রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনায় বিক্ষোভ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের। বুধবার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
বিজেপির কেন্দ্রীয় দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে দলের এক শীর্ষ নেতার আজকের মন্তব্য— সময় খারাপ গেলে গালের ফুসকুড়িও সেপটিক হয়ে যায়। হায়দরাবাদের দলিত নিপীড়ন নিয়ে সারা দিন ধরে চ্যানেলে চ্যানেলে দলকে আগলাতে হচ্ছে ওই নেতাটিকে। কিন্তু তাঁর ‘মনের কথা’টি জানিয়ে বিজেপি নেতাটি বললেন, ‘‘আপনাদের জানা উচিত— বিজেপি কিন্তু আসলে দলিত-বিরোধী রাজনীতি করে না!’’
উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দিল্লি ফিরেই আজ বেশ কিছু শীর্ষ মন্ত্রীর কাছে হায়দরাবাদের ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন— হায়দরাবাদ ও দিল্লিতে দলের নেতারা যে ভাবে বিষয়টি সামলানোর চেষ্টা করেছেন, সেটি আদৌ প্রশংসনীয় নয়। বন্দারু দত্তাত্রেয় এবং স্মৃতি ইরানির অদক্ষতায় পুরো বিষয়টি আরও পাকিয়ে উঠেছে। বিজেপির মুখপাত্ররাও বলছেন, ‘‘আমরাও জানি না, ঠিক কী ভাবে বিষয়টির মোকাবিলা করব। সরকার যদি দলের দুই মন্ত্রীর চিঠি-চাপাটির কথা দলকে সবিস্তার না জানায়, আমরাই বা কী ভাবে বিরোধীদের অভিযোগের জবাব দিই?’’
সেই কারণেই মূল বিষয়ে না-গিয়ে বিজেপি মুখপাত্র নলিন কোহলি বলতে শুরু করেছেন— স্মৃতি ইরানি রাহুল গাঁধীর নির্বাচনী কেন্দ্রে বেশি যেতে শুরু করেছেন বলেই তাঁকে আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে। এর মধ্যে কোনও দলিত-দরদের রাজনীতি নেই।
স্মৃতি ইরানি আজ যতই সামনে এসে জবাব দিন না কেন, বিজেপির অনেক নেতাই কিন্তু মানছেন, কংগ্রেস আমলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এ ধরনের ঘটনায় এমন কথায় কথায় চিঠি লিখতেন না। বরং ফোন করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। তাঁদের কৌশল ছিল— ‘শতং বদ মা লিখ’। স্মৃতি ইরানি অবশ্য বলছেন, কংগ্রেস আমল থেকেই এই প্রথা চালু আছে। সাংসদদের পাঠানো চিঠি খতিয়ে দেখার কথা বলাটাই রীতি। কংগ্রেসের সাংসদের বেলাতেও একই পথ অনুসরণ করা হয়েছে।
মুখপাত্রদের অবশ্য অনেকেই আসলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন, দলের কোনও শীর্ষ নেতা এই নিয়ে মুখ খুলুন। বিশেষ করে রবিবার অমিত শাহ যখন নতুন করে সভাপতির পদে বসতে চলেছেন, তিনি কিছু বলুন। কিন্তু তিনিও মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় দলের মুখপাত্ররা কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য বলছে, দলিত ছাত্রের আত্মহত্যা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। প্রথমেই এই ঘটনায় তীব্র অনুতাপ ব্যক্ত করে বিজেপির স্থানীয় নেতাদের উচিত ছিল, সেই ছাত্রের পরিবার এবং বন্ধুদের পাশে দাঁড়ানো। এই ‘মানবিক’ রাজনীতির নমুনা বন্দারু দত্তাত্রেয়র মতো প্রবীণ শ্রমমন্ত্রীও দেখাতে পারেননি। এমনকী গোড়াতেই বেঙ্কাইয়া নায়ডুর মতো কোনও নেতাকে তড়িঘড়ি হায়দরাবাদে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তা হলে বিষয়টি নিয়ে এ ভাবে কোণঠাসা হতে হতো না বিজেপিকে।
আরএসএস সূত্র বলছে, সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শ হলো— অবিভক্ত হিন্দু সমাজের পুনরুত্থান। দলিত সমাজকে হিন্দু সমাজের অঙ্গ হিসেবেই তারা দেখে। এই রাজনীতির সব থেকে বড় উদাহরণ বঙ্গারু লক্ষণের মতো দলিত নেতাকে ২০০০ সালে বিজেপির সভাপতি নিযুক্ত করা। গোবিন্দাচার্য থেকে বিনয় কাটিয়ার বা উমা ভারতী পর্যন্ত বিভিন্ন দলিত নেতাকে সামনে এনে সঙ্ঘ পরিবার বার বার এই ‘ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রর’ অপবাদ ঘোচাতে চেয়েছে। যদিও মায়াবতীর মতো নেত্রী দলিত সমাজের কাছে পাল্টা বার্তা দেন— তুমি আগে দলিত, তার পর হিন্দু। মনুবাদী উচ্চবর্ণের নেতারা তোমার দলিত সত্তাকে ভুলিয়ে তোমাকে ক্রীতদাস করে রাখতে চায়।
উল্লেখযোগ্য হল— রাহুল গাঁধী থেকে সীতারাম ইয়েচুরি, মমতার দুই প্রতিনিধি, এমনকী কেজরীবালও হায়দরাবাদে পৌঁছে গেলেন, মায়াবতী কিন্তু সেখানে যাননি। উল্টে তিনি কলকাতায় গিয়ে রাজ্য সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদী উত্তর-পূর্বে গিয়ে উন্নয়নের স্লোগান গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আর কিছু নয়, শুধু উন্নয়ন-উন্নয়ন-উন্নয়ন!’’ তিন বার এই শব্দটি উচ্চারণ করে তিনি সেখানে জানিয়েছিলেন, তাঁর প্রধান আলোচ্যাসূচি এই একটাই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বললে কী হবে? মোদী-বিরোধী মঞ্চ গঠনে অগ্রণী রাহুল গাঁধী। কেজরীবাল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রাও এই মঞ্চ তৈরিতে তৎপর। সীতারাম ইয়েচুরিও হায়দরাবাদে গিয়েছেন। বিরোধী দলগুলি পরিস্থিতির সুযোগ নেবে, এটাই স্বাভাবিক। নরেন্দ্র মোদী যতই বলুন, তিনি কাঁটাতেই অভ্যস্ত। কিন্তু বিজেপির শীর্ষ নেতারা স্বীকার করছেন, সরকার, দল এবং সঙ্ঘ পরিবারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং মন্ত্রীদের পরিস্থিতি সামলানোর অযোগ্যতা এখন মোদী সরকারকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছে।
দেরিতে হলেও এই সঙ্কট থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজছে দল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy