রবিবার মণিপুরের রাজ্যপালের হাতে স্মারকলিপি তুলে দিচ্ছেন অধীর চৌধুরী। সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদরা। ছবি: পিটিআই।
মণিপুর নিয়ে সোমবার সংসদে নতুন উদ্যমে মোদী সরকারকে আক্রমণ শানাতে পারেন বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদরা। উত্তর পূর্বের রাজ্যে অশান্তি নিয়ে বিরোধীদের হট্টগোলে প্রথম দিন থেকেই অচল সংসদের বাদল অধিবেশন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতির দাবিতে অনড় বিরোধীরা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাবও এনেছে তারা। এই আবহে শনিবার দু’দিনের সফরে হিংসাদীর্ণ রাজ্যে যান বিরোধী জোটের ২১ জন সাংসদ। ঘুরে দেখেন হিংসা কবলিত এলাকা। কথা বলেন সে রাজ্যের বাসিন্দাদের সঙ্গে। রবিবার সকালে মণিপুরের রাজ্যপাল অনসূয়া উইকের সঙ্গে দেখা করে তাঁর হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন বিরোধী সাংসদরা। শনি এবং রবিবার সংসদ ছুটি ছিল। এই সময়ই মণিপুর ঘুরে দেখলেন মোদী বিরোধী জোটের প্রতিনিধিরা। সোমবার আবার বসবে সংসদের অধিবেশন। সপ্তাহের প্রথম দিনে মণিপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঝাঁজ আরও বাড়াতে পারে বিরোধীরা। যে মণিপুর নিয়ে সরব বিরোধীরা, সেই মণিপুর থেকেই ঘুরে এসে সোমবার সংসদে যাবেন বিরোধী দলের সাংসদরা। তাই চোখে দেখা অশান্ত এলাকার কথা তুলে ধরে নতুন কৌশলে বিজেপিকে বিঁধতে পারেন তাঁরা। আবার, বিরোধীদের আক্রমণ-বাণকে সামলাতে কৌশলী হতে পারে শাসক শিবিরও। ফলে আবার তপ্ত হতে পারে সংসদের দুই কক্ষ।
রবিবার ছিল বিরোধী জোটের মণিপুর সফরের শেষ দিন। রবিবার সকালে মণিপুরের রাজ্যপালকে স্মারকলিপি দেন ২১ জন বিরোধী সাংসদ। স্মারকলিপিতে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, ‘‘গত কয়েক দিন ধরে লাগাতার গুলি, অগ্নিসংযোগের ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও আক্রমণ করেছেন তাঁরা। স্মারকলিপিতে লিখেছেন, ‘‘মণিপুরের হিংসার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নীরব থেকে নিজের নির্লজ্জ উদাসীনতাকে প্রকাশ্যে এনেছেন।’’ মণিপুরে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনা নতুন করে শোরগোল ফেলে দিয়েছে। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই মুখ খোলেন মোদী। ৭৮ দিন মৌনী থাকার পর বলেছিলেন, ‘‘এই ঘটনা যে কোনও সভ্য সমাজের লজ্জা।’’ তবে মণিপুরের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সরব বিরোধীরা। এই নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই অচল সংসদের বাদল অধিবেশন। মণিপুরে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। শনিবারই তদন্তভার হাতে তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
সফরের দ্বিতীয় দিন
মণিপুর সফরের দ্বিতীয় দিন, রবিবার সকালে রাজ্যপাল অনসূয়া উইকের সঙ্গে দেখা করেন ‘ইন্ডিয়া’র ২১ জন সাংসদ। রাজ্যপালের হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন তাঁরা। সংবাদমাধ্যমের সামনে মণিপুরের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা জানিয়ে কেন্দ্রের কাছে সংসদে তাঁদের তরফে পেশ করা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে দ্রুত আলোচনার দাবি জানিয়েছেন বিরোধী সাংসদেরা। রাজভবন থেকে বেরিয়ে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী বলেন, “২১ জন সাংসদ আলাদা ভাবে স্মারকলিপি তুলে দিয়েছেন রাজ্যপালের হাতে। দু’দিনের সফরে সারা রাজ্যে ঘুরে আমরা যা দেখেছি, যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তার সব কিছু রাজ্যপালকে জানিয়েছি। উনি আমাদের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন।” এই প্রসঙ্গে অধীর জানান, রাজ্যপাল তাঁদের সব দলকে নিয়ে একটি প্রতিনিধি দল গড়ে মণিপুরে আসার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সঙ্কট কাটাতে রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। সফরের শেষ দিনে রবিবার সন্ধ্যায় টুইটারে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘মণিপুরের হৃদয় বিদারক কাহিনি শুনে আমার হৃদয় ব্যথিত। মনুষ্য জীবনে ঘৃণার নির্মম অভিজ্ঞতার যন্ত্রণা সহ্য করা কখনওই উচিত নয়।’’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘ক্ষত সারিয়ে মানবতার শিখা জ্বালাবে ‘ইন্ডিয়া’।’’
সফরের প্রথম দিন
২৯ জুলাই, শনিবার বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র ২১ জন সাংসদ মণিপুরে যান। দলে ছিলেন তৃণমূলের সুস্মিতা দেব, ডিএমকের কানিমোঝি, সিপিএমের এএ রহিম, জেডিইউয়ের লালন সিংহ, আরজেডির মনোজ ঝা, জাভেদ আলি খান, শিবসেনার (বালাসাহেব) অরবিন্দ সাওয়ন্ত, আম আদমি পার্টির সুশীল গুপ্ত, সিপিআইয়ের পি সন্তোষ কুমার, আইইউএমএলের ইটি মহম্মদ বশির, আরএলডির জয়ন্ত চৌধুরী, ভিসিকের থল তিরুমালব্যনের মতো বিরোধী জোটের সাংসদেরা। প্রথমে চূড়াচাঁদপুরে যান তাঁরা। ঘুরে দেখেন কুকিদের দু’টি ত্রাণ শিবির। এর পরে মইরাংয়ে মেইতেইদের শিবির ঘুরে দেখেন তাঁরা। কথা বলেন বাসিন্দাদের সঙ্গে। কুকিদের যৌথ মঞ্চ আইটিএলএফ ইন্ডি।য়া কাছে স্মারকপত্র দেয়। তাঁরা দাবি করেন, সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই কুকি, পাজ্য থেকে কুকিদের মুছে উফেলতে তাইছেন মেইতেইরা, তারা জানায়, এত রক্তপাত, আতঙ্ক অবিশ্বাসের পর এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। তাই শান্তি ফেরাতে হলে রাজনৈতিক ভাবে আমাদের আলাদা করতেই হবে। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে।
বিজেপি বনাম ‘ইন্ডিয়া’
লোকসভা নির্বাচনের আগে হিংসাদীর্ণ মণিপুর নিয়ে শাসক বনাম বিরোধী সংঘাতের সুর ক্রমশ চড়া হচ্ছে। মণিপুর নিয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে ‘ইন্ডিয়া’। এই আবহে বিরোধী জোটের মণিপুর সফর নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শনিবার লোকসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা অধীর বলেন, ‘‘মণিপুরের ঘটনায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’’ মণিপুরের বিপর্যয়ের জন্য বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকার দায়ী বলে আক্রমণ করেছেন তৃণমূলের সুস্মিতা। আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝা বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আমরা সেই চেষ্টা করছি, যা তাঁর এবং তাঁর দলের করা উচিত ছিল।’’ মণিপুর সফর নিয়ে বিরোধীদের পাল্টা আক্রমণ করেছে বিজেপি। শনিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেন, ‘‘বাংলার কংগ্রেস সাংসদ তথা লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী কি ওঁর জোট সঙ্গীদের পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যাবেন? যাঁরা মণিপুরে গেলেন, তাঁরা কি মালদহের নির্যাতিতার বাড়ি যাবেন? পঞ্চায়েত নির্বাচনে যাঁরা মারা গেলেন তাঁদের বাড়ি যাবেন?’’ মণিপুর সফরকে কটাক্ষ করে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সাংসদ তথা দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘‘এটা রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়া কিছুই নয়। ওদের (বিরোধী) পশ্চিমবঙ্গে আসা উচিত। মণিপুরে যা ঘটেছে, তা রাজনীতির ঊর্ধ্বে। সংসদে বসে আলোচনা করা উচিত বিরোধীদের।’’
অশান্ত মণিপুর
গত ৩ মে ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’ (এটিএসইউএম)-এর কর্মসূচি ঘিরে অশান্তির সূত্রপাত হয় মণিপুরে। সে দিন রাত থেকেই বিভিন্ন এলাকায় জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত কুকিদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের সংঘর্ষ শুরু হয়। দু’সম্প্রদায়েরই বহু মহিলা নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ। রাজ্যে হিংসার মধ্যেই দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে যায় সমাজমাধ্যমে। যদিও ভিডিয়োটির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। গত ৪ মে কঙ্গপকপি জেলায় দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো হয় বলে অভিযোগ। তাঁদের একটি মাঠে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয় বলেও দাবি। অভিযোগ, এই ঘটনায় অনেক আগেই থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু এত দিন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। ২৬ সেকেন্ডের ভিডিয়োটি প্রকাশ্যে আসার পরেই দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। মণিপুরের ঘটনার নিন্দায় সরব হয় নানা মহল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy