Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

মনের ঝড় সামলে বাবলিকে বললাম, আমিই সেই সিদ্ধার্থ

টিভি দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েছিল হৃদস্পন্দন। শিনা বরা!! এ তো তাঁরই মেয়ে! সিদ্ধার্থ দাস আর ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের প্রথম সন্তান। সেই শিনা নেই! ২৬ অগস্ট, গত বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম টিভিতে দেখতে পান সেই খবর। বিস্ফারিত হয়ে যায় চোখ! দেখেন সেই ইন্দ্রাণীই দাবি করেছেন, শিনা তাঁর মেয়ে নন, বোন! আনচান করে ওঠে ভিতরটা। এ তো ডাহা মিথ্যে! কাকে জানাবেন? পুলিশের কাছে যাবেন? কোথায়? লালবাজার? কিন্তু এ তো মুম্বই পুলিশের কেস?

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

টিভি দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েছিল হৃদস্পন্দন।
শিনা বরা!! এ তো তাঁরই মেয়ে! সিদ্ধার্থ দাস আর ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের প্রথম সন্তান।
সেই শিনা নেই! ২৬ অগস্ট, গত বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম টিভিতে দেখতে পান সেই খবর। বিস্ফারিত হয়ে যায় চোখ! দেখেন সেই ইন্দ্রাণীই দাবি করেছেন, শিনা তাঁর মেয়ে নন, বোন! আনচান করে ওঠে ভিতরটা। এ তো ডাহা মিথ্যে! কাকে জানাবেন? পুলিশের কাছে যাবেন? কোথায়? লালবাজার? কিন্তু এ তো মুম্বই পুলিশের কেস? বুকের ভিতরে শুরু হয় উথালপাথাল। রাতের দিকে আবার দেখেন, ইন্দ্রাণী স্বীকার করে নিয়েছেন শিনা তাঁর মেয়ে। খানিকটা শান্ত হল মন।
কিন্তু যন্ত্রণাটা চেপে বসল। কী এমন অপরাধ করল মেয়েটা? কেন এ ভাবে নিজের মা তাকে খুন করল? এখন তিনি কী করবেন? কার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন পাহাড়ের কোলে ফেলে রেখে আসা সেই অতীতের কথা?
চোখ চলে গিয়েছিল স্ত্রী বাবলির দিকে। এই অতীত জানাজানি হলে যদি অন্ধকার নেমে আসে বাবলির জীবনে? কী ভাবে গ্রহণ করবে বাবলি? তাঁর আর বাবলির ছেলে এখন বড়। সে-ই বা কী বলবে? নতুন করে কি কোনও ঝড় উঠবে সংসারে? প্রথম রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। মাঝে মাঝেই ঝুঁকে দেখেছেন স্ত্রী-র ঘুমন্ত মুখ। সকালে উঠে অন্য দিনের মতো বেরিয়ে গিয়েছিলেন প্রাতর্ভ্রমণে। স্নান, খাওয়া করে অফিসেও। কিন্তু ঝড় বইছিল মনের ভিতরে। খবরের কাগজের পাতা তত ক্ষণে উল্টে ফেলেছেন। একা একা গুমরোতে গুমরোতে ঠিক করলেন, সমস্ত ঘটনা খুলে বলবেন বাবলিকে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শক্ত করে নিলেন মন। স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘‘আমিই সিদ্ধার্থ দাস। যার কথা টিভিতে দেখাচ্ছে।’’ থম মেরে গিয়েছিল বাবলির মুখ। তবে সামলে নিতে বেশি সময় নেননি। পাল্টা বলেন, ‘‘তুমিই যে সিদ্ধার্থ দাস, সে কথা এখনও পুলিশ জানে না। এখানকার মিডিয়াও জানে না। তুমি নিজে থেকে কিছু করতে যেও না। অপেক্ষা করো। দ্যাখো, ঘটনা কোন দিকে গড়ায়।’’ অবাক বিস্ময়ে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলেছিলেন, ‘‘আর তুমি? তুমি কিছু বলবে না?’’ চোখে চোখ রেখে বাবলি বলেছিলেন, ‘‘আমি তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করেছি। ১৭ বছর ধরে আমরা সুখে সংসার করছি। ২৫ বছরের পুরনো অতীত নিয়ে আমি কেন বিচলিত হব?’’

মঙ্গলবার পড়ন্ত বিকেলে সিদ্ধার্থের মুখ থেকেই এই কাহিনি শুনল আনন্দবাজার। শিনার জন্মদাতা বাবা বললেন, ‘‘আমাকে লড়াই করার শক্তি বাবলিই দিয়েছে।’’ সে দিনের পর থেকে রাতে তিন-চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতে পারেননি। চোখ বন্ধ করলে বারবার ফিরে এসেছে মেয়ের মুখ। বললেন, ‘‘ইন্দ্রাণীকে আমি ভুলতে চেয়েছি। ভুলেও গিয়েছি। কিন্তু শিনা তো আমার মেয়ে। ছোট্ট মেয়েটা আমার কোলে ঘুরে বেড়িয়েছে। স্কুটারে করে আমাদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছে। আমরা বাজারহাট করতাম শিনাকে সঙ্গে নিয়েই। মন্দিরেও যেতাম।’’

তবে কেন ফিরে পেতে চাননি সেই মেয়ের অধিকার? মিখাইলই বা কী দোষ করল?

অতীতের ডালি খুলে বসেন সিদ্ধার্থ। ১৯৮৬-তে কলেজের পড়া শেষ করে গুয়াহাটিতে ইন্দ্রাণীর বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। শিনার বাবা-ই তাঁকে বেকারির ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করেন। ছোট একটা দোকান ছিল তাঁর। বিকেলের পরে ইন্দ্রাণীও মাঝেমধ্যে দোকানে গিয়ে বসতেন। এর মাঝেই ১৯৮৭-র ১১ ফেব্রুয়ারি শিনা-র জন্ম। পরের বছর ৯ সেপ্টেম্বর মিখাইল। নার্সিং‌হোমের নথিতে তাঁরই সই আছে, জানালেন সিদ্ধার্থ। গল্প করে বললেন, শিনার নাম ঠিক হয় সিনেমা দেখতে গিয়ে। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলেন ‘শিনা– কুইন অব দ্য জাঙ্গল।’ ফেরার পথে স্কুটারের পিছন সিট থেকে গলা জড়িয়ে ইন্দ্রাণী বলেছিলেন, ‘‘আচ্ছা, আমাদের যদি মেয়ে হয় তা হলে শিনা নাম রাখলে কেমন হয়? তোমার নামও তো এস দিয়ে শুরু।’’ আর মিখাইল? ‘‘ছেলের নাম দিয়েছিলেন ইন্দ্রাণীর বাবা উপেনবাবু (বরা)। তখন মিখাইল গর্বাচভ-কে নিয়ে বিশ্ব জুড়ে হইচই’’, মুচকি হেসে জানালেন সিদ্ধার্থ। অকপটে বললেন, ‘‘মেয়ের জন্য যতটা টান অনুভব করি, ততটা ছেলের জন্য নয়।’’

কেন?

সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘শিনা যখন ক্লাস টেন-এ, তখন গুয়াহাটির বাড়ি থেকে শিনা ফোন করেছিল। দু’একটা কথার পরে বলেছিলাম, ‘ভাই আছে? কথা বলতে চাই।’ ওই প্রান্ত থেকে শুনলাম আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না মিখাইল। বুঝতে পারি, আমায় নিয়ে ওদের মন বিষিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝে এক বার গিয়ে আমি ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিলাম বলেই সে দিন শিনা আমাকে ফোন করতে পেরেছিল।’’ তার পরে আর মেয়ের সঙ্গে নিজে থেকে যোগাযোগ করেননি? ক্লান্ত দেখায় সিদ্ধার্থ-কে। বলেন, ‘‘আমি সে দিনের সেই ফোন থেকেই বুঝতে পারি আমার ভাত-ডালের জীবন থেকে ওদের জীবন অনেক আলাদা হয়ে গিয়েছে।’’

এক বারও কি দেখতে ইচ্ছে হয়নি ছেলে বা মেয়েকে?

সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘ইচ্ছে হয়নি বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু উপায় ছিল না। নতুন করে ডাকাডাকি করে আর বিরক্ত করতে চাইনি। ইন্দ্রাণী তার নিজের মতো করেই গড়ে তুলেছিল ছেলে-মেয়েকে। নিজের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে নিজেকে বড় ‘অসহায়’ বলে মনে হয়েছিল।’’ একটু থেমে সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘ইন্দ্রাণীর উচ্চাশা ছিল সেই তখন থেকেই। সব সময়ে আরও ভাল থাকতে চাইত। ১৯৮৯ সালের গোড়া থেকে বেকারির ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়। আস্তে আস্তে ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে হয় দোকানের। আর তার কয়েক মাসের মধ্যেই ‘শিলং-এ যাচ্ছি’ বলে ইন্দ্রাণী আমাকে ও ছেলেমেয়েকে ছেড়ে চলে যায়।’’

সিদ্ধার্থকে ধাওয়া সংবাদমাধ্যমের। মঙ্গলবার কলকাতায়। ছবি: পিটিআই

সেটা কোন মাস? বলতে চাননি সিদ্ধার্থ। আর মনেও করতে চান না সেই সব দিনের কথা। তবে এটা বললেন, ‘‘ইন্দ্রাণী যদি খুন করেই থাকে, তা হলে ওর ফাঁসি হোক!’’ তাঁর কি মনে হয় ইন্দ্রাণী খুন করে থাকতে পারেন? উত্তর আসে, টাকার লোভেই ইন্দ্রাণী আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। এখন মনে হয়, টাকার লোভে খুন করতেও পারে।’’ শিলং-এ ইন্দ্রাণীকে খুঁজে না পেয়ে গুয়াহাটিতে ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে এসেছিলেন তিনি। কোনও রোজগার নেই তখন। সিদ্ধার্থ-র কথায়, ‘‘আমাকে ইন্দ্রাণীর বাবা বলেছিলেন, ‘তোমার রোজগার নেই। ছেলেমেয়েকে কোথায় নিয়ে গিয়ে রাখবে? কী খাওয়াবে?’ আমি মাথা নিচু করে গুয়াহাটি ছেড়েছিলাম।’’ শুরু হয়েছিল চাকরির খোঁজ। কিন্তু এক বছরের মাথায় গাড়ি দুর্ঘটনায় জখম হন। করিমগঞ্জের বাড়িতে অনেক দিন শুয়ে থাকতে হয়। সুস্থ হয়ে আবার পথে পথে ঘোরা শুরু, ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চলেছিল সেই খোঁজ। আর তার মাঝে, সিদ্ধার্থ-র দাবি অনুযায়ী, তিনি বেশ কয়েক বার ছেলেমেয়েকে দেখতে গুয়াহাটি যান। কিন্তু তাঁকে অপমানিত হয়ে বেরিয়ে আসতে হয় সেই বাড়ি থেকে।

১৯৯২ সালে চাকরি পেয়ে অরুণাচল প্রদেশে চলে যান সিদ্ধার্থ। সেখানে একটি স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। গুয়াহাটি যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। তবে বন্ধু-বান্ধব মারফত খোঁজ নিতে থাকেন শিনা-মিখাইলের। ১৯৯৭ সালে কলকাতায় এসে বাবলির সঙ্গে বিয়ে। বাবলিকে সঙ্গে নিয়ে যান করিমগঞ্জ। ঠিক ছিল, সেখানেই থাকবেন। সেটা সিদ্ধার্থ-র মা জানতেন এবং সে জন্যই সম্ভবত সেখানকার ভোটার তালিকায় তাঁর ও বাবলির নাম তুলেছিলেন তিনি। মন্তব্য সিদ্ধার্থ-র। কিন্তু রোজগারের সুবিধে না থাকায় ফিরে আসেন কলকাতায়।

কলকাতায় এসে ছেলের জন্ম। যে ছেলের জন্য এ দিন হাত জোড় করে মিডিয়ার সামনে দাঁড়াতে দেখা গেল সিদ্ধার্থকে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার স্ত্রী ও ছেলেকে দয়া করে ছেড়ে দিন। যা জানতে চাইছেন সব বলব। কিন্তু ছেলে ও স্ত্রী-কে এর মধ্যে টানবেন না।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE