Advertisement
১৯ জুন ২০২৪
বিচারপতি নিয়োগ

বিচার বিভাগ-কেন্দ্র সংঘাত চরমে

সংঘাত চলছিলই। আরও চরমে উঠল সুপ্রিম কোর্ট বনাম কেন্দ্রের লড়াই। এত দিন বল ছিল সরকারের কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলছিল, হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য যে সব নাম সুপারিশ করা হয়েছে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হচ্ছে না কেন?

সল্টলেকে প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর। রবিবার। ছবি: শৌভিক দে

সল্টলেকে প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর। রবিবার। ছবি: শৌভিক দে

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৬
Share: Save:

সংঘাত চলছিলই। আরও চরমে উঠল সুপ্রিম কোর্ট বনাম কেন্দ্রের লড়াই।

এত দিন বল ছিল সরকারের কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলছিল, হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য যে সব নাম সুপারিশ করা হয়েছে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হচ্ছে না কেন? এ বার মোদী সরকার জানিয়েছে, শীর্ষ আদালতের বিচারপতিদের কলেজিয়াম যে ৭৭ জনের নাম সুপারিশ করেছে তার মধ্যে ৩৪ জনকে নিয়োগ করা হয়েছে। বাকি ৪৩ জনই হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের যোগ্য নয় বলে মনে করছে সরকার।

মোদী সরকারের এই আচমকা বাউন্সারে স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি তীর্থ সিংহ ঠাকুর। আজ কলকাতায় ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ফর জুরিডিকাল সায়েন্সেস’-এর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘দেশের বিভিন্ন আদালতে জমে থাকা মামলার দায় চাপানো হচ্ছে বিচারবিভাগের উপরে।’’ এর আগে বিচারপতিদের কাজের চাপের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই কেঁদে ফেলেছিলেন প্রধান বিচারপতি। আজ তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন আদালতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা ৩ কোটি। তার মধ্যে ৮০ শতাংশ মামলা বিভিন্ন রাজ্যের। নানা হাইকোর্টে জমে রয়েছে ৪০ লক্ষ মামলা।

গত বছরের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ মোদী সরকারের জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন আইন খারিজ করে দেয়। তখন থেকেই বিচারবিভাগের সঙ্গে সরকারের সঙ্গে সংঘাত চরমে ওঠে। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, বর্তমান কলেজিয়াম ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন করে নতুন প্রক্রিয়া তৈরি হোক। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া নিয়েও প্রবীণ বিচারপতিদের নিয়ে তৈরি কলেজিয়ামের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন অব্যাহত। কেউই নিয়োগ নিয়ে শেষ কথা বলার অধিকার ছাড়তে নারাজ। যা নিয়ে বার বার নিজের এজলাসে সরকারকে ভৎর্সনা করেছেন প্রধান বিচারপতি। গত ২৮ অক্টোবরের শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, তিনি প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সচিব ও আইন মন্ত্রকের সচিবকে সমন পাঠাবেন। ১৭ সেপ্টেম্বর আমদাবাদে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে যান প্রধান বিচারপতি। দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন, ব্যবধান কমছে। কিন্তু আইনজীবীদের ধারণা, সরকার যে ভাবে কলেজিয়ামের সুপারিশ করা অধিকাংশ নামই খারিজ করে দিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ফাটল আরও চওড়া হয়েছে। এই প্রথম এক সঙ্গে এত জন সম্ভাব্য বিচারপতির নাম খারিজ করে দিল সরকার। আইন মন্ত্রক সূত্রের যুক্তি, গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমন অনেকের নাম কলেজিয়াম সুপারিশ করেছিল যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, যৌন হেনস্থার অভিযোগও রয়েছে। অনেকেই সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের কোনও না কোনও বিচারপতির ঘনিষ্ঠ বলেও রিপোর্টে বলা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টকে এই বার্তা দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে, কলেজিয়াম যে সব নাম সুপারিশ করে তাঁদের সবাই বিচারপতি হওয়ার যোগ্য নন। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, সরকার এক বার নাম ফেরত পাঠালে ফের তা বিবেচনা করবে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম। মঙ্গলবার কলেজিয়াম ফের বৈঠকে বসবে। সেখানে সরকারের এই নাম খারিজের পাশাপাশি বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হবে। আইন মন্ত্রক সূত্রের মতে, দু’টি বিষয়েই বল এখন কলেজিয়ামের কোর্টে। কারণ প্রক্রিয়া নিয়েও কেন্দ্র যে শেষ চিঠি পাঠিয়েছে কলেজিয়াম এখনও তার জবাব দেয়নি।

অনেকেই মনে করছেন, এ ভাবে কলেজিয়ামের সুপারিশ করা নাম খারিজ করে দিয়ে সরকার আসলে বিচারবিভাগের উপরে চাপ তৈরি করছে। যাতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকেই শেষ কথা বলার অধিকার ছেড়ে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। মোদী সরকারের তরফে পাল্টা দাবি করা হচ্ছে, ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা জারির সময় থেকেই বিচারপতিদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু। রাজনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জেরেই বিচারবিভাগের মধ্যেও ঘুণ ধরা শুরু হয়। মোদী সরকার সেই পরিস্থিতি পাল্টাতেই জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সূত্রের খবর, রাজনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জোরে যাঁদের নাম সুপারিশের তালিকায় স্থান পেয়েছে তাঁদের গুরুত্ব না দিতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন বিচারপতিও।

আইন মন্ত্রকের একাংশের মতে, বর্তমান প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের সংঘাত যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে মীমাংসায় পৌঁছনো সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতি ঠাকুর জানুয়ারিতে অবসর নেবেন। তারপরেই মীমাংসা সূত্র বের হতে পারে। এর পরে প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা বিচারপতি জে এস খেহরের। আইনজীবীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিচারপতি খেহরের বেঞ্চই জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন খারিজ করে দিয়েছিল। কাজেই তাঁর এ বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে, এমন মনে করার কারণ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Judicial conflict T.S Thakur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE