Advertisement
১৮ জুন ২০২৪

বিচার বিভাগের সঙ্গে লড়াইয়ে বাকিদের পাশে চাইছে বিজেপি

শীর্ষ আদালতের সঙ্গে সংঘাতে এ বার অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে পাশে টানার চিন্তাভাবনা শুরু করল নরেন্দ্র মোদী সরকার। যদিও তাতে সাফল্য কতটা মিলবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সরকারের অন্দরেই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৬ ০৪:১৭
Share: Save:

শীর্ষ আদালতের সঙ্গে সংঘাতে এ বার অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে পাশে টানার চিন্তাভাবনা শুরু করল নরেন্দ্র মোদী সরকার। যদিও তাতে সাফল্য কতটা মিলবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সরকারের অন্দরেই।

এক দিকে বিচারপতি নিয়োগের নতুন প্রক্রিয়া নিয়ে শীর্ষ আদালতের সঙ্গে মোদী সরকারের মতভেদ মিটছে না। অন্য দিকে নিয়োগের জন্য নাম পাঠানো সত্ত্বেও মোদী সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না বলে তোপ দেগেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর স্বয়ং। গোটা সরকারকে চমকে দিয়ে, সোমবার স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর লালকেল্লার বক্তৃতার কিছু পরেই এক অনুষ্ঠানে ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন মোদীর দেড় ঘণ্টার বক্তৃতায় একবারও বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্ন এল না?

সুপ্রিম কোর্ট বনাম মোদী সরকারের এই সংঘাতে আদালতের পাশেই দাঁড়াচ্ছে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি। কংগ্রেসের কপিল সিব্বলের অভিযোগ, ‘‘মোদী সরকার চায় বিচারপতিরা তাদের মুঠোবন্দি হয়ে থাকুন! মোদীর উচিত প্রধান বিচারপতির পরামর্শ শোনা।’’ জেডি (ইউ) নেতা শরদ যাদবের কথায়, ‘‘প্রধান বিচারপতির কথা থেকেই স্পষ্ট, সমস্যা গভীর। সরকারের সঙ্গে বিচারপতিদের সম্পর্ক ভাল নয়।’’ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে বেশ কিছু দিন ধরে টানাপড়েন চলছে দিল্লির আপ-সরকারের। এই সুযোগে মোদী সরকারকে এক হাত নিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের অভিযোগ, বিচারপতি নিয়োগ না করে বিচারব্যবস্থাকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। মোদী সরকার বিপাকে পড়েছে দেখে অন্য দলগুলিও মজা দেখছে।

কংগ্রেস নেতাদের প্রশ্ন, নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া বা ‘মেমোরান্ডাম অব প্রসিডিওর’ নিয়ে মতভেদ চললেও নতুন নিয়োগ কেন আটকে রাখা হয়েছে? সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম যে সব নিয়োগের জন্য ছয় মাস আগে সুপারিশ করেছিল, সেগুলো নিয়ে কেন এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি? এর ফলে হাইকোর্টগুলিতে অর্ধেক বিচারপতির পদ খালি।

এমন একটা পরিস্থিতিতে বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য, জিএসটি-র মতো এটা নিয়েও সব দলের সঙ্গে ঐকমত্য গড়ে তোলা দরকার। বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শেষ কথা কে বলবে, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ বিচারপতিদের কলেজিয়ামের সঙ্গে টানাপড়েন চলছে মোদী সরকারের। দুই শিবিরই নিজের হাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখতে চায়। বিজেপির এই নেতাদের মত, এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল এক সুরে কথা বলছে দেখলে বিচারবিভাগের উপরে চাপ তৈরি হবে। কারণ দু’বছর আগে যখন মোদী সরকার জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠনের আইন তৈরি করে, তখন কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল-সহ সব দলই সমর্থন করেছিল। বিচারপতিরাই বিচারপতি নিয়োগ করবেন, এমন প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষেই সায় দেন সকলে।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা নিয়ে বিচারপতি ঠাকুরের প্রশ্ন তোলার সমালোচনা করেছেন অনেকেই। প্রবীণ আইনজীবী আর্যমা সুন্দরম, প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব টিএসআর সুব্রহ্মণ্যমের মতো অনেকেরই মত, বিচারবিভাগের সঙ্গে সরকারের মতভেদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেনই বা লালকেল্লা থেকে মুখ খুলবেন? প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু আক্রমণাত্মক হয়ে বলেছেন, ঠাকুর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন! বিজেপির অনেক নেতা বলছেন, এই ধরনের বিরোধী মতকে একজোট করার পাশাপাশি দরকার রাজনৈতিক দলগুলিকেও পাশে পাওয়া।

কিন্তু সে কাজ আদৌ সম্ভব হবে কি না, হলেও তাতে কতখানি কাজ হবে, তা নিয়ে মোদী সরকারের অন্দরেই বিস্তর প্রশ্ন। কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর মোদী সরকারের কাজকর্মে চূড়ান্ত ক্ষুব্ধ। গত কালই তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, স্পষ্ট কথা বলতে দ্বিধা করবেন না। আগামী জানুয়ারিতে অবসর নেবেন ঠাকুর। তার পরে সরকারের থেকে কোনও পদ যে তিনি আশা করেন না, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশের প্রধান বিচারপতি। দ্বিতীয়ত, দু’বছর আগে মোদী সরকার যখন জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন করেছিল, তখনকার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির ফারাক বিপুল। তখন মোদী সরকার সদ্য বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে। দু’বছর পরে সেই মোদী সরকারই বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে আঘাত করছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে লড়াইয়ে বাকি দলগুলি কতটা পাশে দাঁড়াবে, তা নিয়ে সরকারের অন্দরেই ঘোর সংশয়।

২০১৪-র অগস্টে লোকসভা ও রাজ্যসভায় জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন আইন পাশ হয়। ওই বিলে সমর্থন নিয়ে কংগ্রেস প্রথমে দ্বিধায় ছিল। কারণ ইউপিএ-সরকার সংসদে শেষ বেলায় এই বিল পেশ করলেও বিজেপি তখন সমর্থন করেনি। ইউপিএ-র বিলে বদল করে বিচারপতি নিয়োগ কমিশনের সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে আপত্তি তুলেছিলেন কপিল সিব্বল-অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিরা। তাঁরা সতর্ক করেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে এই বিল প্রশ্নের মুখে পড়বে। বাকি সব দল সমর্থন করায় কংগ্রেসও তখন চাপের মুখে সমর্থন করতে বাধ্য হয়।

২০১৫-র অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি নিয়োগ কমিশনকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেওয়ার পরে কংগ্রেস আর সরকারের পাশে দাঁড়ায়নি। তত দিনে অসহিষ্ণুতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। দাদরিতে গোমাংস রাখার অভিযোগে খুন, সাহিত্য অকাদেমির সম্মান ফেরানো-পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। সে সময় কংগ্রেস মোদী সরকারকেই কাঠগড়ায় তুলেছিল। আনন্দ শর্মার কথায়, ‘‘মোদী সরকার বিচারবিভাগের অধিকারে নাক গলাতে গিয়েছিল। এই সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে নিশানা করছে বলে ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন তারই ফল মিলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

PM Modi TS Thakur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE