সোমবার সংসদ ভবন ছাড়ছেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। ছবি: প্রেম সিংহ।
এ যেন বোঝার উপর শাকের আঁটি। ললিত মোদী-কাণ্ডে সুষমা স্বরাজ ও বসুন্ধরা রাজের ইস্তফার দাবিতে সংসদ অচলই ছিল। এ ব্যাপারে লোকসভার মধ্যে কখনও স্লোগান তুলে, কখনও প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে অধিবেশনের শুরু থেকে সভা পণ্ড করতে তৎপর ছিলেন কংগ্রেস সাংসদরা। আজ তাঁদের মধ্যে থেকেই পঁচিশ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করে দিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে ফেললেন লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। কারণ, তাতে সুরাহা মেলার পথই বন্ধ হয়ে গেল প্রায়! সংসদ চালানোর ব্যাপারে তো বটেই, রাজনৈতিক ভাবেও তীব্র সংকটে পড়ে গেল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। একে তো গণতান্ত্রিক অধিকার হননের প্রশ্নে আঙুল উঠল সরকারের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে তামাম বিরোধীকে এককাট্টা করে দিতে অনুঘটকের ভূমিকা নিল এই সিদ্ধান্ত। সংসদে কংগ্রেসকে একঘরে করতে গিয়ে উল্টে চাপে পড়ে গেল কেন্দ্রের শাসক দল।
বস্তুত ললিত মোদী-কাণ্ডে দুর্নীতির অভিযোগে সুষমা-বসুন্ধরাদের ইস্তফা না হলে সংসদ যে এ বার চলতে দেওয়া হবে না, তা অধিবেশন শুরুর আগেই পরিষ্কার করে দিয়েছিল কংগ্রেস। এ ব্যাপারে আজ ফের হুমকি দেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে সনিয়া বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী হলেন এক জন মাস্টার প্যাকেজার! পটু সেলসম্যান। কিন্তু দাম্ভিক। মিথ্যে ভাষণ দিয়ে উঁচু আসনে বসে থাকার কৌশল আর চলবে না।’’ সনিয়ার এই হুমকির পরেই আজ স্পিকারের শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে এক ঝাঁক কংগ্রেস সাংসদের বিরুদ্ধে। এর আগে সংসদে প্ল্যাকার্ড দেখানো নিয়ে কংগ্রেস সাংসদদের হুঁশিয়ার করেছিলেন স্পিকার। আজ তিনি কোনও কথাই শুনতে চাননি। এক ধাক্কায় ২৫ জন কংগ্রেস সাংসদকে পাঁচ দিনের জন্য বরখাস্ত করে দেন! গত আড়াই দশকে সংসদে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। ফলে স্পিকারের সিদ্ধান্তের পরেই সমালোচনার ঝড় শুরু হয়ে যায়। এবং তা আছড়ে পড়ে মূলত শাসক দলের উপরেই।
এখন কী করবে সরকার?
কংগ্রেস সাংসদদের সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত স্পিকার নিলেও রাজনৈতিক শিবিরের সন্দেহ, বকলমে এই সিদ্ধান্তটা আসলে মোদী-সরকারের। বিজেপির একটি সূত্র বলছে, আজ সংসদে সর্বদল বৈঠক দেখে সরকারের শীর্ষ নেতাদের ধারণা হয়েছিল, কংগ্রেস ছাড়া সব বিরোধী দলই সংসদ চালানোর পক্ষে। এই অবস্থায় কংগ্রেসকে একঘরে করতেই এই পদক্ষেপ করেন বেঙ্কাইয়া নায়ডুরা। যদিও শাসক দলের তরফে এই সিদ্ধান্তটি স্পিকারের বলেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হচ্ছে। বিজেপি সাংসদ রাজীব প্রতাপ রুডির কথায়, ‘‘বারবার সতর্ক করার পরে স্পিকার যা করেছেন, তা ঠিকই করেছেন।’’ কিন্তু ব্যাপারটা যে হারাকিরি হয়ে গেছে, তা দলের অনেক নেতাই এখন ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন। তাঁদের মতে, সংসদ চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকলে তবেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারেন। সরকারের আচরণ সম্পর্কে এতে নেতিবাচক বার্তা তো যাবেই। সেই সঙ্গে তৃণমূল-সপা-সহ যে দলগুলি বিজেপির সঙ্গে তলে তলে বোঝাপড়া করে চলছিল, তাদেরও এখন সরকারের বিরোধিতা করা ছাড়া পথ থাকল না।
প্রসঙ্গত, ক’দিন আগে লোকসভা থেকে কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীকে সাসপেন্ড করেছিলেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। তখন এর বিরোধিতা করেছিল তৃণমূল। আজও তারাই সবার আগে প্রতিবাদ জানায়।
সেই সঙ্গে তারা এও জানিয়ে দেয়, সংসদে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে তৃণমূল কাল থেকে লোকসভা বয়কট করবে। তৃণমূলকে অনুসরণ করে সপা, এনসিপি, জনতা পরিবারের দলগুলিও লোকসভা বয়কটের সিদ্ধান্ত জানায়। লোকসভায় কংগ্রেসের মোট সদস্য সংখ্যা ৪৪। এর মধ্যে ২৫ জনকে সাসপেন্ড করার পর সনিয়া-রাহুল সহ ১৭ জনের এখনও সভায় থাকার কথা। কিন্তু আজকের দিনটিকে গণতন্ত্রের ‘কালো দিন’ বলে মন্তব্য করে সনিয়া জানিয়ে দেন, আগামী পাঁচ দিন তাঁরাও লোকসভায় গরহাজির থাকবেন। শুধু তা-ই নয়, বাম-এনসিপি ও জেডিইউ-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাল সকাল ১০টায় গাঁধী মূর্তির পাদদেশে অবস্থান করবে কংগ্রেস। দুপুরে বিজেপির সদর দফতরের বাইরেও বিক্ষোভ দেখাবে দল। পাশাপাশি দলীয় তরফে জানানো হয়েছে, রাজ্যসভায় কংগ্রেস সাংসদরা কাল হাজির হলেও স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেখানে ধুন্ধুমার বাধাবেন তাঁরা। তারই ইঙ্গিত দিয়ে কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহের হুমকি, ‘‘লোকসভায় সরকার সংখ্যার দাপটে বিরোধীদের দুরমুশ করতে চাইছে। রাজ্যসভায় কী করবে?’’
তা হলে পথ কোথায় সরকারের সামনে? সূত্রের খবর, বিজেপির কিছু নেতা বিকেলেই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, স্পিকার যাতে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন, সে জন্য যেন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে কাল সরকারি ভাবে অনুরোধ করেন। তাতে শাস্তির সিদ্ধান্তটি যে আদতে স্পিকারের ছিল, সেটাও বোঝানো যাবে। সে দিক থেকে নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সরকারের চুক্তির পর আজ সন্ধ্যায় মনমোহন সিংহ ও মল্লিকার্জুন খার্গের সঙ্গে মোদী যে ভাবে ফোন করে কথা বলেছেন, তা প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে এতেও চিঁড়ে ভিজবে কিনা সংশয় রয়েছে। এ দিন রাজ্যসভায় হট্টগোলের মাঝেই বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ একটি বিবৃতি দেন। তাঁর দাবি, ললিত মোদীকে ভিসা পাইয়ে দিতে তিনি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেননি। কিন্তু কোনও কথাই শুনতে রাজি হয়নি কংগ্রেস। বরং কংগ্রেস সংসদীয় দলের বৈঠক থেকে সনিয়া গাঁধী বুঝিয়ে দেন, এ বার সংঘাতের পথটাই বেছে নিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে সনিয়া যে সব মন্তব্য করেছেন, তা-ও তাৎপর্যপূর্ণ। দলীয় বৈঠকে সনিয়া বলেন, ‘‘কথা দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী খোলামেলা। অথচ তাঁর বিদেশমন্ত্রী ও দুই মুখ্যমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে আজব রকম ভাবে চুপ করে রয়েছেন! ‘মন কি বাত’-এর চ্যাম্পিয়ন এখন মৌনব্রতের গর্তে ঢুকে গেছে!’’ সংসদে হট্টগোল করা নিয়ে জেটলিদের সমালোচনার জবাবে বলেন, ‘‘আগে যাঁরা সংসদ অচল করে রাখতেন, এখন তাঁরা সংসদে আলোচনা ও বিতর্কের জন্য লেকচার দিচ্ছেন! সরকার ও তার শীর্ষ নেতার হাবভাব এই যে, আমাদের কথা শোন, নইলে যাও! সংসদের বাইরেও এর জবাব দেবে কংগ্রেস।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy