Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

বাঁচতে হবেই, সঙ্কল্প ছররা-বেঁধা চোখে

হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর প্রতিবাদে পথে নামে দক্ষিণ কাশ্মীরের যুব সমাজের একটি বড় অংশ। এমনই এক প্রতিবাদ-ধর্নায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন আশরফ।

অদম্য: এক চোখে অন্ধকার। দ্বিতীয়টিও নষ্ট হওয়ার মুখে। পুলওয়ামা টাউনের মহম্মদ আশরফ। নিজস্ব চিত্র

অদম্য: এক চোখে অন্ধকার। দ্বিতীয়টিও নষ্ট হওয়ার মুখে। পুলওয়ামা টাউনের মহম্মদ আশরফ। নিজস্ব চিত্র

অনমিত্র সেনগুপ্ত
পুলওয়ামা শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:২৫
Share: Save:

৬৩৫টি ছররা সারা শরীরে! বুকের কাছে বুলেটের ক্ষত! এক চোখ দৃষ্টিশক্তিহীন! অন্য চোখটাও নষ্ট হওয়ার মুখে! নিজের সমস্ত রকমের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে রেখেই কাশ্মীরের ছররা-আক্রান্তদের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মহম্মদ আশরফ।

স্নাতক স্তরের পড়াশোনার পাশাপাশি মোবাইল সংস্থায় কাজ— ভালই ছিলেন পুলওয়ামা টাউনের বাসিন্দা আশরফ। ছবি পাল্টায় ২০১৬ সালে। হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর প্রতিবাদে পথে নামে দক্ষিণ কাশ্মীরের যুব সমাজের একটি বড় অংশ। এমনই এক প্রতিবাদ-ধর্নায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন আশরফ। এক সময়ে প্রতিবাদীরা পাথর ছোড়া শুরু করলে পাল্টা গুলি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। বুলেট লাগে আশরফের বাঁ কাঁধের নিচে। ১৭ দিন কোমায় থেকেও কোনও মতে বেঁচে যান। হাসপাতালে কাটে মাসখানেক।

বাড়ি ফেরার পরে এক দিন চিকিৎসার জন্যই শ্রীনগরে যাওয়ার পথে ফের গোলমালের মধ্যে পড়ে যায় আশরফ ও তাঁর পরিবার। আশরফের কথায়, ‘‘সেই সময়ে বিক্ষোভ চলছিল। আমরা পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছিলাম। পুলিশ হঠাৎ ভিড় লক্ষ্য করে ছররা চালাতে শুরু করে।’’ আশরফকে রাস্তার ধারে বসিয়ে গাড়ির খোঁজে গিয়েছিল পরিবার। আশরফের দাবি, ‘‘একা পেয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আমায় নিশানা করে ছররা মারে। গোটা শরীরে ঢুকে যায় ছররা। বাদ যায়নি দু’টো চোখও।’’ পরে চিকিৎসকদের থেকে তিনি জানতে পারেন, সারা শরীরে ৬৩৫টি ছররা বিঁধে রয়েছে তাঁর। নিভে যেতে বসেছে চোখের জ্যোতি।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আশরফ ভেবেছিলেন আত্মহত্যা করবেন। কিছুটা সময় বয়ে যাওয়ার পরে মনটাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করান আবার। ছররা-আক্রান্তদের একজোট করে নামেন পুনর্বাসনের লড়াইয়ে।

তাতে ফল হচ্ছে? এ যাবৎ স্রেফ আটশো টাকা সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন আশরফ। সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতির কী হল? বিষণ্ণ হেসে আশরফ বললেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত মাত্র ১৩ জন চাকরি পেয়েছেন। তা-ও তাঁদের নিয়ে সংবাদমাধ্যম লেখালেখি করেছে বলে।’’ আশরফের গড়া ‘পেলেট ভিকটিম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এ আপাতত যুবক-যুবতী-শিশু-কিশোর মিলিয়ে অন্তত ৩ হাজার মানুষের নাম রয়েছে, যাঁরা কখনও না কখনও ছররায় আহত হয়েছিলেন। মসজিদ, বাণিজ্যিক সংস্থা, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে তাঁদের নিয়মিত চিকিৎসার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত যুবক-যুবতীদের উচ্চশিক্ষাতেও সাহায্য করছে ট্রাস্ট। নিয়মিত তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন মনোবিদেরা। আশরফের কথায়, ‘‘অনেকেই আত্মহত্যার কথা ভাবেন। তাই মনোবিদ।’’

তবে ছররা-আক্রান্তেরা চাকরি না-পেলে কত দিন এমন অসম লড়াই চালানো যাবে, তা নিয়ে সন্দিহান বছর আঠাশের আশরফ। তাই তাঁদের যদি অন্তত চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে নিয়োগ করা যায়, সেই আর্জি নিয়ে ঘুরছেন সরকারি থেকে বেসরকারি সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে রাজ্যপালের দরজায়। আশরফের কথায়, ‘‘ছররার জন্য এমনিতেই উপত্যকার একটি প্রজন্মের জীবন নষ্ট হতে বসেছে। এখনই উদ্যোগী না-হলে তারা একেবারে হারিয়ে যাবে।’’

কারা ছোড়ে পাথর? অভিযোগ রয়েছে, টাকার বিনিময়ে পাথর ছোড়া হয়। আশরফ বলেন, ‘‘কিছু যুবক টাকা নিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশই তো সেনা ও পুলিশের জুলুমে ক্ষুব্ধ। রাতবিরেতে যুবকদের তুলে নিয়ে যায় সেনা। অত্যাচার চালায়। ক্ষোভ তো থেকেই যায়।’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, টাকার জন্যই ছেলেরা পাথর ছোড়ে। তা হলে ভারত সরকার ওদের টাকা দিয়ে সেটা বন্ধ করছে না কেন!’’

মানবাধিকার সংগঠনগুলির চাপে পড়ে ছররার ব্যবহার সরকারি ভাবে বন্ধ রেখেছে নিরাপত্তা বাহিনী। যদিও আজ ভোটের দিনে বদগামে ফের পাথর পড়েছে এবং বাহিনীর পাল্টা ছররায় এক মহিলা-সহ তিন জন আহত হয়েছেন বলে খবর।

শ্রীনগরে কিন্তু দেখেছি, রাত ৯টাতেও দোকানপাট খোলা। বিকেলে লাল চকের সামনে ফুটবল পেটাচ্ছে ছেলেরা। সকালে বাসস্টপে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়। তবে সবই চলছে বাহিনীর কড়া নজরদারিতে। রাস্তার মোড় থেকে খেলার মাঠ, বাসস্ট্যান্ড থেকে পার্ক— সর্বত্রই কার্বাইন হাতে উর্দিধারীরা।

আপাত শান্ত আবহ। তবু স্বস্তি পাচ্ছেন না শ্রীনগরের হোটেল ব্যবসায়ী ফিরদৌস দার। নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় ফিরলে কাশ্মীর যে ফের অশান্ত হবে, এ নিয়ে তাঁর মতোই নিশ্চিত গাড়িচালক ফয়জল। বিজেপি এলে ৩৭০ ধারা বা ৩৫এ নাড়াচাড়া শুরু হতে কতক্ষণ! ফিরদৌসের মনে কাঁটা। এ কোনও ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা নয় তো!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE