Advertisement
১৮ মে ২০২৪

পর্রীকরের বোমা সামলে জাপানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি

পাকা ঘুঁটি কেঁচে যেতে বসেছিল প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরের বেমক্কা মন্তব্যে! তা-ও একেবারে শেষ মুহূর্তে! টোকিওকে নতুন করে আশ্বাস জুগিয়ে তবে হল শেষ রক্ষা। জাপান পরমাণু সম্পর্কের গাঁটছড়া বাঁধল ভারতের সঙ্গে। জাপান ও সেই সঙ্গে আমেরিকার পরমাণু বাজারের দরজা খুলল ভারতের জন্য।

চুক্তির পরে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে মোদী। ছবি: এএফপি।

চুক্তির পরে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে মোদী। ছবি: এএফপি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:০৮
Share: Save:

পাকা ঘুঁটি কেঁচে যেতে বসেছিল প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরের বেমক্কা মন্তব্যে! তা-ও একেবারে শেষ মুহূর্তে! টোকিওকে নতুন করে আশ্বাস জুগিয়ে তবে হল শেষ রক্ষা। জাপান পরমাণু সম্পর্কের গাঁটছড়া বাঁধল ভারতের সঙ্গে। জাপান ও সেই সঙ্গে আমেরিকার পরমাণু বাজারের দরজা খুলল ভারতের জন্য।

দেশে নোট বাতিল কাণ্ডে চরম ডামাডোল। তবু সফর পিছোননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত কালই হাজির হয়েছিলেন টোকিওয়। রাত পোহালে সই হবে ভারত-জাপান অসামরিক পরমাণু চুক্তি। ছ’বছর ধরে ঝুলে থাকা যে চুক্তির রাস্তা খুলতে হয়েছে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে। জাপান সরকারকে চুক্তিতে রাজি করাতে গিয়ে পেরোতে হয়েছে আপত্তির হাজারো বাধা। সামলাতে হয়েছে শর্তের জটিল মারপ্যাঁচ। এমন এক চুক্তি সই হওয়ার আগের রাতে বোমা ফাটিয়ে বসেন মোদীরই মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পর্রীকর! ভারতের স্বঘোষিত ও দীর্ঘদিনের পরমাণু-নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে উল্টো মত প্রকাশ করেন তিনি।

অন্যের আগে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করব না (নো ফার্স্ট ইউজ)— ভারত নিজের উপরে এই নিযেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরেই। যার অন্যথা না-করা সত্ত্বেও জাপানের দাবি ছিল, ভারত চুক্তিতেই লিখে দিক যে তারা কখনওই আর পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাবে না। সুদীর্ঘ আলোচনায় মোদী সরকার জাপানকে বোঝাতে পেরেছে, চিন ও পাকিস্তানের যা ভূমিকা, তাতে এমন কথা দেওয়া ভারতের পক্ষে সম্ভবই নয়। শেষমশ ঠিক হয় চুক্তিতে বলা হবে, ভারত ভবিষ্যতে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটালে চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। এতে পথ খোলে চুক্তির। অথচ এমন এক চুক্তির ভিতটাই কাল নাড়িয়ে দিয়ে পর্রীকর কাল বলে বসেন, ‘‘ভারতকে কেন ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ নীতি নিয়ে চলতে হবে? দিল্লি তো বলতে পারে যে, আমরা দায়িত্বশীল রাষ্ট্র। দায়িত্বহীনের মতো কাজ করব না।’’ এই মন্তব্য করে সরকারের অন্দরেই প্রশ্নের মুখে পড়েন পর্রীকর। পরে নিজে ঢোক গেলেন তিনি। অন্যের মুখ দিয়েও বলান, এটা নাকি তাঁর ব্যক্তিগত মত। কিন্তু খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মুখে এমন মন্তব্যে চুক্তি ঘিরে নতুন করে জমে আশঙ্কার মেঘ। বেজায় চটেন মোদী। এত চেষ্টার ফল জলে যাবে! জাপানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সময় বিষয়টি ব্যখ্যা করতে বাধ্য হয় নয়াদিল্লি। টোকিওকে বোঝানো হয়, ওই মত ভারত সরকারের অবস্থান নয়। এক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত মত মাত্র। মেঘ কাটে এতে। মোদী ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে শীর্ষ বৈঠকের পর সই হয় চুক্তি। পরমাণু চুক্তি ছাড়াও বাণিজ্য, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আরও ৯টি চুক্তি করেছে দু’দেশে।

পরমাণু বোমায় বিধ্বস্ত হওয়া বিশ্বের একমাত্র দেশ জাপান। পরমাণু প্রশ্নে জাপানের স্পর্শকাতরতা স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। তারা এই প্রথম কোনও দেশের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করল, যারা পরমাণু (অস্ত্র) প্রসার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-তে সই করেনি। আজ এই চুক্তির ফলে ভারত জাপানের পরমাণু বাজারে প্রবেশাধিকার পেল। এতে শক্তিক্ষেত্রে একধাপে অনেকটাই এগিয়ে যাবে দিল্লি। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু বাণিজ্যও অনেকটা অক্সিজেন পেল এই চুক্তির ফলে। পাশাপাশি কড়া বার্তা দেওয়া সম্ভব হল বেজিংকে।

প্রধানমন্ত্রী আজ চুক্তি সই হওয়ার পর বলেন, ‘‘এই চুক্তি ঐতিহাসিক। এর কাঠামোর মধ্যে থেকে ভারত পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করবে। এনপিটি-তে সই না করা সত্ত্বেও পরমাণু অস্ত্র প্রসারের বিরুদ্ধে ভারত সর্বদাই সরব থাকবে।’’ এনপিটি প্রশ্নে আপত্তি সরিয়ে কেন এই চুক্তি, সেই ব্যাখ্যা দিয়ে আবে বলেন, ‘‘এমন চুক্তিই করা হয়েছে যা, বিশ্বকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার প্রশ্নে জাপানের লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’’ মোদী-আবে, দুই নেতাই মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই চুক্তিতে এমন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে যাতে কোনও ভাবেই পরমাণু অস্ত্রের প্রসার বা পরমাণু পরীক্ষা প্রশ্রয় না পায়। বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে সেখানেও এই বিষয়টিকে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।

চুক্তিটি এত দিন ধরে ঝুলে থাকার পিছনে ছিল জাপানের একটি শর্ত। তা হল, চুক্তিতে লিখতে হবে কোনও অবস্থাতেই পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাবে না। কিন্তু এটা যে এটা মানা সম্ভব নয়, সেটা আবে সরকারকে বোঝাতে পেরেছে মোদী সরকার। বলা হয়েছে, পাকিস্তান ও চিন— পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। সীমান্তলাগোয়া রাষ্ট্রগুলিকে প্রভাবিত করে চিন সেখানে সামরিক পরিকাঠামো বাড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যেই চিনের ফৌজ সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে আসছে। আর পাকিস্তান সমানে জঙ্গি পাচার করছে ভারতে, সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করে চলেছে। এমন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে পরমাণু অস্ত্র প্রসঙ্গে এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।

টোকিও এই যুক্তি মেনে নিয়ে আজ এই চুক্তি সই করায় মার্কিন পরমাণু সংস্থাগুলিও উপকৃত হবে। জিই-হিতাচি, তোশিবা-ওয়াশিংটন হাউসের মতো মার্কিন-জাপ সংস্থাগুলিকে পরমাণু চুল্লি গড়ার জন্য ইতিমধ্যেই জমি দিয়ে রেখেছে ভারত। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিও হয়ে রয়েছে। কিন্তু জাপানের সঙ্গে চুক্তি না হলে চুল্লির অনেক যন্ত্রাংশ জাপান থেকে আমদানি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ বার দ্রুত তা শুরু করা যাবে।

পরমাণু প্রশ্নে আমেরিকা-জাপান, ভারতের পাশে দাঁড়ানোটা নিঃসন্দেহে বেজিংয়ের প্রতি কড়া বার্তা। নিজস্ব কূটনৈতিক কারণে এমন বার্তা দেওয়ার আগ্রহ ছিল জাপানেরও। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সদ্যই নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশে সকলকে নিয়ে চলার বার্তা দিলেও চিন ও তাদের বাণিজ্য-কৌশল সম্পর্কে ট্রাম্প নরম হবেন তেমন আভাস কিন্তু মেলেনি। এ বার ভারত-জাপান অক্ষ জোরদার হওয়ায় আরও কিছুটা চাপে পড়ল বেজিং।

ভারত-জাপান যৌথ বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদের কড়া নিন্দা করা হয়েছে। উরি-পঠানকোট-ঢাকা হামলার তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়েছে মুম্বই ও পঠানকোটে হামলাকারীদের অবিলম্বে শাস্তি দিক পাকিস্তান। ইসলামাবাদ এই চাপকে আদৌ কতটা তোয়াক্কা করবে, সে প্রশ্ন আলাদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nuclear Deal Manohar Parrikar Indo Japan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE