হার্দিক পটেল।—নিজস্ব চিত্র।
রামগোপাল বর্মার ‘সরকার’ ছবিটি দেখেছেন?
গোপন আস্তানায় বসে এত ক্ষণ একটি টিভি-চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। সেটা শেষ হওয়া মাত্র বেমক্কা এই প্রশ্ন শুনে কিছুটা চমকেই গেলেন! ‘‘হ্যাঁ দেখেছি।’’
ক’বার?
‘‘বার পাঁচেক হবে। বা তারও বেশি।’’
আর বালাসাহেব ঠাকরেকে?
‘‘সামনাসামনি দেখিনি, তবে উনিই আমার আইডল!’’
আসল কথাটি বুঝি বেরিয়ে এল এ বার।
জানতে চাইলাম, কেন?
বললেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী নেতা হতে পারেন, লিডার নন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে উনি কাজ করেন। কিন্তু বালাসাহেব ছিলেন মরাঠা মানুষের লিডার। মরাঠাদের অধিকার ছিনিয়ে এনেছিলেন তিনি।’’
অবশেষে ধন্যি ছেলের খোঁজ মিলল। পুলিশ এক বার গ্রেফতার করে ছেড়ে দিয়েছে। তার পরেও দু’দিন ধরে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। কখনও বন্ধুর বাড়ি, আবার কখনও চেনা-পরিচিত কারও। আমদাবাদ থেকে ১২ মাইল উজিয়ে গাঁধীনগরের সরখেজ রোডের একটি বহুতল আবাসনে দেখা মিলল হার্দিক পটেলের। সিদ্ধরাজ অ্যাপার্টমেন্ট, জি ব্লক-৪০৩ নম্বর ফ্ল্যাট। গুজরাতের পটেল-পতিদারদের সংরক্ষণের দাবিতে তামাম মোদী-রাজ্যে তুলকালাম ফেলে দিয়েছে এই দামাল ছেলে। রাজ্য ছাপিয়ে এখন জাতীয় স্তরে খবরের শিরোনামে তিনি। পরনে অফ হোয়াইট প্যান্ট, ব্লু শার্ট। ডান হাতের কব্জিতে ফ্যাশনদুরস্ত রিস্টলেট। কথা শুনলেই মনে হবে ‘সরকার’-এর সংলাপ মুখস্থ করে আওড়াচ্ছেন। ‘হাত কাট দেঙ্গে’, ‘ঠোক দেঙ্গে’, ‘বচকে যায়েগা কাঁহা’— মুখ থেকে বেরোচ্ছে হরবখত। এই গরম কতাবার্তা কেন, প্রশ্ন করলে সপাটে জবাব দেন, ‘‘মা-বোনের গায়ে কেউ হাত দিলে এমনি ছেড়ে দেব নাকি! হাত কেটে দেব না?’’
তাঁর আন্দোলনের জেরে ন-দশ জনের প্রাণহানি হওয়ায় হার্দিক যে কিছুটা চাপে রয়েছেন, দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। তবু জানালেন সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন থামবে না। শুধু গুজরাত নয়, হরিয়ানা-রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ-অন্ধ্রপ্রদেশের পটেল ও তাদের স্বজাতিদের নিয়ে এই আন্দোলন চলবে। এ জন্য দিল্লি যেতে পারেন তিনি।
প্রশ্ন হল, গুজরাতের বাইরে পটেল কোথায়? হার্দিকের দাবি— গুজরাতে যারা পটেল, হরিয়ানায় তারাই জাঠ, রাজস্থানে গুজ্জর, অন্ধ্রে রেড্ডি। এরা সকলেই জাতিতে এক। মূলত চাষাবাদই ছিল এদের পেশা। জমিও ছিল বিস্তর। পরবর্তী কালে ব্যবসা করেও এরা সফল হয়েছে। হার্দিক জানালেন, সামগ্রিক ভাবে ওবিসি-র জন্য বরাদ্দ ২৭% সংরক্ষণের আওতায় এদের আনার জন্য দিল্লির যন্তর-মন্তরে ধর্নায় বসার কথা ভাবছেন।
কিন্তু পটেলরা যদি ঐতিহাসিক ভাবে প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্তই হন, তা হলে সংরক্ষণের দাবিটা উঠছে কেন?
এ বার মুখের ভাব পাল্টে যায় হার্দিকের। কঠিন গলায় উত্তর দেন, ‘‘উঠছে, কারণ আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। পটেল ঘরের ছেলে-মেয়েরা ৯০-৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়েও সরকারি কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। কেন না সাধারণ শ্রেণিতে আসন কম। বাকি আসন সংরক্ষিত।
ফলে ১৫-২০ লক্ষ টাকা দিয়ে বেসরকারি কলেজে মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হচ্ছে। এমনকী সামান্য বি এড পাশ করতেও খরচ করতে হচ্ছে ১২ লক্ষ টাকা। সে জন্য কেউ দেনা করছেন, কেউ জমি বেচছেন। আবার পাশ করেও সরকারি চাকরি নেই। সেখানেও সংরক্ষণ। তা হলে আমরা যাব কোথায়? খাব কী? সুতরাং হয় আমাদের সংরক্ষণ দিক সরকার, নইলে সংরক্ষণ ব্যবস্থাই তুলে দেওয়া হোক।’’
আসলে হার্দিক যে অসন্তোষের কথা তুলে ধরছেন, প্রচলিত সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে সেই আক্রোশ গোটা দেশের উচ্চ বর্ণের মধ্যে রয়েছে। পিছিয়ে পড়া ও তপশিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য বর্তমান সংরক্ষণ ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা আবার অনেকেই মানতে চান না। ফলে গুজরাতের পটেল অসন্তোষের সংক্রমণ গোটা দেশে ছড়ালে মোদী সরকারের মাথাব্যথা নিশ্চিত ভাবেই বাড়বে। বিজেপি ও কংগ্রেসের কিছু নেতা হালফিলে আর্থিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রস্তাব দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে বিহার-উত্তরপ্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতে আগুন জ্বলবে। তা ছাড়া জাঠ-গুজ্জর-পটেলরা এক সঙ্গে দিল্লিতে আন্দোলনে নামলে কী পরিণতি হতে পারে তা সহজবোধ্য। গুজ্জর-জাঠ আন্দোলনের জেরে দীর্ঘদিন উত্তর ভারত স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। বিজেপি সূত্রে বলা হচ্ছে, পটেলদের এই আগুন নেভাতে আগামিকাল গুজরাতে আসছেন আমিত শাহ। পটেল আন্দোলনেও নেতৃত্ব ঘিরে একটি বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি। যদিও হার্দিক আজ বলেছেন, ‘‘আমার ও লালজী পটেলের মধ্যে কোনও বিভাজন নেই। এবং এই প্রথম গুজরাতের লেউয়া পটেল ও করওয়া পটেলরা একজোট হয়েছে। সংরক্ষণ না দিলে আমরা বিজেপিকে সবক শেখিয়ে ছাড়ব।’’
তবে প্রশ্ন হল, মুখে বড় বড় কথা বললেও, সর্বভারতীয় স্তরে আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষমতা কি আদৌ রয়েছে হার্দিকের। ২২ বছর বয়সে তাঁর রাজনৈতিক পরিপক্কতাই বা কতটুকু? বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘বাল ঠাকরে এক জনই হয়। রামগোপাল বর্মার সব ছবিও কিন্তু হিট করেনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy