মেনকা গাঁধীর সঙ্গে মহাকরণে খুশবন্ত। ১৯৭৭ সালে তোলা ছবি। আনন্দবাজারের ফাইল চিত্র।
এখন থেকে পৃথিবীতে বিদ্বেষ থাকবে। বিদ্বেষহীন ব্যঙ্গ ‘ম্যালিস’ (malice) থাকবে না।
বৃহস্পতিবার সকালে দিল্লির বাড়িতে প্রয়াত হলেন ৯৯ বছরের খুশবন্ত সিংহ। খবরের কাগজের সাপ্তাহিক কলমে কাচের বাল্বে বসে আর তিনি সকলের প্রতি বাঁকা হাসি ছড়াবেন না। শেষ হয়ে গেল ‘উইথ ম্যালিস টুওয়র্ডস ওয়ান অ্যান্ড অল।’
হাসির দমকটুকু অবশ্য রেখে গেলেন ১৯১৫ সালে ২ ফেব্রুয়ারির জাতক। দিল্লির মডার্ন স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করার সময় স্যর শোভা সিংহ ছেলের জন্মতারিখ হিসেবে ওইটিই লিখেছিলেন! কয়েক বছর পর ঠাকুমা বললেন, ‘দাদুভাই, তোর জন্ম হয়েছিল বছরের মাঝামাঝি।’ খুশবন্ত তখন নিজেই জন্মতারিখ পাল্টে ১৫ অগস্ট, সিংহ রাশিতে চলে যান। ক’বছর পর ওই তারিখেই ভারত স্বাধীনতা পায়। সংবাদ আর সাংবাদিকের এমন সমাপতন চট করে দেখা যায় না!
খুশবন্ত সিংহ মুখ্যত সাংবাদিক। সরকারি ‘যোজনা’ পত্রিকা থেকে অধুনালুপ্ত ‘নিউ দিল্লি’ (আনন্দবাজার গোষ্ঠীর), ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’, ‘হিন্দুস্তান টাইমস’— অনেক পত্রপত্রিকা-কাগজই সম্পাদনা করেছেন তিনি। কখনও বা ‘পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া’য় কনসাল্টিং এডিটর। আবার তারই পাশে ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ বা ‘দিল্লি’-র মতো উপন্যাস কিংবা ‘মার্ক অব বিষ্ণু’র মতো গল্প, কখনও ‘আ হিস্ট্রি অব দ্য শিখস’ বা ‘দ্য ফল অব দ্য কিংডম অব পঞ্জাব’-এর মতো সিরিয়াস বই।
বিচিত্রগামী সাংবাদিক গল্প-উপন্যাস বা নন-ফিকশন লিখবেন, আশ্চর্যের কিছু নেই। ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যে সলমন রুশদি, অমিতাভ ঘোষদের পাশে ‘পাকিস্তানগামী ট্রেন’ পাদটীকা হয়ে থাকবে কি না, সেটাও অন্য প্রশ্ন। কিন্তু যেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, তা হল খুশবন্ত-চরিত্র। খুশবন্ত মানেই বর্ণময় বিচ্ছুরণ। ঠোঁটকাটা মজারু।
আডবাণীর রথযাত্রা নিয়ে তখন ভারী হইচই। খুশবন্ত জানালেন, ‘আডবাণী সৎ মানুষ। আমার বাড়িতে বডিগার্ড-সহ এলেন। ওঁকে বললাম, আপনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নষ্ট করছেন। কিন্তু বলে কী লাভ? আডবাণী এত সৎ যে মহিলাদের প্রতি ছোঁকছোঁক করেন না। যারা উওম্যানাইজ করে না, তারা বিপজ্জনক।’
খুশবন্ত সিংহের পাঞ্চলাইন তাই দুটি: ১) মানুষের প্রতি বিদ্বেষ রেখো না। ২) এটা সিরিয়াস তত্ত্ব আর এটা ট্রিভিয়া বা তুচ্ছাতিতুচ্ছ, এই তফাতটাও রেখো না। দুয়ে মিলেই তৈরি হবে তোমার লেখা।
এর পরে খুশবন্ত কেমন লেখক, শিখদের ইতিহাস লেখার ক্ষমতা রেখেও আজীবন কেনই বা তরবারি দিয়ে দাড়ি কামানোর মতো সব জোকবুক লিখলেন সেই প্রশ্ন নিরর্থক।
এ দিন সকালে দিল্লির বাড়িতে মৃত্যুর আগে খুশবন্ত কী বলেছিলেন? শোনা যায়, খুশবন্তের মায়ের শেষ সংলাপ ছিল, ‘ভিস্কি’! বাবা স্যর শোভা সিংহ ৯০ বছর বেঁচেছিলেন। দিল্লিতে ‘নর্থ ব্লক’ তৈরির কন্ট্রাক্টর তিনি, কালকা-সিমলা রেললাইনের একটা অংশ তৈরির কন্ট্রাক্টও তাঁর ছিল। এ হেন শোভা সিংহও রাতে স্কচের পেগে শেষ চুমুকটি দিয়ে চিরঘুমে ঢলে পড়েছিলেন। ৯৯ বছরের খুশবন্ত? পুত্র রাহুল জানাচ্ছেন “বড় শান্তিতে শেষ নিশ্বাস ফেলেছেন তিনি।”
ঈশ্বর-অবিশ্বাসী খুশবন্ত সিংহ জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে এই একটাই জিনিস চাইতেন। রোগে ভুগে বা আচমকা, যে ভাবেই পূর্ণচ্ছেদ পড়ুক না কেন, তাঁর জীবনের মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়। জীবনের সম্মান অটুট রাখার চেষ্টায় নিজের বার্ধক্যঘটিত অসুস্থতা নিয়েও মজা করতে ছাড়েননি। আত্মজীবনী ‘ট্রুথ, লভ অ্যান্ড আ লিটল ম্যালিস’-এ লিখেছিলেন, “আজকাল চোখে ছানি পড়ছে, ডায়াবেটিস আর প্রেশার তো আছেই। প্রস্টেটও বেগ দিচ্ছে। সকালে উঠে বেড়ে যাওয়া ওই অঙ্গ দেখে নিজেকে এখনও যুবক বলে ভ্রম হয়।” বাণপ্রস্থকামী ভারতীয় চেতনায় এই রসবোধ থাকে না। খুশবন্ত সিংহ ব্যতিক্রম।
জীবনরসিক এবং যোগ্য সন্তানের মতোই স্কচরসিক। প্রতি সন্ধ্যায় দু’পেগ। কসৌলি ক্লাবের একটু আগে, আপার মলে এখনও আছে সেই বাড়ি। নেমপ্লেটে পরপর বাবা ছেলের নাম: স্যর শোভা সিংহ, খুশবন্ত সিংহ। খুশবন্ত কসৌলি ক্লাবে এলেও শ্যাম্পেন ছুঁতেন না। ওই অ্যালকোহলিক লেমনেড তাঁর ভাল লাগে না। নেমন্তন্ন করলেও বলতেন, ‘শ্যাল আই কাম উইথ মাই ওন স্কচ?’
স্কচ ছাড়া তন্নিষ্ঠ প্রেম ছিল এক জনের প্রতিই। কাভাল মালিক। দিল্লির মডার্ন স্কুলে খুশবন্তের সহপাঠিনী, পরে স্ত্রী। কাভাল মারা গিয়েছেন তেরো বছর আগে। কসৌলির বাড়িও এখন ধূলিমলিন। কয়েক মাইল দূরেই সানাওয়ার গ্রামে লরেন্স স্কুল। খুশবন্ত তখন মুম্বইয়ে ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’র সম্পাদক। এক দিন নার্গিস এসে হাজির, ছেলে সঞ্জয়কে ওই স্কুলে তিনি ভর্তি করেছেন। কিন্তু কাছাকাছি থাকার জায়গা নেই। খুশবন্তের বাড়িটা দিন কয়েকের জন্য পাওয়া যাবে? খুশবন্তের উত্তর: ‘একটা শর্ত আছে। ইউ উইল হ্যাভ টু শেয়ার মাই বেড।’ নায়িকা লজ্জায় অধোবদন! খুশবন্ত হাসলেন, ‘আরে, আমি তো মুম্বইতেই থাকব। তুমি ওই বাড়িতে রোজ আমার বিছানায় শোবে। তুমি মুম্বই ফিরে এসে চাবি ফেরত দেওয়ার পর লোককে শোনাব, আমি আর নার্গিস এক বিছানায় শুই।’
এই হলেন খুশবন্ত। ‘ম্যালিস’ শব্দটিতে আদতে তাঁকে ধরা যায় না।
ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে খুশবন্তের নরম-গরম সম্পর্ক, সঞ্জয় গাঁধীর মৃত্যুর পর মানেকার পাশে দাঁড়িয়ে ইন্দিরার বিরাগভাজন হওয়া বহুচর্চিত ঘটনা। ’৮৪-র দাঙ্গার সময় সুইডিশ এক বন্ধু খুশবন্ত ও তাঁর পরিবারকে দূতাবাসে আশ্রয় দিলেন। দাঙ্গা, ইন্দিরার অন্ত্যেষ্টি সব দূতাবাসের টিভিতেই দেখেছিলেন খুশবন্ত। পরে আত্মজীবনীতে লিখলেন, ‘আমি নিশ্চিত ইন্দিরা সে দিন বেঁচে থাকলে বাবার মতো দিল্লির পথেপ্রান্তরে ছুটে বেড়াতেন। নিরীহদের বাঁচাতেন।’
নেহরুর আমলে তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হল, পাকিস্তান থেকে যে ভাবে শরণার্থীরা আসছে, তা নিয়ে একটা বই লিখতে হবে। দুনিয়াকে জানাতে হবে। খুশবন্ত বললেন, ‘আমার তো চাকরি আছে। আমার বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরী রেডিওর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, বাংলা ভাষাও জানে। ওকেই প্রস্তাবটা দিন।’ এর পরেও ‘ম্যালিস’ শব্দটা আসে?
ভোপালে সাংবাদিক বন্ধু তরুণ ভাদুড়ির সঙ্গে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছেন। গাছে অজানা পাখির ডাক। খুশবন্ত: কী পাখি? তরুণ: জানি না। খুশবন্ত হাসিতে ফেটে পড়লেন, ‘‘পাপিয়া। বোল রে পাপিহারা। গুড্ডি সিনেমার গান। নিজের মেয়ের ছবিও দেখো না?’’
লাহৌরের কাছে হাদালি গ্রামে জন্ম। প্রথম মহাযুদ্ধে এই হাদালি গ্রামের ছেলেরাই সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি নাম লিখিয়েছিলেন। খুশবন্তও তো আজীবন যুদ্ধই করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কাউকে রেয়াত না করার যুদ্ধ! খুশবন্তদের বংশগত কাজ ছিল উটের পিঠে পাথুরে নুন ও অন্য সম্ভার নিয়ে লাহৌর, অমৃতসরের পথে বাণিজ্য। তাঁর প্রপিতামহের বাবা প্যারেলাল প্রথম হিন্দুধর্ম ছেড়ে শিখ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন, সোহেল সিংহ নাম হয় তাঁর। গ্রামীণ বাণিজ্য থেকে ইংরেজি শিক্ষা, দিল্লি সিমলায় কনস্ট্রাকশন-ব্যবসা... খুশবন্তের পারিবারিক আখ্যানেই ধরা আছে পঞ্জাবে আলোকপ্রাপ্তির ইতিহাস।
সেই আলোকপ্রাপ্তি তাঁর মননে। খুশবন্ত নিজেকে সম্প্রদায়গত চেতনায় আটকে রাখেন না, অক্লেশে সান্টা-বান্টা নিয়ে রসিকতা করেন। কেমব্রিজ থেকে পাশ করে বেরোনোর পর প্রথম চাকরি লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসে। কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে নেহরু লন্ডন গিয়েছেন। কনিষ্ঠ কর্মীটির দায়িত্ব পড়ল প্রেস ম্যাটার তৈরি করার। নেহরু পৌঁছনোর অব্যবহিত আগে দেখা গেল, লেখা ছেপে এসেছে ‘ব্যান্ডিট নেহরু ইন লন্ডন।’ ব্রিটিশ ছাপাখানা পণ্ডিত শব্দটি শোনেনি, ইংরেজি ‘পি’-কে ‘বি’ করে দিয়েছে।
আরও কত অভিজ্ঞতাই যে হল। নেহরু হিথরোয় নেমে বললেন, ‘‘কারও থাকার দরকার নেই। বাড়ি যাও।’’ পরের দিন ব্রিটিশ কাগজে ছবি-সহ হেডিং: লেডি মাউন্টব্যাটেনস মিডনাইট ভিজিটর। মধ্যরাতে নেহরু এডুইনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। আরও লেখা হল, লর্ড মাউন্টব্যাটেন এখন লন্ডনে নেই। কৃষ্ণ মেনন খুশবন্তকে ডেকে বললেন, ‘‘করেছ কী? পণ্ডিতজি রেগে টং।’’ খুশবন্ত বলার চেষ্টা করলেন, ‘নেহরু নিজেই আমাদের বাড়ি চলে যেতে বলেছিলেন’ ইত্যাদি। লাভ হল না। তীব্র ভর্ৎসনা চলতেই থাকল। বহু বছর পরে আত্মজীবনীতে শোধ তুললেন খুশবন্ত। পুরো ঘটনাটা বিবৃত করে লিখলেন, ‘‘সবাই জানে, কৃষ্ণ মেনন অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার মতোই।’’
এ রকমটি আর হবে না। খুশবন্ত সিংহর জীবনের ক্যাচলাইন হতেই পারত: আমি নিজের মতো। আগেও কেউ নেই, পরেও না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy