রেল বাজেটে সই করছেন সুরেশ প্রভু। বুধবার। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়াহা।
ক্ষয়িষ্ণু রেলের চাকায় কি আবার ফিরবে সেই পুরনো গতি? সেই প্রশ্নের উত্তর দিতেই বৃহস্পতিবার আসরে নামছেন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু।
ইউপিএ সরকারের ‘নীতিপঙ্গুত্বের’ রাস্তা থেকে সরে এসে নতুন সরকার একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগের ভাঁড়ার সেই শূন্য। ফলে আরও স্বাস্থ্য ভেঙেছে রেলের। এই পরিস্থিতিতে কাল প্রথম পূর্ণাঙ্গ রেল বাজেট পেশ করতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী সরকার। মুমূর্ষু রেলে প্রাণসঞ্চারে দাওয়াই বাতলাতে তৈরি হচ্ছেন রেলমন্ত্রী প্রভু।
শরিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতা ক্রমশ রক্ত শুষে নিয়েছে রেলের। গত এক দশকে যখন ক্রমশ শীর্ণ হয়েছে রেল, নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা তুলছেন একের পর এক রেলমন্ত্রী। এখন সামনে কোনও নির্বাচন নেই। তাই গোটা বাজেটে জনমোহিনী রাস্তা ছেড়ে সংস্কার, বেসরকারি বিনিয়োগ টেনে আনার জন্য সদর্থক নীতিগ্রহণ ও পরিষেবা ক্ষেত্রের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেল মন্ত্রকের কর্তারা। কার্যত আইসিইউ-এ চলে যাওয়া রেলকে কী ভাবে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব, সেই পরীক্ষাতেই বসতে চলেছেন প্রভু, বকলমে নরেন্দ্র মোদীও।
প্রধানমন্ত্রী এক সময়ে স্টেশনে চা বিক্রি করতেন। রেল কর্তাদের মতে, তাই হয়তো প্রথম থেকেই রেলের কাজকর্মে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। মন্ত্রক সূত্র বলছে, রেল বাজেটে মোদীর ছাপ স্পষ্ট। শয়ে শয়ে নতুন ট্রেন, ডজন-ডজন নতুন লাইন, আদর্শ স্টেশন, রেল কারখানা নির্মাণ এ সব সরিয়ে রেখে জোর দেওয়া হয়েছে পরিকাঠামো উন্নতির উপর। এবং সেখানে কী ভাবে আরও বেসরকারি সংস্থাকে টেনে আনা যায়, তার দিশা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
বর্তমানে রেলের জমে থাকা প্রকল্পগুলি শেষ করতেই প্রয়োজন ৬-৮ লক্ষ কোটি টাকা। তাই প্রাথমিক ভাবে ৬৭৬টি প্রকল্পকে পাখির চোখ করেছে রেল। তারও মধ্যে গুরুত্বের বিচারে ৩১৭টি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যা শেষ করার জন্য প্রয়োজন ১.৮০ লক্ষ কোটি টাকা। কোথা থেকে আসবে সেই টাকা?
বর্তমানে রেলের অপারেটিং রেশিও ৯০-৯২-র কাছাকাছি (রেলকে এক টাকা আয় করতে খরচ হয় ৯০-৯২ পয়সা)। বৃহত্তম সরকারি সংগঠনের পক্ষে যে খরচ কমিয়ে আয় বাড়ানো কার্যত অসম্ভব, তা বিলক্ষণ বোঝেন রেল কর্তারা। একমাত্র উপায় আয় বাড়ানো। কেন্দ্রীয় সাহায্য ছাড়াও আয়ের বড় উৎস যাত্রী ও পণ্য ভাড়া থেকে রোজগার। চলতি বাজেটে কেন্দ্রের কাছে ৫০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সাহায্যের দরবার করেছে রেল। গত বার যার পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। কতটা সাহায্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি করতে পারেন, সেটাই এখন দেখার।
আয়ের অন্য উৎস হল ভাড়া। যদিও ছয় মাস আগে প্রায় ১৪% যাত্রিভাড়া বাড়িয়ে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে ব্যর্থ রেল। উল্টে যাত্রী কমেছে। পণ্য ভাড়া বাড়াতে ছোঁয়া যায়নি পণ্য পরিবহণের লক্ষ্যও। উপরন্তু গত দশ বছরে রেলে পণ্য পরিষেবা কমেছে প্রায় ৩০%। ফলে বাড়তি অর্থের খোঁজে বেসরকারি বিনিয়োগ ও অপ্রচলিত সূত্রের আয়ের ওপরই ভরসা করতে চাইছে মন্ত্রক। সে কারণে চলতি বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে অন্তত ৫০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা ঘরে তুলতে চাইছে রেল। এই লক্ষ্য পূরণে বেসরকারি সংস্থাগুলির জন্য বিশেষ ছাড় ও ট্যাক্স হলিডে ঘোষণাও কাল করতে পারেন প্রভু। এ ছাড়া বিজ্ঞাপন খাতে (স্টেশন, কোচ, কামরা, মায় খাবারের প্লেট) বড় রকমের টাকা আসতে পারে ধরে নিয়ে বিজ্ঞাপনী নীতি ঘোষণা করতে পারেন প্রভু। আয় বাড়াতে আরও বেশি করে প্রিমিয়াম ট্রেন, প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে মন্ত্রক। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশ বান্ধব উদ্যোগ, যাত্রী সুরক্ষা খাতেও নজর দিতে চাইছে সুরেশ প্রভুর মন্ত্রক।
• পরিকাঠামো: মন্ত্রকের বক্তব্য, গত এক দশকে অন্তত দু’ডজন রেল কারখানার ঘোষণা করা হয়েছে। যেগুলি বাস্তবায়িত হলে অন্তত আগামী ২৫ বছর রেলের ওয়াগন, চাকা, ইঞ্জিন, কামরার চাহিদা মিটে যাবে। কিন্তু সমস্যা হল এদের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) বা যৌথ উদ্যোগে (জয়েন্ট ভেঞ্চার) হওয়ার কথা। মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই বিমা, প্রতিরক্ষার মতো রেলেও ১০০% বিদেশি লগ্নির রাস্তা খুলে দেয়। কিন্তু সমস্যা তাতে বিশেষ কিছু মেটেনি। সেই কারণে বিনিয়োগ টানতে বেসরকারি সংস্থার জন্য বিশেষ কর ছাড়ের সুযোগ দিতে চায় কেন্দ্র। কারখানাগুলি ছাড়াও, আদর্শ ও বিশ্বমানের স্টেশন নির্মাণের বিনিময়ে বেসরকারি সংস্থাকে স্টেশনের জমি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিতে চাইছে কেন্দ্র।
• রাজ্যের সাহায্য: ভাঁড়ারে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায়, বিভিন্ন রাজ্য ভিত্তিক প্রকল্পগুলি (ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস, রেল কারখানা-স্টেশন নির্মাণ) শেষ করতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সাহায্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল। যে রাজ্য অর্থ ও জমি দিয়ে সাহায্য করবে রেল সেই প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেবে।
• যাত্রিভাড়া: আর্থিক ভাবে দীর্ণ রেল মন্ত্রকের কাছে আশার খবর একটিই, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা তেলের দাম কমেছে। যার ফলে শেষ তিন মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছে রেল। ফলে এখনই ভাড়া বাড়ার মতো সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করাও বেশ কঠিন। তা ছাড়া গত জুন মাসে রেলের সব শ্রেণিতে প্রায় ১৪ শতাংশ যাত্রিভাড়া বেড়েছিল। যার ধাক্কায় রেল ভাড়া এক ধাপে অনেকটাই বেড়ে যায়। রেলের একটি অংশ এখনও যাত্রিভাড়া বাড়ানোর পক্ষে। ওই অংশের যুক্তি, বর্তমানে যাত্রিভাড়া ও পণ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকা ক্রস সাবসিডি দেয় রেল। বিরোধী অংশের যুক্তি, গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেকটা কমেছে। ফলে যাত্রীদের সুরাহা দিতে ভাড়া কমানো উচিত রেলের। কিন্তু পাল্টা যুক্তিতে বলা হয়েছে, তেলের দাম কমলেও বিদ্যুতের খরচ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই আপাতত রেলের ভাড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ রদবদল করতে চাইছে না মন্ত্রক।
• আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার: ইতিমধ্যেই নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু স্টেশনে ওয়াই-ফাই পরিষেবা শুরু হয়েছে। এ বার দেশের আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে ওই প্রযুক্তি চালু করার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে রেল। এ ছাড়া পরিশুদ্ধ পানীয় জল, যাত্রীদের জন্য এলিভেটর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন কোচগুলিতে বায়ো টয়লেট বসানো ছাড়াও, পুরনো কোচগুলিতে ভ্যাকুয়াম টয়লেট বসানোর সিদ্ধান্ত।
• সুরক্ষা: জেটলির জন্য এই খাতে কুড়ি হাজার কোটি টাকার দাবি জানায় রেল। জেটলি যদি রাজি হন তবে সেফ্টি সারচার্জ বসিয়ে ওই ধারের টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে তোলা হবে। তখন অবশ্য যাত্রিভাড়া বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
সরকারে আসার আগেই দেশবাসীকে বুলেট ট্রেন, হাই স্পিড ট্রেনের স্বপ্ন দেখান মোদী। তাই রয়েছে প্রত্যাশা পূরণের চাপ। সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ কী করতে পারবেন সুরেশ প্রভু, সেটাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy