Advertisement
০৩ মে ২০২৪
National News

‘নীতি থাকলে কি এমন জোট করত বিজেপি?’

উপজাতীয় সংগঠন এই আইপিএফটি। গত সেপ্টেম্বরে ত্রিপুরায় সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডে নাম জড়িয়েছে এদের কয়েকজন কর্মীর।  তফসিলি উপজাতি এলাকার এই সংগঠনের সঙ্গে এ বারে জোট বেঁধেছে বিজেপি।

মানিক সরকার। — ফাইল চিত্র।

মানিক সরকার। — ফাইল চিত্র।

তাপস সিংহ
আগরতলা শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৩:৪৬
Share: Save:

আগরতলা শহরের মেলার মাঠের পাশে সিপিএমের দলীয় দফতরে মুড়ি-চানাচুর সহযোগে চমৎকার আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যা গড়াচ্ছিল রাতের দিকে। দিনভর দলীয় প্রচার সেরে একটু আগেই পার্টি অফিসে ফিরেছেন বৃন্দা কারাত এবং সুভাষিণী আলি। দলীয় এক কর্মীকে বৃন্দা বললেন, ‘‘একটু ভাল করে চা খাওয়াবে? অনেকক্ষণ চা খাওয়া হয়নি।’’ বৃন্দাই প্রশ্ন করলেন, ‘‘কী বুঝছো?’’ হাল্কা হাসি সুভাষিণীর মুখে।

তখনও অবশ্য তাঁর দেখা নেই। প্রচার সভা সেরে তিনি এলেন অনেক পরে। চেহারাটা ঈষৎ ক্লান্ত। দলীয় প্রচারের প্রধান মুখ যে তিনি! চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কনফারেন্স রুমে এলেন মানিক সরকার।

নির্বাচনী উত্তাপের মধ্যেও রবিবাসরীয় সন্ধ্যার আবহাওয়ায় শীতের আমেজ। সাদা পাঞ্জাবির উপরে তাই একটা হাফ জ্যাকেট। আনন্দবাজারের মুখোমুখি হয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। গলার স্বর সেই একই ভাবে শান্ত, সমাহিত।

আরও পড়ুন, প্রচারে গেরুয়া ঝড়, প্রদীপ আগলাতে মরিয়া মানিক

গত বেশ কিছু দিন ধরে বিজেপি-র লাগাতার আক্রমণের লক্ষ্য তিনি। এবং তিনি। তাঁর সাদা পোশাকের আড়ালে কতটা কালো লুকিয়ে আছে, বিরোধীরা লাগাতার সেই সন্ধান করে চলেছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে যে হলফনামা মানিকবাবু জমা দিয়েছেন তাতে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর হাতে আছে নগদ ১৫২০ টাকা, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পড়ে ২৪১০ টাকা। এবং সেই নগণ্য টাকাই তাঁকে করে তুলেছে কার্যত জীবন্ত চাঁদমারি।

দেখুন মানিক সরকারের সাক্ষাৎকার

এ বারের নির্বাচন কি তাঁদের কাছে গত ২৫ বছরে একটা বড় চ্যালেঞ্জ? তিনি বলছেন, ‘‘ভোটের রাজনীতি তো সবসময়েই চ্যালেঞ্জের। কারণ এটা হচ্ছে উচ্চতর পর্যায়ের রাজনৈতিক সংগ্রাম।’’ রাজনৈতিক সংগ্রাম। কিন্তু তা কি রাজনৈতিক মতাদর্শগত বা নীতির লড়াই? মানিকের জবাব: ‘‘নীতির উপরে থাকলে তারা (বিজেপি) আইপিএফটি (ইন্ডিজেনাস পিপল’স ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা)-র মতো একটা সংগঠনের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা করে কী করে?’’

উপজাতীয় সংগঠন এই আইপিএফটি। গত সেপ্টেম্বরে ত্রিপুরায় সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডে নাম জড়িয়েছে এদের কয়েকজন কর্মীর। তফসিলি উপজাতি এলাকার এই সংগঠনের সঙ্গে এ বারে জোট বেঁধেছে বিজেপি।

ত্রিপুরা বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৫১টিতে বিজেপি প্রার্থী দিলেও সহযোগী আইপিএফটি-কে ছেড়ে দিয়েছে ৯টি আসন। কোনও সন্দেহ নেই, বিজেপির এই চাল সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে চাপে ফেলেছে। স্বশাসিত জেলা পরিষদের নির্বাচনে সব ক’টি আসনে জিতলেও, উপজাতীয় এলাকায় এ বার বিশেষ নজর দিতে হয়েছে সিপিএম-কে।

সিপিএমের এ বারের নির্বাচনী ইস্তেহারও সে কথাই বলছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘স্বশাসিত জেলা পরিষদ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে বহুমুখী উন্নয়ন কর্মসূচি রূপায়ণ করে চলেছে। সার্বিক এই বহুমুখী উন্নয়ন কর্মধারা অব্যাহত থাকবে।’

আরও পড়ুন, পুরনো সরিয়ে চেহারা বদলে ফেলল সিপিএম

রবিবার সকালে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি তাঁর দলের ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ প্রকাশ করেছেন। এই প্রসঙ্গেই মানিকবাবুর পাল্টা কটাক্ষ: ‘ভিশন ডকুমেন্ট মানেটা কী? ভিশন তো ভারতবর্ষে অনেক আগেই ঠিক হয়েছে।… চার বছর আগে এই ডকুমেন্টই তো তাঁরা প্রকাশ করেছেন!... ভারতকে বাদ দিয়ে তো একটা রাজ্যের আলাদা ভিশন হয় না।’’

সিপিএমের সব স্তরের নেতারাই অবশ্য বলছেন, এ রকম চ্যালেঞ্জের সামনে তাঁরা এর আগেও পড়েছেন। সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলাও তাঁরা করেছেন। তবে, লাগাতার প্রচারে কিছু মানুষ যে ‘বিভ্রান্ত’ হতে পারেন, সেই আশঙ্কাও তাঁদের রয়েছে। যেমন, স্বশাসিত জেলা পরিষদের চিফ এগজিকিউটিভ মেম্বার রাধাচরণ দেববর্মা আনন্দবাজারকে বলছিলেন, ‘‘কিছু মানুষ যে বিভ্রান্ত হয় না তা নয়, বিভ্রান্ত হয়। সেই বিভ্রান্তি কাটানোও যায়।’’ বিভিন্ন জনসভায় মানিক সরকারও বলছেন, ‘‘কেউ যাতে বিভ্রান্ত না হয় সে দিকে নজর রাখুন। শুধু আপনারা সিপিএমকে ভোট দিয়ে জেতালেই হবে না, পরের প্রজন্মও যাতে আমাদের ভোট দেয় সে দিকেও খেয়াল রাখুন।’’

আরও পড়ুন, ত্রিপুরাকে হিরের টুকরো গড়বেন জেটলি-শাহেরা

রবিবার সন্ধ্যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন পশ্চিম ত্রিপুরার চড়িলাম (সংরক্ষিত) আসনের সিপিএম প্রার্থী রমেন্দ্র নারায়ণ দেববর্মা। দলীয় অফিসে সকলের মনই ভারাক্রান্ত। কথা বলার মাঝেই খবর আসে তাঁর মরদেহ সেখানে এসে পৌঁছেছে। দলীয় সহকর্মীরা ভিড় করেছেন। কনফারেন্স রুমের টেবিলে ফেলে রেখে নয়, চায়ের খালি কাপ হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ান মানিক। বলেন, ‘‘এসে গেছে। আমায় এ বার যেতে হবে।’’ ধীরে ধীরে দোতলা থেকে নেমে ভিড়ের মাঝে মিশে যান দলের এই পলিটব্যুরো সদস্য, আরও পাঁচ জনের মতোই।

এই ত্রিপুরায় নির্বাচনী প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলে গিয়েছেন, মানিক পাল্টে হিরে আনুন।

এই এতগুলো বছর ক্ষমতায় থাকতে থাকতে মানিক কি পাল্টে গিয়েছেন? ‘সিস্টেম’ কি তার নিজস্ব নিয়মে তাঁকে ভিতরে ভিতরে রূপান্তর ঘটিয়েছে?

জানি না। শুধু দেখলাম, কাচে ঢাকা শববাহী গাড়ি রমেন্দ্রকে নিয়ে শেষ বারের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে পার্টি অফিস ছেড়ে। অপলক চেয়ে আছেন মানিক সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE