চলছে মণ্ডপসজ্জা। চিত্তরঞ্জন পার্ক পকেট ফর্টি-র নবপল্লী পুজো সমিতিতে। — নিজস্ব চিত্র।
বাহ্যিক আড়ম্বর আর তারকার ঝলসানিতে মায়ের আরাধনা হোক, বোধহয় চান না মেয়ে!
বাজারে মন্দা। মা লক্ষ্মীর ভাঁড়ার বাড়ন্ত। তাই দিল্লির পুজোয় কর্পোরেট বদান্যতা এবং চাকচিক্যের পাল্লা কিছুটা নিম্নগামী। তা সে চিত্তরঞ্জন পার্ক পকেট ফর্টি-র নবপল্লীর পুজো হোক বা পূর্ব দিল্লির সিকি শতাব্দির পুরনো পুজো মিলনী। নবপল্লী পুজো সমিতির প্রেসিডেন্ট উৎপল ঘোষের কথায়, ‘‘এত দিন সরকারি নবরত্ন সংস্থাগুলো সিএসআর তহবিল থেকে মোটা টাকা দিল্লির পুজো কমিটিগুলোকে দিত। কিন্তু কেন্দ্রে নতুন সরকার আসার পর তা আর হচ্ছে না।’’ কেন এই ভোলবদল? ‘‘সম্ভবত স্বচ্ছ ভারত অভিযান বা অন্যান্য সরকারি স্কিমে তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে’’— মন্তব্য উৎপলবাবুর।
একই সুর রাজধানীর বিভিন্ন পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের গলায়। সবাই বলছেন, আগে যে সংস্থা থেকে এক লক্ষ টাকা পাওয়া যেত, এ বার সেখানে ঠেকানো হচ্ছে দশ হাজার। উৎপলবাবু জানালেন, ওএনজিসি, ভেল, এনটিপিসি-র মতো সংস্থাগুলো আগে দেড় থেকে দু’লাখ টাকা স্পনসর করত। কিন্তু এ বার তারা হাত উপুড় করে দিয়েছে। পনেরো থেকে বিশ হাজার পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও জুতোর শুকতলা খুইয়ে!
তাতে অবশ্য দমছে না পুজো কমিটিগুলো। তারা এ বার নির্ভর করছে চেনা পরিচিতদের অনুদান ও ছোট ছোট স্পনসরের উপর। জৌলুষের ঘনঘটা সরিয়ে রেখে আপাতত তাই দেশজ শিল্পের বার্তাই রাজধানীর পুজোয় পুজোয়। যেমন, নবপল্লীর মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে মেদিনীপুরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই পটুয়া প্রতিনিধির নির্দেশনায়। থিম— কৃষ্ণ ও দুর্গার বিভিন্ন অবতার।
কলকাতা এবং মুম্বইয়ের তারকা নিয়ে আসতে বিপুল টাকা লাগে। সীমিত বাজেটে অনেক পুজোই এ বার তাই মূলত নির্ভর করছেন স্থানীয় প্রতিভার উপর। নবপল্লীর সেক্রেটারি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘পাড়ার স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান করালে এলাকার মানুষের উৎসাহ বাড়ে। তাঁরা আরও বেশি করে এগিয়ে আসেন উৎসবকে সফল করতে।’’ তবে প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর মুখে দাঁড়ানো করোলবাগ পুজো কমিটি অবশ্য ঝাঁপিয়েছে পুজোর সাংস্কৃতিক উৎসবকে তারকাখচিত করার জন্য। রাইমা সেন, পল্লবী চট্টোপাধ্যায়, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের উপস্থিতি এই পুজোকে বাড়তি গ্ল্যামার জোগাবে, মনে করেন কর্মকর্তারা।
দিল্লির অন্যতম প্রাচীন এই পুজোমণ্ডপ এ বার তৈরি হয়েছে বাঁশ এবং মাদুরের কাজে। তবে কর্পোরেট অনুদান কমে যাওয়া নতুন নয়, জানাচ্ছেন এই পুজো কমিটির এক কর্তা দীপক ভৌমিক। তাঁর কথায়, ‘‘দু’বছর আগে দিল্লি পুলিশ যখন সর্বজনীন পুজোর বড় গেট করার উপর নিষেধজ্ঞা জারি করল, তখন থেকেই বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো বিজ্ঞাপন দেওয়ার নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে। গেট ছিল বিজ্ঞাপনের একটি বড় জায়গা।’’
পরিস্থিতি এমনই যে, পুজো কমিটির ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে হচ্ছে পটেলনগর পুজো সমিতিকে। এ বার এই পুজোর স্বর্ণজয়ন্তী বছর। কর্মকর্তাদের ইচ্ছে ছিল ধুমধাম করার। কমিটির প্রেসিডেন্ট দেবাশিস ভৌমিকের কথায়, ‘‘বাজেট কমাতে কমাতে শেষ পর্যন্ত ১৪ লাখে নামিয়েছি। তাতেও টাকা উঠছে না।’’ তবে যে হেতু ৫০ বছর, তাই সবাই মিলে এগিয়ে এসেছেন, জানালেন দেবশিসবাবু। বললেন, ‘‘সরকারি ও বেসরকারি বড় সংস্থাগুলো হাত গুটিয়ে নেওয়ার পরে শেষপর্যন্ত দিল্লির বিভিন্ন বাঙালি প্রতিষ্ঠান ও দোকানগুলো এগিয়ে এসেছে।’’
চব্বিশ বছরে পা দিয়েছে পূর্ব দিল্লির ময়ূরবিহারের মিলনী পুজো। এ বারের থিম ওড়িশার জগন্নাথের মন্দির। কমিটির কর্তা তপন রায়ের কথায়, ‘‘বাজারে টাকা কই যে পুজোয় ঢালবে কর্পোরেট সংস্থা? সরকারি সংস্থাগুলো তো দেখছি এ বার নীতিই নিয়ে নিয়েছে যে পুজোয় আগের মতো টাকা দেবে না।’’ এই পুজোতেই অমিতকুমার, ঊষা উত্থুপের মতো শিল্পীর অনুষ্ঠান দেখার জন্য দুই কিলোমিটার ধরে লাইন পড়ত! এ বছর শুধু মুম্বইয়ের পরিচালক মধুর ভাণ্ডারকরকে দিয়ে ষষ্ঠীর দিন পুজো উদ্বোধন করিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে মিলনীকে। দু’এক জন কলকাতার শিল্পী থাকলেও মিলনী মূলত জোর দিচ্ছে স্থানীয় শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপর।
পশ্চিম বিহারের নিবেদিতা এনক্লেভ-এর কর্তা তমাল দত্ত নিজে একটি কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরত। দিল্লিতে দুর্গা পুজোয় স্পনসরশিপ-এর সমীকরণটি খুব ভাল করেই জানেন। তাঁর কথায়, ‘‘দূরদূরান্তের অনেক মানুষ চিত্তরঞ্জন পার্কে পুজো দেখতে আসেন। সেখানে বিজ্ঞাপন দিলে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কিছুটা লাভ থাকে। কিন্তু ছোট পুজো, বা যেগুলো পাড়া-নির্ভর, সেখানে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের লাভ কী?’’ করোলবাগের দীপকবাবুর মতোই তিনি বলছেন, ‘‘শুধু এ বছর নয়, গত কয়েক বছর ধরেই ছোট পুজোগুলো স্পনসরের অভাবে ভুগছে।’’
রাজধানীর পুজো এ বার তাই আড়ম্বরে নয়, ফিরতে চাইছে শিকড়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy