মাত্রই দু’দিন আগের কথা। একটি সংবাদপত্রের অনুষ্ঠানে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘‘প্রত্যেক প্রজন্মকে জরুরি অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেওয়া উচিত, যাতে আর কোনও রাজপুরুষের মনে এমন ‘পাপ’ করার ইচ্ছাও না জন্মায়।’’
এই মন্তব্যের এক দিনের মাথায় একটি সর্বভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের সম্প্রচার এক দিনের জন্য বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে মোদীর গায়েই লেগে গেল ‘জরুরি অবস্থা’ চালুর তকমা!
এনডিটিভি গ্রুপের ‘এনডিটিভি ইন্ডিয়া’ চ্যানেলের সম্প্রচার আগামী ৯ নভেম্বরের মধ্যরাত থেকে ১০ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এ বছর জানুয়ারি মাসে পঠানকোটে জঙ্গি হামলার সময় দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁস করেছে চ্যানেলটি। আজ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কর্তারা জানিয়েছেন, এনডিটিভি চাইলে আদালতে যেতে পারে।
এনডিটিভি-র তরফে বলা হয়েছে, পঠানকোট হামলা নিয়ে বাকি সব সংবাদমাধ্যম যা প্রচার করেছে, ভারসাম্য বজায় রেখে তারাও একই সম্প্রচার করেছে। তবু বেছে বেছে তাদের নিশানা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তারা সব পদক্ষেপই বিবেচনা করছে।
মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সব স্তরের সংবাদমাধ্যম তো বটেই, বিরোধী দলগুলিও ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সব পক্ষের বক্তব্য, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বারবার আঙুল তোলা মোদীর জমানাতেই ফিরে এল জরুরি অবস্থা! সম্পাদকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘এডিটর্স গিল্ড’ এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেছে, এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরাসরি আঘাত। ব্রডকাস্ট এডিটর্স অ্যাসোসিয়েশনও একই সুরে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি তুলেছে।
রাজনৈতিক নেতাদের সুর অনেক বেশি চড়া। টুইটারে কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীর মন্তব্য, ‘‘চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ মোদীজির ভারতের নমুনা! সাংঘাতিক ও অপ্রত্যাশিত।’’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘পঠানকোটের খবর নিয়ে সরকারের সমস্যা থাকলে অন্য পথও নেওয়া যেত। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা তো জরুরি অবস্থার মনোভাব প্রকাশ করে।’’ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল এবং কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহের পরামর্শ, ওই দিন (৯ নভেম্বর) সব চ্যানেল নিজেদের সম্প্রচার বন্ধ রাখুক এবং সব সংবাদপত্র তাদের প্রকাশনা বন্ধ রাখুক।
সংবাদ চ্যানেল এ ভাবে বন্ধ করলে যে ‘জরুরি অবস্থা’র তকমা গায়ে সেঁটে যাবে, সেটি মোদী সরকারের অজানা নয়। তা সত্ত্বেও কেন এমন পদক্ষেপ করল তারা?
বিজেপি শিবিরের অন্দরের খবর, কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে কথা না বলে কড়া সমালোচনা করছে। পঠানকোট-প্রসঙ্গকে সামনে রেখে একটি চ্যানেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এ বার তাদের প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দেওয়া হল। কেজরীবালও সেই সুরেই বলেছেন, ‘‘আসলে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমকে শাসানি দিয়ে সরকার-বিরোধী প্রচার বন্ধ করা হচ্ছে। যারা তার পরেও সাহস দেখাচ্ছে, তাদের সম্প্রচার বন্ধ করে সরকার বার্তা দিচ্ছে, হয় তাদের পক্ষে কথা বলতে হবে, না হলে শাস্তিভোগ অনিবার্য!’’ বিজেপির এক নেতা রীতিমতো কটাক্ষের সুরে যা বলেছেন, তাতেও নিরাপত্তার থেকে যেন অনেক বেশি চ্যানেলকে ‘সবক’ শেখানোর সুর! ওই নেতার কথায়, ‘‘জেএনইউ-বিতর্কের সময়ে ‘এনডিটিভি ইন্ডিয়া’ পুরো এক ঘণ্টা ‘ব্ল্যাক আউট’ করে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্রের পক্ষে ‘কালো দিন’ বলে মোদী সরকারকে তোপ দেগেছিল। আজ ওদের সম্প্রচার বন্ধ হলে ক্ষতি কী? ওদের তো পর্দা কালো করে চালানোর অভ্যেস রয়েছে!’’
২৬/১১-র হামলার পর টিভি চ্যানেলগুলিকে জঙ্গি হামলার সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে কিছু নির্দেশিকা জারি করেছিল নিউজ ব্রডকাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (এনবিএ)। আইন বদল করা হয়েছিল। তার পরে মোদী সরকারের আমলে, গত বছর এপ্রিলে কেব্ল টিভি নেটওয়ার্ক বিধিতে সংশোধনী আনা হয়। তাতে চ্যানেলগুলিকে সতর্ক করে বলা হয়, জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে কোনও জঙ্গি দমন অভিযানের সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে না। যদিও তার পরে পঞ্জাবের গুরুদাসপুরে পুলিশ ফাঁড়িতে জঙ্গি হামলার সরাসরি সম্প্রচার করেছিল অনেক চ্যানেল। তখন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্র।
এখন বিজেপির তরফে বলা হচ্ছে, পঠানকোট সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হানার সময় এনডিটিভি নিরাপত্তার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্প্রচার করেছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীনে সচিব পর্যায়ে আন্তঃমন্ত্রক কমিটি এনডিটিভি-র কাছে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিল। এনডিটিভি কোনও অনুশোচনা জানায়নি। কমিটি চ্যানেলটিকে ৩০ দিন বন্ধ রাখার সুপারিশ করলেও বিজেপি নেতাদের দাবি, তাঁরা উদারতা দেখিয়ে মাত্র এক দিন বন্ধ করছেন।
সমালোচনার মুখে বিজেপি এই সিদ্ধান্তকে দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে জুড়তে চাইছে। অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ বিজেপির সচিব শ্রীকান্ত শর্মা বলেন, ‘‘আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনও আপস করা হবে না। দেশ সবার উপরে।’’
বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, মোদী জমানায় নানা ভাবে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছে। এটা নতুন নয়। আগামী দিনে এমন ঘটনা আরও ঘটলে অবাক হওয়ার নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy