চেন্নাইয়ে এক প্রচারসভায় করুণানিধি। পিটিআইয়ের ফাইল চিত্র।
এই বিরানব্বইতেও তাঁর দিন শুরু হয় ঘড়ির কাঁটা মেলানো ভোর পাঁচটায়। যদিও সূর্য পাটে বসার আগে এখন আর প্রচারে বের হতে পারেন না তিনি।
বহু বছর ধরে মেনে চলা প্রাতর্ভ্রমণ এখন আর করতে পারেন না। কিন্তু নিজের শেষ লড়াইয়ের জন্য ফিট থাকতে ভোরবেলায় হুইলচেয়ারে বসেই পনেরো মিনিট যোগব্যায়াম সেরে নিচ্ছেন তিনি।
দুপুরে কিলিংগা অর্থাৎ শংকর মাছের আগুন-ঝাল ‘কারি’ বা প্রিয় কড়াই বিরিয়ানি আর সহ্য হয় না। খাওয়াদাওয়া এখন অতি সাদামাঠা। তবে রোজ চাই দিশি মুর্গির স্টু। আর দিনে অন্তত ৫ কাপ কফি।
তিনি, মুথুভেল করুণানিধি। তামিলনাড়ুর তিরুভারুভার জেলার তিরুকুভালাই গ্রাম থেকে উঠে এসে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যিনি দক্ষিণের এই রাজ্যে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন এক পৃথক সাম্রাজ্য। আন্নাদুরাইয়ের হাতে গড়া দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম (ডিএমকে) তাঁর হাত ধরেই আজ জাতীয় রাজনীতিতে একটা ‘ফ্যাক্টর’। নিজে পাঁচ বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তামিল রাজনীতিকে নিজের হাতের তেলোর মতো চেনা করুণানিধিকে সমর্থকেরা আদর করে ডাকেন কলাইনার (শিল্পী) বলে। সেই কলাইনার বিলক্ষণ টের পেয়েছেন, এ বারের লড়াই যাকে বলে ‘কাঁটে কা টক্কর’। তাঁর এটাও অজানা নয় যে, জিতুন বা হারুন, এটাই তাঁর শেষ মুখ্যমন্ত্রিত্বের যুদ্ধ। জরার
কামড় জাঁকিয়ে বসছে দেহে। ফলে সঞ্চিত শক্তিকে এখন অনেক হিসেব করে খরচ করতে হচ্ছে। অনেক যত্ন করে ঘুঁটি সাজাতে হচ্ছে শেষ
যুদ্ধে জয়ের জন্য।
দু’ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর ফোর্থ স্ট্রিট গোপালপুরমে বেনুগোপালস্বামী মন্দিরের উল্টো দিকে সাদা নয়নশোভন বাড়িটার বাইরের ঘরে ঢোকার অনুমতি মিলেছে। তার আগে টপকাতে হয়েছে এনএসজি-র চার জন সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মীর তল্লাশি এবং তার পাশাপাশি বার দু’য়েক স্নিফার ডগের শোঁকাশুঁকি।
ডিএমকে-র স্নায়ুকেন্দ্র কলাইনারের এই বাড়িটি নিঃসন্দেহে বিশাল। কিন্তু বৈভবের কোনও ছাপ বাইরে থেকে নেই। ক্ষমতার অলিন্দে দাপিয়ে বেড়ানো রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখে অভ্যস্ত দিল্লিবাসী সাংবাদিকের চোখ। এই বাড়ি থেকেই প্রতিদিন নিয়ম করে প্রচারে বেরোচ্ছেন করুণানিধি। সঙ্গে থাকছেন তৃতীয় স্ত্রী রজতী আম্মাল, কন্যা কানিমোজি, নাতি দয়ানিধি মারান। টু-জি কেলেঙ্কারির রেশ এখন অনেকটাই স্তিমিত, তবু প্রচারে খুব একটা চোখে পড়ছে না এক সময়ের অতি ঘনিষ্ঠ এ রাজাকে।
বাইরের ঘরে বসেই তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে কথা বলছিলেন কলাইনারের ব্যক্তিগত সচিব কে সম্মুগানাথন। বললেন, “ওঁর জন্য ভোটের ছ’মাস আগে অর্ডার দিয়ে বিশেষ ভ্যান বানানো হয়েছে। ওটাতে কলাইনার হুইলচেয়ার নিয়েই বসতে পারেন। উঁচু ছাদ। স্লাইডিং জানলা। ফলে সব জায়গায় নামতেও হচ্ছে না। জানলা সরালেই মানুষ ওঁকে দেখতে পাচ্ছেন।” ভ্যানের অন্দরে স্বাচ্ছন্দ্য যথেষ্টই। তবে তাতে চড়েও এই বয়সে রাজ্যের ২৩৪টি আসনে প্রচারে যেতে পারছেন না নবতিপর কলাইনার। তাই দল ঠিক করেছে, ন্যূনতম প্রচারের মাধ্যমে যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়। সে কারণে তাঁর জনসভাগুলি এমন ভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে এক-একটি সভা অন্তত এক ডজন নির্বাচনী এলাকাকে ‘কভার’ করে। তার পরেও অবশ্য কলাইনার সব সভায় বক্তৃতা করছেন না। বরং অনেক জায়গাতেই শুধু হাত নাড়ছেন আর মুগ্ধ জনতার দেওয়া ফুলের মালা পরে নিচ্ছেন। বোঝা যাচ্ছে কলাইনার সত্যিই বৃদ্ধ হয়েছেন! অথচ এক সময় তাঁর আগুন ঝরানো বক্তৃতা মুগ্ধ করে রাখত লাখো তামিল হৃদয়। সেই তিনি এখন যে সব জায়গায় বক্তৃতা না দিলেই নয়, ক্যারাভানে চড়ে সেখানে গিয়ে খুব অল্প কথায় এডিএমকে আমলে পরিকাঠামো, বিদ্যুতের বেহাল ছবি তুলে ধরছেন। বলছেন বেকারি বেড়েছে কী ভাবে। দিচ্ছেন উন্নয়নের আশ্বাস। তাতেই খুশ জনতা।
তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব রাজামানিক্কম দিনভর বিভিন্ন নেতার সঙ্গে করুণানিধির বৈঠক সামলাচ্ছেন। দলের নীচের সারির নেতাদের আবেদন-নিবেদন শুনে নিচ্ছেন। এবং আরও একটি কাজ নিষ্ঠাভরে গত দু’বছর ধরে করছেন। তা হল করুণানিধির ফেসবুক এবং টুইটার অ্যাকাউন্ট সামলানো। বললেন, “কলাইনার প্রতি দিন সকালে আমায় জানান, তাঁর কোন বক্তব্য ফেসবুক এবং টুইটারে তুলে ধরতে হবে। এই নতুন মাধ্যম সম্পর্কে আমার আপনার থেকে অনেক বেশি সচেতন তিনি।”
মজার ব্যাপার হল, প্রচারে বেরিয়ে একবারের জন্যও পরম রাজনৈতিক শত্রু জয়ললিতার নাম করে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন না কলাইনার। ফেসবুক-টুইটারেও না। অথচ ২০০১-এর জুনে এই জয়ললিতাই মাঝরাতে পুলিশ পাঠিয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর এক সঙ্গী জানালেন, ভ্যানের যাত্রাপথে টিভিতে পুরনো দিনের সিনেমার গান দেখতে দেখতে (যা তাঁর বহু দিনের দুর্বলতা) মাঝে মধ্যেই জয়ললিতার নাচ-গানের ছবি এলেও চ্যানেল ঘোরানোর নির্দেশ দিচ্ছেন না কলাইনার!
গত পঁচিশ বছর ধরে করুণানিধির প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু এম নাগানাথন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান। ডিএমকে জমানায় রাজ্যের যোজনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যানও বটে। সন্ধ্যায় বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন তিনি। কলাইনারের ভ্যানে চড়ে যাবেন দক্ষিণ চেন্নাই সফরে। বন্ধুর তৈরি হওয়ার অপেক্ষা করছেন তিনিও। স্মৃতিচারণের ঢঙে বললেন, “কলাইনারকে গ্রেফতার করতে মাঝরাতে পুলিশ পাঠিয়েছিলেন জয়ললিতা। এই ধরনের কোনও কাজ কিন্তু কলাইনারকে কখনও করতে দেখবেন না। জয়া যখন খুব অল্প বয়সে সিনেমা জগতে আসেন, তখন থেকে কলাইনার ওঁকে দেখেছেন। দুর্নীতির অভিযোগে একবার পুলিশ পাঠাতে হয়েছিল জয়ললিতার বাড়ি। করুণানিধি পুলিশকে বলে দিয়েছিলেন, যতক্ষণ না জয়া নিজে বাইরে আসছেন, যেন গ্রেফতার না করা হয়। সে দিন অফিসারদের বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই নিরাপত্তাকর্মীদের নির্দেশে বাড়ির বাইরে চলে আসতে হল। দাঁড়াতে হল মূল ফটক থেকে অন্তত বিশ ফুট দূরে! ভ্যানে চড়ে বাইরে এলেন ৯২ বছরের বৃদ্ধ সিংহ। সামনে মানুষের ঢল এবং উল্লাসধ্বনি। তামিল ভাষার বিন্দুবিসর্গ না জানলেও সমর্থকদের উচ্ছ্বাস বুঝিয়ে দিচ্ছিল, প্রিয় নেতাকে কী বলতে চাইছেন তাঁরা।
আবেগের ভাষা বুঝতে তো আর তামিল জানার দরকার হয় না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy