Advertisement
২৪ মে ২০২৪
National News

বাবা-মাকে ওখানে পুঁতেছি! মাটি খুঁড়তেই বেরোল খুলি, হাড়গোড়, গয়না, পোশাক

আকাঙ্ক্ষার হত্যাকারী প্রেমিক উদয়ন দাসের কবুল করা অপরাধের সূত্র ধরেই এ বার মিলল তার বাবা-মার হাড়গোড়। আজ সকালে ভোপাল আর বাঁকুড়া পুলিশের দল উদয়নকে নিয়ে ভোপাল থেকে রায়পুর রওনা হয়। বছর কয়েক আগে রায়পুরের যে বাড়িতে তারা থাকত, বাবা-মাকে খুন করে সেই বাড়ির বাগানেই দেহ পুতে দিয়েছিল বলে স্বীকার করেছিল উদয়ন।

কোথায় পোঁতা আছে দেহ, দেখাচ্ছেন উদয়ন। ছবি: রূপেশ যাদব।

কোথায় পোঁতা আছে দেহ, দেখাচ্ছেন উদয়ন। ছবি: রূপেশ যাদব।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৩:৪১
Share: Save:

আকাঙ্ক্ষার হত্যাকারী প্রেমিক উদয়ন দাসের কবুল করা অপরাধের সূত্র ধরেই এ বার মিলল তার বাবা-মার খুলি, হাড়গোড়। আজ সকালে ভোপাল আর বাঁকুড়া পুলিশের দল উদয়নকে নিয়ে ভোপাল থেকে রায়পুর রওনা হয়। বছর কয়েক আগে রায়পুরে সুন্দরনগরের যে বাড়িতে তারা থাকত, বাবা-মাকে খুন করে সেই বাড়ির বাগানেই দেহ পুতে দিয়েছিল বলে স্বীকার করেছিল উদয়ন। আজ বেলা ১১টা নাগাদ ওই বাগানে খোঁড়াখুড়ির কাজ শুরু হয়। প্রথমে গাঁইতি দিয়ে, পরে জেসিবি দিয়ে শুরু হয় খোঁড়াখুড়ি। উদয়ন নিজেই পুলিশকে দেখিয়ে দেয়, বাগানের কোথায় কোথায় সে পুঁতে দিয়েছিল বাবা, মার দেহ। ঘণ্টা দেড়েকের পরেই বেরোতে থাকে দুর্গন্ধ। তারপরেই উদ্ধার হতে শুরু করে হাড়গোড় এবং জামাকাপড়ের টুকরো। উদ্ধার হয়েছে দুটি খুলিও।

গোটা খোঁড়াখুড়ির পর্বে বেশ নির্লিপ্তই ছিল তিন-তিনটে খুনের পর দেহ লোপাটের নায়ক। দেখেশুনে দুঁদে পুলিশকর্তারাও রীতিমতো স্তম্ভিত। এত কাণ্ডের পর এমন ঠান্ডা মাথায় স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাওয়া উদয়নের মধ্যে গভীর অপরাধমনস্কতা রয়েছে বলে বলছেন মনোবিদেরাও। সুনির্দিষ্ট ভাবে এটাকে অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসর্ডার বলে মনে করছেন মনোচিকিত্সক জয়রঞ্জন রাম। অনেক ছোটবেলা থেকেই মানসিক বিকারের ফলে এ ধরনের অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।

আরও খবর: এটাকে বলে অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার

এখানেই কীর্তি থামেনি ঘাতক পুত্রের। জাল লাইফ সার্টিফিকেট বানিয়ে মার পেনশনও তুলে গেছে অনেক মাস ধরে। তার পর বাবা-মার ডেথ সার্টিফিকেট পর্যন্ত জোগার করে ফেলে। নিজেকে উত্তরাধিকার প্রমাণ করে মোটা টাকায় বেচে দেয় রায়পুরের বাড়ি।

আকাঙ্ক্ষাকে খুনের অভিযোগে ধরা পড়ার পরে প্রথমে উদয়ন বলেছিল, ২০১০-এ হৃদ্‌রোগে বাবা মারা গিয়েছেন রায়পুর হাসপাতালে। মা রয়েছেন আমেরিকায়। লাগাতার জেরার পরে তার স্বীকারোক্তি ছিল, বাবা-মায়ের দেহ পোঁতা রয়েছে ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরে আগে সে যে বাড়িতে থাকত, তার বাগানে! উদয়ন দাসের এহেন বয়ানে স্তম্ভিত হয়ে যান পুলিশের দুঁদে গোয়েন্দারাও।


রায়পুরের সেই বাড়ি।

বৃহস্পতিবার আকাঙ্ক্ষার দেহ উদ্ধারের পরেই তাঁর ‘প্রেমিক’ উদয়ন স্বীকার করেছিল খুনি সে-ই। রুটিনমাফিক তদন্তে তার পরিবার পরিজন সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করে স্থানীয় গোবিন্দ নগর থানার পুলিশ। জানতে চাওয়া হয় তার বাবা-মায়ের কথা। গোড়ায় উদয়ন বলে তার বাবা মারা গিয়েছেন, মা রয়েছেন আমেরিকায়। আমেরিকার কোথায়? প্রশ্ন করে পুলিশ। ফোন নম্বর কী? কিছুই ঠিকঠাক বলতে পারেনি উদয়ন। সন্দেহ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে জেরার চাপ। উদয়নের এক মাসিকে থানায় এনে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। শেষে চাপের মুখে ভেঙে পড়ে উদয়ন। কবুল করে ২০১০-’১১ সাল নাগাদ সে মা ইন্দ্রাণী দাস এবং বাবা ডিকে দাসকেও গলা টিপে খুন করে পুঁতে দিয়েছে রায়পুরের তার পুরনো বাড়ির বাগানে।

উদয়নের বয়ান অনুযায়ী, আকাঙ্ক্ষাকে মেরে একটি ট্রাঙ্কের ভিতর পুরে তার ভিতর ১৪ বস্তা সিমেন্ট গোলা ঢেলে দিয়েছিল সে। তার পর মেঝে খুঁড়ে ট্রাঙ্কটি পুঁতে তার উপর বেদি তৈরি করে। সেই বেদির উপরে ঠাকুর-দেবতার ছবি রেখে পুজো-আচ্চাও করতো।

বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও সে প্রায় একই কাজ করেছে বলে জানায় উদয়ন। সে বলেছে, বাবা-মাকে খুন করার পরে দেহ দু’টি রায়পুরের বাড়ির বাগানে পুঁতে দেয়। সেখানে মাঝেমধ্যে পুজো দিত।

প্রশ্ন উঠেছে, উদয়ন কি তবে ‘সিরিয়াল কিলার’? সে কি মানসিক রোগে আক্রান্ত? অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে আলফ্রেড হিচককের বিখ্যাত ছবি ‘সাইকো’-র কথা। যে ছবিতে মৃতা মায়ের সঙ্গে মানসিক ভাবে বাস করতেন ছেলে। ছবির শেষে একটি সেলারে মেলে পোশাক ও পরচুলা পরা মায়ের কঙ্কাল।

মনে পড়ছে কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটের পার্থ দে-র কথাও। দিদির মৃত্যুর পর তাঁর দেহ বাড়িতেই রেখে দিয়েছিলেন তিনি। তবে দিদিকে অবশ্য পার্থ খুন করেননি।

ভোপাল পুলিশেরও ধারণা উদয়ন মানসিক বিকারগ্রস্ত। তার কারণও রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ভোপালের সাকেত নগরের বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দিত না উদয়ন। বাড়ির যত্রতত্র নোংরা। বাড়িটিতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ কিছু ক্রাইম সিনেমার সিডি উদ্ধার করেছে। পুলিশের দাবি জেরায় উদয়নের স্বীকারোক্তি, ইংরেজি ধারাবাহিক ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ দেখেই সে আকাঙ্ক্ষাকে খুনের ছক কষে। সেই বাড়িতে একটি দড়িও পেয়েছে পুলিশ।

তাদের দাবি, উদয়ন জানিয়েছে, প্রথমে সে ঠিক করেছিল, আকাঙ্ক্ষাকে খুন করে ওই দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেবে। পরে সিদ্ধান্ত বদলে শ্বাসরোধ করে খুন করে।

পুলিশের আরও দাবি, গত তিন মাস জল খায়নি উদয়ন। শুধু বিয়ার আর মদ খেয়েছে। স্নানও করত না। গায়ের গন্ধ ঢাকতে ব্যবহার করত সুগন্ধী! বাইরে বেরোনোর সময় হিজাব পরতো। মন-চিকিৎসকদের মতে, মানসিক এই অসুখের সূত্রপাত সাধারণত হয় ছোটবেলাতেই। সময়মতো সমস্যা চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করা না গেলে তা জটিল আকার ধারণ করে। উদয়নের ক্ষেত্রে সম্ভবত তা-ই হয়েছিল।

কিন্তু আকাঙ্ক্ষা বোধহয় তাঁর ‘প্রেমিকের’ এই বিকৃতি বুঝতে পারেননি। কারণ, এখনও পর্যন্ত যা তথ্য সামনে এসেছে, তাতে আমেরিকা যাওয়ার নাম করে ফেসবুকে আলাপ হওয়া উদয়নের সঙ্গে থাকতে ভোপাল চলে এসেছিলেন তিনি। বাড়ির সঙ্গেও তেমন ভাবে যোগাযোগ রাখেননি। অন্তত যত দিন বেঁচেছিলেন।

পুলিশ সূত্র বলছে, আকাঙ্ক্ষাকে খুন করার পরে উদয়ন আকাঙ্ক্ষার মোবাইল থেকে ‘ভাল আছি’ মেসেজ পাঠিয়ে বোকা বানাচ্ছিল তাঁর বাবা-মাকে। তাঁরাও কেন এত দিন নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিলেন, সেই প্রশ্নও অবশ্য উঠেছে। শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বরে বাঁকুড়া থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন আকাঙ্ক্ষার বাবা শিবেন্দ্র শর্মা। তারই তদন্তে পুলিশ পৌঁছে যায় সাকেত নগরের উদয়নের বাড়িতে। জেরায় উদয়ন জানিয়েছে, পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন আকাঙ্ক্ষা। যা তার পছন্দ ছিল না। তাই আকাঙ্ক্ষাকে খুন করে।

আরও পড়ুন: রায়পুরের পুরনো বাড়িতে মেরে পুঁতেছি বাবা-মাকে, কবুল উদয়ন দাসের

কিন্তু বাবা-মাকে কেন খুন করল উদয়ন? পুলিশের দাবি, সম্পত্তির লোভে। তাই বাবা-মাকে খুনের পরেই রায়পুরের ওই বাড়ি বেচে দিয়ে ভোপালে চলে আসে সে। শুরু করে বিলাসবহুল জীবনযাপন।

মা আমেরিকায় আছেন বলে গোড়ায় দাবি করলেও পুলিশের একটি বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, খুনের পরে বাবার সঙ্গে মায়েরও জাল ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করেছিল উদয়ন। তাতে দু’জনই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উদয়নের কম্পিউটার ঘেঁটে এই তথ্য মিলেছে।

পুলিশি জেরায় উদয়ন আরও জানিয়েছে, দিল্লির ডিফেন্স কোলনি, রায়পুর এবং সাকেত নগরে তার ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখান থেকে সে যথাক্রমে ভাড়া বাবদ ১০ হাজার, ৭ হাজার এবং ৫ হাজার টাকা পেত। আগে উদয়ন বলেছিল, সে দিল্লির একটি আইটিআই কলেজ থেকে পাশ করেছে। কিন্তু পরে জানিয়েছে, সে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ। তবে তার সব তথ্যই খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কারণ ভোপালের এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘উদয়ন খুবই বুদ্ধিমান। লোককে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও মারাত্মক। ইংরেজিতে সড়গড় উদয়ন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিথ্যে বলে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE