অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
পুরাকালে বানরসেনা লন্ডভন্ড করেছিল লঙ্কা। আর এই ঘোর কলিতেও তারা একই রকম আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ইন্দ্রপ্রস্থে!
যার জেরে আশঙ্কায় চুল উস্কোখুস্কো তৃণমূলের ডাকসাইটে সাংসদ তথা লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সম্প্রতি সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে চিঠি লিখে সমস্যার কথা জানিয়েছেন সুদীপবাবু। বলছেন, “ঢের হয়েছে খোলামেলা, গাছপালা, লনওয়ালা বড় বাংলো! দরকার নেই এই বিলাসবহুল টাইপ এইট-এর! চারদিক ঢাকা দেওয়া টাইপ সেভেন বাংলোই দেওয়া হোক আমায়। একটু ছোট হলে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সুবিধে হবে!”
এটা স্পষ্ট যে, সুখের থেকে স্বস্তিকেই পছন্দ করছেন এই সাংসদ। গত কয়েক বছর ধরে সুদীপবাবু মৌলানা আজাদ রোডের একটি বাংলোর বাসিন্দা। এখানেই এক সময় থাকতেন জয়া বচ্চন। অজ্ঞাত কারণে এই বাড়িটির উপরেই বানরসেনার নেকনজর একটু বেশি! সংসদ থেকে বাড়ি ফিরে, অথবা কলকাতা থেকে দিল্লি পৌঁছে সুদীপবাবুকে নিয়মিত বিপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। কোনও দিন দেখছেন রান্নাঘর তোলপাড় করে চলে গিয়েছে তারা। কোনও দিন দেখছেন বাগান তছনছ। একটু সুযোগ পেলে ছিঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে বালিশ-তোষকও। সুদীপবাবু বলছেন, “এ ভাবে আর থাকা যায় না। জিনিসপত্র যা নষ্ট হওয়ার তো হচ্ছেই, কোনও দিন না আরও বড় কোনও বিপদ হয়।” তবে আপাতত তাঁর চিন্তামুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। বেঙ্কাইয়া সুদীপবাবুকে জানিয়েছেন, চট করে তাঁর পছন্দ মতো ‘সুরক্ষিত’ কোনও বাংলো পাওয়া যাচ্ছে না।
আসলে সুরক্ষিত নয় ল্যুটিয়েনের দিল্লির কোনও বাংলোই। ব্যাপারটা তো এমন নয় যে, একমাত্র সুদীপবাবুই এই সমস্যার সম্মুখীন। সম্ভবত খোলামেলা এবং বৃক্ষবহুল হওয়ার জন্যই বিভিন্ন সময়ে দিল্লির এই ভিআইপি এলাকার বাংলোগুলিতে অতর্কিতে হানা দেন নল, নীল, গয়, গবাক্ষ, সুগ্রীবেরা! সাউথ ব্লক অথবা নর্থ ব্লকেও ঢুকতে-বেরোতে কার্নিসে, গেটের আশপাশে, ছাদে, চাতালে বিভিন্ন দেহভঙ্গিমায় দেখা যায় তাদের। ওই সব অফিসের কর্মীরা না হয় অভ্যস্ত। কিন্তু এই সব ভবনে প্রায়শই যাতায়াত করেন বিদেশি অতিথি, ভিন্ শহরের শীর্ষ বাণিজ্যকর্তা, নেতা, মন্ত্রী, আমলারা। তাঁরা অনেকেই চোখ ছানাবড়া করে দেখেন বাঁদরদের পারষ্পরিক উকুন বাছার দৃশ্য অথবা বাচ্চা কোলে পাঁইপাঁই দৌড়!
এক বার বড় ট্র্যাজেডিও ঘটে গিয়েছে নয়াদিল্লিতে। ১৯৯৭ সালে শহরের তৎকালীন ডেপুটি মেয়র এস এস বাজওয়া বাঁদরের আক্রমণে তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পান। সেই আঘাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ‘বাঁদরামি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দিল্লি হাইকোর্ট একটি এনফোর্সমেন্ট কমিটি তৈরি করে। ওই কমিটি তাদের রিপোর্টে বলে, মানুষের বাসস্থান থেকে বাঁদরদের সরিয়ে আসোলা ভাট্টির অভয়ারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। আদালত দিল্লি সরকারকে সেই মর্মে নির্দেশ দেয়। তখন দিল্লির পুরসভা কোর্টকে জানায়, এই কাজ করার জন্য যথেষ্ট প্রশিক্ষিত ব্যক্তি তাদের হাতে নেই। আদালত বরং বন এবং বন্য প্রাণী দফতরকে এই দায়িত্ব দিক। প্রাথমিক ভাবে কাজ শুরুও হয়। কিন্তু বাঁদরদের বংশবৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই পুনর্বাসনের কাজ করা যায়নি। নয়াদিল্লি পুর এলাকায় (এনডিএমসি) রয়েছে ৭ হাজারের কাছাকাছি বাঁদর। নিগমের কর্তা পি কে শর্মা জানাচ্ছেন, “আসোলা ভাট্টির মতো আরও বেশ কিছু মুক্ত বনাঞ্চলে আমরা বাঁদরদের রেখে আসছি। কিন্তু সেই এলাকাটাও সীমিত। কত আর রাখা যায়!”
রামভক্তদের বেগ দেওয়ার পিছনে রাজনৈতিক উৎসাহের অভাবও কি রয়েছে কিছুটা? বিজেপি নেতা বিনয় কাটিহার যেমন বলছেন, “হনুমান, বানরসেনা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের সঙ্গে সহাবস্থানে সমস্যাটা কী?” তাঁর মতে, ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে বাঁদর থাকেই, তাতে পুজো-প্রার্থনার কোনও সমস্যা হয় না। দর্শনার্থীরাও দিব্যি যাতায়াত করেন।
তবে এই বিজেপি নেতার মতামতই যে সবার, এমন তো নয়। খোদ সংসদেই একদিন লিফট থেকে বেরিয়ে আঁতকে উঠেছিলেন কংগ্রেস মুখপাত্র পি সি চাকো। তাঁর কথায়, “একতলা থেকে লিফটে উঠছিলাম তিনতলার কোনও অফিসে। অনেকটা সন্ধেও হয়ে গিয়েছিল। করিডর ছিল সুনসান। দূর থেকে দেখি, খিড়কি আটকে কেউ যেন ঝুঁকে বসে রয়েছে। কোনও কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ল কি না দেখতে নিচু হয়েই, লাফিয়ে তিন পা পিছিয়ে আসি! সেই থেকে সমঝে চলি সংসদের অলিগলি!”
‘বাঁদরামি’ বন্ধ করার জন্য অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার হনুমান পোষে। প্রতি মাসে সরকারি পে-স্কেলে বেতন দেওয়া হয় তাদের। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু দিন আগে তাঁর এই মৌলানা আজাদ রোডের বাড়িটিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি সফর উপলক্ষে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। ফিশফ্রাইয়ের মনকাড়া গন্ধে যাতে হাজির না-হয় বাঁদরবাহিনী, সে জন্য হনুমান ভাড়া করে রাখতে হয়েছিল তাঁকে!
তবে এনডিএমসি-র সাম্প্রতিকতম সতর্কতা বাঁদরেরা নাকি এখন আর হনুমানেও ভয় পাচ্ছে না। দৌরাত্ম্যেও তাই বিরাম নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy