্তকরণ আদালতের বিচারক নবনীতা বরুয়া তাঁকে গত বছর নভেম্বর মাসে বিদেশি বলে রায় দেন। তখন থেকেই কোকরাঝাড় কারাগারের ডিটেনশন শিবিরে বন্দি ৩২ বছরের ওই মহিলা। তিনি বর্তমানে সাত মাসের গর্ভবতীও।
রোশেনারার বাবা প্রয়াত রমজান আলি ও জেঠু রোজ মামুদ খাঁ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। জেলেও যান। ১৯১৩ সালে ইংরেজ আদালতের রায়ের কপি রয়েছে পরিবারের হাতে। তাঁর বাবার নাম ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জিতে রয়েছে। ১৯৬৬, ১৯৭০ ও ১৯৯৭ সালের ভোটার তালিকাতেও নাম ছিল বাপ-জেঠুর। রয়েছে ১৯৩০, ১৯৩৫, ১৯৪২ সালে জমি বিক্রির বিভিন্ন দলিলও। এত নথি থাকার পরও রোশেনারাদেবীকে বিদেশি চিহ্নিত করে জেলে পাঠানোয় অবাক বিভিন্ন মহল।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে এ নিয়ে আলোচনার জেরে কংগ্রেস বিধায়করা রোশেনারাদেবীকে দেখতে জেলে যান। দেবব্রতবাবু বলেন, “বিদেশি শণাক্তকরণের নামে বর্তমান সরকার ও পুলিশ কী ভাবে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের হেনস্থা করছে স্বাধীনতা সংগ্রামীর মেয়েকে জেলে পাঠানোই তার প্রমাণ।” শিবির ঘোরার সময় একাধিক শিবিরবাসী অভিযোগ জানান, পূর্বপুরুষের নাম ১৯৫১ সালের এনআরসি ও ১৯৬০ সালের ভোটার তালিকায় থাকলেও, তাঁদের বিদেশি বলে বন্দি রাখা হয়েছে। শইকিয়া জানান, সোমবার বিধানসভায় তিনি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করবেন। আবদুল খালেক জানান, কোকরাঝাড় শিবিরে হাজং, হিন্দু বাঙালি, রাজবংশী, অসমীয়া মুসলিম মিলিয়ে ১২২ জন মহিলা ও ১২টি শিশু আছে। অকারণে তাঁদের কষ্ট দেওয়া হচ্ছে। সরকার এনআরসির কাজও ইচ্ছা করে ঢিমে তালে চালাচ্ছে। গোয়ালপাড়ার খারিজা মাণিকপুরে রোশেনারা বেগমের বাবা প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী রমজান আলির বাড়িতেও যান কংগ্রেস প্রতিনিধিরা।
রাজ্যের কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের বক্তব্য, বিভিন্ন ডিটেনশন শিবিরে বন্দি, বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের স্ত্রী ও সন্তানের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ২০১১ সালে সারোয়ার খানকে বিয়ে করা রাজিয়া বেগম (বদলে দেওয়া নাম) ২০১২ সালে মা হয়েছেন। কিন্তু পরে তাঁর স্বামী গ্রেফতার হল। জানা যায়, অসমের বাসিন্দা হলেও সারোয়ার আদতে আফগান। তেমনই, বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত অনেকেই অসমে বসবাস শুরুর পরে স্থানীয় মেয়েকে বিয়ে করেছেন। এখন তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিদেশি বাবা বা মায়ের সন্তানরা ভারতের নাগরিক হতে পারবে না। আবার বাংলাদেশও তাদের দায়িত্ব নিতে চাইছে না। এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলি দাবি করেছে, বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত বা বিদেশে পাঠানো হবে এমন ব্যক্তিদের ভারতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের পুনর্বাসন প্যাকেজ দেওয়া হোক। মানবিকতার সঙ্গে বিচার করা হোক শিশুদের ভবিষ্যৎ।
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, আইন বলছে বাবা বা মা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হলে তাঁদের দেশের বাইরে বের করে দিতে হবে এবং এমন বাবা-মার সন্তানও ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে না। এ ক্ষেত্রে শিশুদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে কোনও আইনে উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই পুনর্বাসনেরও। শুধু ভারতের আইনেই কাজ হবে না। বিদেশিদের সপরিবার বাংলাদেশে (বা অন্য যে কোনও দেশে) পাঠিয়ে দিলে, সে দেশের সরকারেরও আইন থাকতে হবে, যে ভারত থেকে ‘পুশ-ব্যাক’ হওয়া পরিবারগুলির বাবা বা মায়ের আদি বাসস্থান যাচাই করে শিশুদের যেন নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
অসম পুলিশের বর্ডার ব্রাঞ্চের তরফে জানানো হয়, পুলিশের দায়িত্ব সন্দেহভাজন কাউকে পেলেই তার ব্যাপারে বিদেশি শণাক্তকরণ আদালতকে জানানো। পরে ওই পুরুষ বা মহিলাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েই পুলিশের কাজ শেষ।
রাজ্য সরকার বিভিন্ন বিদেশি শণাক্তকরণ আদালতে ‘বিদেশি নয়’ হিসেবে শণাক্ত হওয়া প্রায় ৪০ হাজার ব্যক্তির পরিচয় নতুন করে যাচাই করার কাজ হাতে নেওয়া ফের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন ওই ব্যক্তিরা। রাজ্য সরকার সম্প্রতি জেলা ও রাজ্য পর্যায়ের স্ক্রিনিং ও রিভিউ কমিটি গড়ে সন্দেহজনক মামলাগুলি ফের যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছিল। ইতিমধ্যে বিদেশি নয় বলে আদালতের রায় দেওয়া ন’জনের পরিচয় ফের খতিয়ে দেখতে হাইকোর্টে পাঠিয়েছে রিভিউ কমিটি। এদের মধ্যে পাঁচজন লখিমপুর, দু’জন করে হোজাই ও দরংয়ের বাসিন্দা।
রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি মিশনরঞ্জ দাস জানান, শরণার্থীদের ভয়ের কারণ নেই। বিজেপি ভুল বিচারের শিকার হওয়া পরিবারগুলির পাশে আছে। শরণার্থীদের নাগরিকত্ব নিয়ে আইন মেনে কাজ হবে। কোনও প্রকৃত ভারতীয় পরিবারকে হেনস্থা করা হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy