Advertisement
০৭ মে ২০২৪

‘কেন এত কষ্ট করি যাতে কাগজ বেরোয়?’

খুনের হুমকির বিরাম ছিল না। হিন্দুত্ববাদীদের হিট লিস্ট-এ নিজেকে রেখেছিলেন চার নম্বরে। ঘাড়ে চেপেছে ঋণের বোঝা, মানহানির মামলা। তবু কলম থামেনি গৌরী লঙ্কেশের। স্বাতী ভট্টাচার্যখুনের হুমকির বিরাম ছিল না। হিন্দুত্ববাদীদের হিট লিস্ট-এ নিজেকে রেখেছিলেন চার নম্বরে। ঘাড়ে চেপেছে ঋণের বোঝা, মানহানির মামলা। তবু কলম থামেনি গৌরী লঙ্কেশের। স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:২৪
Share: Save:

যখন বছর দশেক বয়স গৌরীর, এক দিন বাবা-মা’কে টেনে নিয়ে গেল ইস্কুলে। রেস হবে, দেখবে, আমি ফার্স্ট হব। দৌড় শুরু না হতেই আছাড়, ওঠার আগেই রেস শেষ। যত না ব্যথা, তার চাইতে বেশি লজ্জা ঢাকতে চিৎকার করে কান্না। আর পাঁচটা মেয়ে যেমন করে।

চেয়েছিল ডাক্তার হতে। চান্স পেল না। জার্নালিজম নিয়ে ভর্তি হল কলেজে। বাবা পি লঙ্কেশ কন্নড় কাগজের সম্পাদক, নীতিনিষ্ঠ বামপন্থী, বড় কাগজের মোসায়েবির বিপরীতে তাঁর ‘লঙ্কেশ পত্রিকা।’ বিজ্ঞাপন নেন না, গ্রাহকের টাকায় কাগজ চলে। গৌরী কিন্তু বড় কোম্পানির ইংরেজি কাগজেই কাজ নিল। টাইমস অব ইন্ডিয়া, সানডে, ইটিভি। বেশি নাম, বেশি দায়িত্বের পরিচিত ট্র্যাকে বাঁধা তাঁর কেরিয়ার।

কলেজে পড়তে পড়তেই সম্বন্ধ এল দু’টো। প্রথম বার মেয়ে কোমর অবধি চুল কেটে করল ঘাড় অবধি। মামা রেগে দিলেন দুই থাপ্পড়, গৌরী নির্বিকার। বিয়ে তো বানচাল হল। দ্বিতীয় বার বাড়ির রঙচটা জামা পরে বসল পাত্রপক্ষের সামনে। তবু পাত্র বেচারি দু’বার চিঠি লিখেছিল, পাত্রী পাত্তা দেয়নি। তার তখন প্রেম চলছে কলেজ-সিনিয়র, হবু-সাংবাদিক চিদানন্দ রাজঘাটার সঙ্গে। বিয়ে হল পাঁচ বছর প্রেমের পর। তার পাঁচ বছরের মাথায় ডিভোর্স।

প্রায় দশ বছর পর, ২০১০-এ সাক্ষাৎকারে গৌরী বলছেন, ‘‘গত বছর থেকে আমার মধ্যে নিজেকে নিয়ে আর অশান্তি নেই। জানি, বাকি জীবন একাই কাটাব। কেরিয়ারে মন দিয়েছি।’’

পড়তে পড়তে ভয় হয়। নকশাল-মাওবাদীর ভয় নয়, সঙ্ঘ পরিবারের গুন্ডাদের ভয় নয়। ভয় হয় গৌরীকে। এত সাধারণ মেয়ে, দ্বিধাদ্বন্দ্বে দীর্ণ, একা-একার সংসারে বাস। কোথায় সে এত সাহস পেল? কী করে সে সঙ্ঘ পরিবারকে যুঝে গেল, ঋণের বোঝা বইল, আদালতে মামলা আর বাইরে খুনের হুমকির মোকাবিলা করল? শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের চাইতে কিসেই বা আলাদা গৌরী! পড়াশোনা ইংলিশ মিডিয়ামে, মাতৃভাষায় আগাগোড়াই নড়বড়ে, কলেজে কন্নড় পেপারে ব্যাক দু’বার। তাঁর প্রজন্মের কলেজ-পড়ুয়াদের মতো গৌরীও ছিলেন যুক্তিবাদী, জাতপাত-বিরোধী। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে, দলিত মহিলাদের অধিকারে বিশ্বাসী। কিন্তু ছাত্রজীবনে কোনও আন্দোলনে, রাজনৈতিক দলে ছিলেন না। ইংরেজি কাগজে তাঁর প্রথম দিকের লেখাতেও পরিচ্ছন্ন চিন্তা, তদন্তমনস্ক রিপোর্টারের ছাপ। আদর্শ-আনুগত্যের ইঙ্গিত নেই।

পি লঙ্কেশ মারা গেলেন হঠাৎ। বাবার কাগজ চালানোর কনফিডেন্স ছিল না গৌরীর। প্রকাশককে বলেছিলেন, কাগজ বন্ধ করে দিন। সে ভদ্রলোকই একটু জোর করলেন, ‘‘এক বার চেষ্টা করবে না?’’ পাঠকদেরও তাগাদা, কাগজ চলুক। শেষে ‘লঙ্কেশ পত্রিকা’-র মালিকানা পেলেন গৌরীর ভাই, সম্পাদক গৌরী। কন্নড়ে শব্দ খুঁজে পান না। কর্নাটকের সমাজ-রাজনীতির খুঁটিনাটি জানেন না। তবু দায়িত্ব নিলেন।

স্টিভেন স্পিলবার্গের তৈরি ‘দ্য পোস্ট’ ছবিটিতে ক্যাথরিন গ্র্যাহামের কাহিনিও খানিকটা তাই। ওয়াশিংটন পোস্ট তাঁর বাবার কাগজ, সম্পাদক ছিলেন স্বামী। স্বামীর মৃত্যুর পর দায়িত্ব নেন নিরুপায় ক্যাথরিন। ফিল্মে দেখা যাচ্ছে, প্রথমটা রীতিমত নার্ভাস তিনি। ব্যাঙ্কের কর্তাদের কী বলতে হবে, মহড়া দিয়ে গিয়েও মিটিং-এ মুখ খুলতে পারেন না। ডাকসাইটে সম্পাদকের সামনে আমতা আমতা করেন মালিক হয়েও।

সেই মহিলাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনের হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে ভিয়েতনামের যুদ্ধ সম্পর্কে গোপন সরকারি তথ্য বের করলেন খবরে। কাগজ উঠে যেতে পারে, জেলে যেতে হতে পারে, তা জেনেও। এ যেমন সেরা সাংবাদিকতার গল্প, তেমনই সাধারণ এক মহিলার অসাধারণ সাহস খুঁজে পাওয়ার গল্প।

গৌরী তাঁর সাহস পেলেন কোথা থেকে? তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, বাবার থেকে। যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ পিতা-কন্যার খোলস ছিল না, ছিল বুকের পাঁজর। গৌরী আর চিদানন্দ রেজিস্ট্রারের অফিসে দিন ঠিক করে বাড়িতে খবর দেন। গৌরীর ঘোষণা, আমার বিয়ে হবে পনেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সায়। মা ইন্দিরা বিচলিত, লঙ্কেশ গর্বিত। বাপ কা বেটি। পি লঙ্কেশ যখন মারা যান, আত্মীয়দের সঙ্গে ঝগড়া করে গৌরী মৃতদেহের কপালে লাগানো বিভূতি মুছে দেন, গলা থেকে লিঙ্গম খুলতে বাধ্য করেন। বাবা জীবনে প্রথাগত হিন্দুধর্ম মানেননি। মৃত্যুতে কেন জাতপাত স্পর্শ করবে তাঁকে? গৌরী সমাধিতে দেন বাবার কাগজ-কলম, সিগারেট-দেশলাই, স্কচের বোতল, তাসের প্যাকেট, ঘোড়ার রেসের বই, নভেল।

পড়তে পড়তে মনে হয়, পিতার অন্ত্যেষ্টি থেকেই হয়তো গৌরীরও মৃত্যুর দিন গোনা শুরু। সম্পাদক কাগজ তৈরি করে, কাগজও সম্পাদক তৈরি করে। পি লঙ্কেশের কাগজ ছিল চাঁছাছোলা। ‘একটি সম্প্রদায়’ কিংবা ‘ঘটনায় অভিযুক্ত এক ব্যক্তি’ গোছের আড়ালের বালাই ছিল না। কোন সম্প্রদায়, কোন ব্যক্তি অভিযুক্ত তা জানার অধিকার পাঠকদের আছে, মনে করতেন পি লঙ্কেশ। বড় নেতাদের ‘নিকনেম’ দিতেন, ব্যঙ্গ করতে দ্বিধা করতেন না। গৌরীও তাঁর পথ নিলেন। কোদালকে কোদাল তো বলতেনই (একটা সম্পাদকীয়ের শিরোনাম ‘তুঘলক মোদী’), বড় কাগজ যে সব বিষয় এড়িয়ে চলত তা নিয়ে স্বচ্ছন্দে লিখতেন। কেন লক্ষ্মী মিত্তলের কারখানার জন্য জমি দখলের বিরোধিতা করায় জেলে যাবে আদিবাসী মেয়ে, কেন মলবাহী ভাঙ্গিদের স্থায়ী চাকরি দেবে বলেও বিজেপি সরকার ধোঁকা দেবে?

দত্তাত্রেয় বাবাবুদান দরগা, বজরঙ্গ দল কবজা করতে চাইল। গৌরী লিখছেন, হায়দর আলি, টিপু সুলতানের মতো মুসলিম শাসক, মাইসোরের রাজার মতো হিন্দু শাসকেরা যাকে সমান মর্যাদা দিয়েছে, সেখানে আজ গেরুয়া ব্রিগেড হোম, যজ্ঞের মতো অর্থহীন কাজ করতে চায়। ‘মিনিংলেস রিচুয়ালস’, লিখছেন গৌরী।

কিন্তু তত দিনে বদলে গিয়েছে সময়টা। আশি-নব্বইয়ের দশকে নেতারা যা মানতেন, মোদী-জমানায় বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবার তা মানবে নাকি? গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকার কপি পুড়েছে, গ্রেফতারের দাবি উঠেছে। কত লেবেল সাঁটা হয়েছে গৌরীর গায়ে, ‘মাওবাদী’, ‘হিন্দু-বিরোধী’, ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল।’ গৌরীর ভাই চাপে পড়ে বার করে দিলেন দিদিকে। গৌরী শুরু করলেন ‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকা।’ বারো বছর চালিয়েছেন।

তিনটে বুলেট গৌরীর সঙ্গে দেশের অধিকাংশ মানুষের পরিচয় করিয়েছে। তাঁর সাংবাদিকতা, বিশেষত কন্নড় ভাষায় তাঁর লেখা সম্পর্কে সামান্যই জানা আছে। গৌরী কেমন ছিলেন, তা নিয়ে ধন্দ আছে অনেকের (আফটার অল, নকশালদের সঙ্গে কথা বলতেন মহিলা)। সম্প্রতি গৌরীর ইংরেজি প্রতিবেদন, কন্নড় লেখার ইংরেজি অনুবাদ, তাঁর সাক্ষাৎকার, তাঁর সম্পর্কে নানা জনের লেখা নিয়ে বের হয়েছে একটি সংকলন দ্য ওয়ে আই সি ইট: আ গৌরী লঙ্কেশ রিডার। পড়লে বোঝা যায়, বামপন্থী মুখপত্রের কলমচিদের থেকে কত আলাদা গৌরী। নীতিবাগীশের গাম্বাটপনা নেই, সব কথায় বাঁধা বুলি কপচানো নেই। যখন মোদী বা মিত্তলকে আক্রমণ করছেন, তা করেছেন অন্যের প্রতি তাচ্ছিল্যের জন্য। আদিবাসী, দলিত, মুসলিম, বনবাসী, বস্তিবাসীর মুখ, তাঁদের মুখের কথা, গৌরী তুলে আনছেন। উন্নয়নের বিতর্কে তাঁদের রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে পেশ করছেন।

‘অ্যাক্টিভিজম’-এর সঙ্গে ‘জার্নালিজম’-এর কেমিস্ট্রিটা ঠিক কেমন, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। গৌরীর লেখা পড়লে বোঝা যায়, তাঁর আন্দোলনের কার্যক্রম যা-ই হোক, সাংবাদিকের কাজে তিনি বোঝাপড়া করেননি। প্রান্তবাসী, কণ্ঠহীন, ক্ষমতাহীন মানুষের কথা শোনা তো সাংবাদিকেরই কাজ।

তাঁর বন্ধুরা বলেন, একটু ইমপ্র্যাকটিক্যাল ছিলেন গৌরী। কাগজ বিপণনের কৌশল তেমন জানতেন না, সে দিকে ঝোঁকও ছিল না। ধার করে পর পর বই বার করেছেন, কাগজ ছেপেছেন। মাথায় চেপেছে একের পর এক মানহানির মামলা। ‘কেন আমি আমার শরীরকে এমন শাস্তি দিই?’ কাগজের দশ বছর পূর্তিতে সম্পাদকীয় লিখছেন গৌরী। ‘কেন এখনও চেষ্টা চালাচ্ছি কয়েক লক্ষ টাকা শোধ করার? বন্ধুদের সঙ্গে তিক্ত কলহের পর যখন কাঁদি, শরীর ভেঙে পড়তে চায়, তখন ভাবি, কেন এত কষ্ট করি যাতে প্রতি সপ্তাহে কাগজ বেরোয়?’

তিনি পেন্টাগন পেপার্স ছাপতে কেন রাজি হলেন, সে প্রশ্নের উত্তরে ক্যাথরিন গ্র্যাহাম আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এটা একটা জাতীয় সংবাদপত্রের কর্তব্য, তার দায়। না হলে ভিয়েতনামের যুদ্ধ সম্পর্কে আমেরিকার মানুষ তাঁদের মতামত তৈরি করতে পারবেন না।’ গৌরীও লিখছেন, ‘যা বললে ঠিক হয় তা হল এই, আমরা আমাদের দেশের মানুষের প্রতি দায় পূরণের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।’

যে কোনও দেশে, যে কোনও শতাব্দীতে, যে কোনও ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে এক জন সাংবাদিকের এই হল শেষ কথা। প্রশ্ন করো, উত্তর খোঁজো, যা সত্য তা লেখো। আর কী-ই বা করার আছে তার? গত এক বছরে যে চুয়াল্লিশ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে বিশ্ব জুড়ে, তারা প্রত্যেকেই সাধারণ মানুষ, কেবল নিজের কাজটা করছিল। এ বছর তাদের যখন জন্মদিন আসবে— গৌরীর জন্মদিন এই প্রজাতন্ত্র দিবসের তিন দিন পরেই— ২৯ জানুয়ারি, ফুল তাদের হাতে তুলে না দিয়ে দিতে হবে ছবিতে, এই যা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE