Advertisement
২১ মে ২০২৪

তালাক-যুদ্ধ জিতেও থামেনি লড়াই

কঠোর স্বরে আতিয়া বলেন, ‘‘জানেন আজ পর্যন্ত কাঁদিনি। কেন কাঁদব? জীবন চালাতে মেয়েদের পুরুষদের প্রয়োজন হয়, কে বলল?”

অনমনীয়: দুই মেয়ের সঙ্গে আতিয়া সাবরি। নিজস্ব চিত্র

অনমনীয়: দুই মেয়ের সঙ্গে আতিয়া সাবরি। নিজস্ব চিত্র

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
সহারনপুর শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:০২
Share: Save:

বড় হয়ে কী হতে চাও? ছোটদের সামনে পেলে বাঙালি পিসি-পিসেমশাই, জেঠু-জেঠিমা, কাকু-কাকিমাদের এই অমোঘ প্রশ্নটি যুগে যুগে চলে এসেছে। জিনের ভিতর ঢুকে থাকা বাঙালিয়ানা উত্তর ভারতের তপ্ত ভোট-রাজ্যে প্রয়োগের লোভ সামলানো গেল না ফুটফুটে দুটি মেয়েকে দেখে। পাঁচ বছরের সানা আর ছ’বছরের সাদিয়া। সহারনপুরের কল্পনা টকিজ পেরিয়ে ‘আলি কি চুঙ্গি’ আর তারপর ‘তেলি ওয়ালে’ চকের সেঁদো গলি। মুসলিম-বহুল এলাকার সাদামাটা ঘর। কে বলবে, স্বাধীন ভারতের এক ‘বিপ্লবী’র ঠিকানা এটা?

বড় মেয়ে সাদিয়া লাজুক গোছের। বড় হয়ে ‘সুঁই’ ফোটাবে, চিকিৎসক হয়ে সেবা করবে। দাদুকে দেখে যেটুকু শেখা। কিন্তু পিঠোপিঠি ছোট মেয়ে সানা? পাঁচ বছরের এক শিশুর থেকে যে উত্তর এল, তা অচেনা। শুধু দু’টি লাইন। ‘‘বড় হয়ে বিচারক হব। ওয়াজিদকে জেলে পাঠাব।’’ বুকে টেনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মা বললেন, ‘‘এটুকু বয়স। কোথা থেকে এত রাগ এল জানি না! অথচ ওর এত কিছু জানার কথা ছিল না।’’

দুই মেয়ের মা-ই বিপ্লবটা করেছেন। শায়রা বানো, ইশরাত জহান, গুলশন পারভিন, আরফিন রহমানদের সঙ্গে ইতিহাসে এখন জড়িয়ে গিয়েছে সহারনপুরের আতিয়া সাবরির নামও। এঁরা প্রত্যেকেই তিন তালাকের শিকার। কারও টেলিফোনে, কারও হোয়াটসঅ্যাপে। আতিয়ার ক্ষেত্রে দশ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে। এঁদের করা মামলাতেই সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক সংবিধান বিরোধী। সে প্রায় দু’বছর হতে চলল।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সাবরি পরিবারের একমাত্র মেয়ে আতিয়ার বিয়ে ধুমধাম করে হয়েছিল হরিদ্বারের ওয়াজিদ আলির সঙ্গে। সালটি ২০১২। বিয়ের সময় টিভি, কুলার, ফ্রিজ, গাড়ি, ৩০ তোলা গয়না দিয়ে মেয়েকে বিদায় করেছিল সাবরি পরিবার। কিন্তু দু’বছরের মধ্যে দুই মেয়ে হওয়ার পরেই বদলে গেল ছবিটা। মারধর, অত্যাচার। বিষও খাওয়াতে চেয়েছিল আতিয়াকে। তার পরেই তালাক। ‘‘হিম্মত হারিনি। কোনও দিন বোরখা পরিনি। আজও পরি না। আমার বিরুদ্ধে ঘৃণা থাকতে পারে, দুধের শিশুগুলির কী দোষ? সন্তান মেয়ে বলেই এত রাগ?’’ কঠোর স্বরে আতিয়া বলেন, ‘‘জানেন আজ পর্যন্ত কাঁদিনি। কেন কাঁদব? জীবন চালাতে মেয়েদের পুরুষদের প্রয়োজন হয়, কে বলল? আমি মা। দুটি বাচ্চাকে বড় করাই এখন আসল কাজ। কোনও দিন যেন ওদের মনে না হয়, মেয়ে হয়ে জন্মে ভুল করেছে।’’

সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পরও লড়াই থামেনি আতিয়ার। ওয়াজিদ জেল খেটে এখন বাইরে। কিন্তু হরিদ্বার আর রুরকির আদালতে এখনও ওয়াজিদের লাগানো পাঁচটি মামলা চলছে আতিয়ার বিরুদ্ধে। আতিয়া লড়ছেন। দূর দূর থেকে ঠিকানা জোগাড় করে মহিলারা আসেন। সাহস নিতে। ‘‘সকলকে বলি, মহিলা বলে সাহস হারাবেন না। আমার মতো লড়াই করুন।’’ সহারনপুরের গোটা মুসলিম মহল্লার সিংহভাগ এখন হয় বুয়া-বাবুয়া, নয়তো কংগ্রেসের পাশে। তাঁদের নিয়েই আজ দেওবন্দে প্রথম যৌথ সভা হল মায়াবতী-অখিলেশের। কাল প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর সভা। আতিয়া তবু বলছেন, ‘‘মহল্লায় বেরোলেও কম গঞ্জনার শিকার হতে হয় না। তা-ও বলব, তিন তালাকের বিল এনে বিজেপি সাহস দেখিয়েছে। একটাই অনুরোধ, সরকারে যে-ই আসুক, সংসদের দুই সভায় বিলটি পাশ করুন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE