লোকসভা নির্বাচনের রেশ এখনও ফুরোয়নি। জম্মু-কাশ্মীর এবং ঝাড়খণ্ড, দুই রাজ্যের ভোটের ফলেই সেটা আরও এক বার প্রমাণ হয়ে গেল। প্রায় একা চলে ঝাড়খণ্ডে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি এই ছবির এক দিক হয়, তা হলে অন্য দিকে জম্মু-কাশ্মীরে শতাংশের বিচারে সব থেকে বড় দল বিজেপি। যে ঘটনাকে মোদী-জাদু বলেই ব্যাখ্যা করেছেন দলীয় সভাপতি অমিত শাহ।
এর আগে মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানায় জয়ের রথ ছুটিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি। দুই রাজ্যেই একা লড়েছিল বিজেপি। এ বারেও সেই কৌশলেই লড়াইয়ের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তাঁরা। ঝাড়খণ্ডে জোট ছিল শুধু আজসু-র সঙ্গে। মঙ্গলবার ইভিএম খোলার পরে দেখা গেল, হরিয়ানার পথ ধরে এগিয়েছে ঝাড়খণ্ড। স্থায়ী সরকার চেয়ে বিজেপির পাশেই দাঁড়িয়েছেন মানুষ। লোকসভা ভোটে বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো ঝাড়খণ্ডও দু’হাত ভরিয়ে দিয়েছিল বিজেপির। বিধানসভা ভোটে ততটা না হলেও সে ধারাই মোটের ওপরে বজায় রইল।
আর জম্মু-কাশ্মীরে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি। যদিও সেখানে সরকারে সামিল হওয়া শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েই গেল মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত। অমিত শাহ অবশ্য এ দিনই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সব দলের জন্য, সব রকম জোট সরকারের জন্য তাঁদের দরজা খোলা।
দুই রাজ্যে সরকার গড়তে বিজেপি নেতৃত্ব এতটা উদগ্রীব কেন? দিল্লির রাজনীতিকদের অনেকেই বলছেন, লোকসভা ভোটে জয়ের পর ধারবাহিকতা বজায় রাখতে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁদের মনে হচ্ছে, এই ধারাবাহিকতা এক বার ক্ষুণ্ণ হলেই প্রশ্ন উঠবে, তা হলে কি মোদীর উপরে মানুষের আস্থা আর অটুট নেই? মোদী-জাদু কি তবে হারিয়ে গিয়েছে? আগামী দু’বছরের মধ্যে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ভোট। গুরুত্বপূর্ণ এই তিন রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে ঝাড়খণ্ড-কাশ্মীর সহায়ক হতে পারে।
তা ছাড়া, একই সঙ্গে কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়ার কাজও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান বিজেপি নেতৃত্ব। জম্মু-কাশ্মীরে সরকারে যেতে চাওয়ার পিছনে এটাও বড় কারণ।
বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, ঝাড়খণ্ডে লোকসভা ভোটের ধারেকাছেও যেতে পারেনি বিজেপি। সেই ভোটে ১৪টি আসনের ১২টিতে জিতেছিল তারা। এ বারে কোনওক্রমে ৪২টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখেছে এডিএ জোট। কাশ্মীরেও প্রবল ভাবে প্রচার চালিয়েছিলেন বিজেপি নেতারা। তাঁদের লক্ষ্য ছিল অন্তত ৪৪টি আসন পেয়ে একক ভাবে সরকার গঠন করা। কিন্তু কার্য ক্ষেত্রে তা হয়নি। ফলে মোদী-জাদু তো ফিকে হয়েই গিয়েছে। অমিত শাহের ‘একলা চলো’ নীতিও ধাক্কা খেয়েছে। বরং লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো বর্ষীয়ান নেতারা যে জোট রাজনীতির কথা বলে আসছিলেন এত দিন, সেটাই বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ কথা ঠিক যে, ঝাড়খণ্ড ভোটের পরে একাধিক বুথ ফেরত সমীক্ষায় যে বিজেপি ঝড়ের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়নি। কিন্তু সেটাই একমাত্র তথ্য নয়। বহুমুখী লড়াইয়ে বিজেপি ও তার জোট সঙ্গী আজসু পেয়েছে মোট ৩৫ শতাংশের বেশি ভোট। সেখানে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা পেয়েছে ২০.৪ শতাংশ এবং কংগ্রেস পেয়েছে মোটে ১০.৪ শতাংশ ভোট। স্পষ্টতই এই দুই দলের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিল বিজেপি জোট। দীর্ঘদিন ত্রিশঙ্কু বিধানসভা এবং স্বল্পমেয়াদি সরকার দেখার পরে বিজেপিকে ভোট দিয়ে ঝাড়খণ্ডবাসী স্থায়ী সরকার গঠনের পক্ষেই রায় দিয়েছেন। একার ক্ষমতাতেই সরকার গড়বে বিজেপি জোট। আর জেএমএমের সঙ্গে এত দিন জোট সরকার চালানোর পরেও একসঙ্গে ভোটে না যাওয়ার ফল ভুগতে হয়েছে কংগ্রেসকে।
কাশ্মীরে ভোটে দেখা গিয়েছে, উপত্যকায় একটাও আসন জেতেনি বিজেপি। দলীয় নেতা রাম মাধবও বলছেন, “উপত্যকায় খাতা না খুলতে পারাটা হতাশাজনক।” কিন্তু তাঁর এ-ও মত যে, কাশ্মীরের মানুষ এ বারে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। না হলে তারা এত বেশি ভোট পেত কি না সন্দেহ। শতাংশের হিসেবে এই রাজ্যে সব থেকে বেশি ভোট পেয়েছে বিজেপি। ২৩ শতাংশ। যেখানে পিডিপি পেয়েছে ২২.৭ শতাংশ, ন্যাশনাল কনফারেন্স পেয়েছে ২০.৮ শতাংশ এবং কংগ্রেস পেয়েছে ১৮ শতাংশ ভোট। অনেকেই বলছেন, কাশ্মীর উপত্যকায় আসন না জিতলেও এই ভোট শতাংশের হিসেব যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, এই হিসেবই বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাজ্যের বড় অংশ তাঁদের দিকে রায় দিয়েছে। আর তাই তাঁদের ছাড়া সরকার গড়লে তা জনগণের মতের অমর্যাদা করা হবে। এই কথাটা পিডিপি বা ন্যাশনাল কনফারেন্স যাতে মাথায় রাখে, সেটাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে দিল্লির রাজনীতিকদের একাংশ।
অমিত শাহ এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কাশ্মীরে সরকারের অঙ্গ হতে বদ্ধ পরিকর। এ দিন সকালে ভোটের ফল বেরনো শুরু করার পরে অনেক বিজেপি নেতাই মনে মনে ধরে নিয়েছিলেন, জম্মু-কাশ্মীরে বিরোধী আসনে বসতে চলেছে দল। তেমন মানসিক প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুপুরে এই ভাবনাটাকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেন খোদ অমিত। জানিয়ে দেন, জম্মু-কাশ্মীরে ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলেও সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির কোনও প্রশ্ন নেই। একই সঙ্গে তিনি বুঝিয়ে দেন, বিরোধী আসনে বসার কথাও ভাবছেন না তাঁরা। হয় সরকার গড়বেন, নয়তো অন্য কারও সরকার হলে তাকে সমর্থন দেবেন। পরিস্থিতি বুঝে সেই সরকারে সামিলও হতে পারে বিজেপি। অর্থাৎ, ওমর আবদুল্লা বা মেহবুবা মুফতি, কেউই তাঁদের কাছে অচ্ছ্যুৎ নন। দর কষাকষির দরজা খোলা রেখে বিজেপি নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিলেন, যার সঙ্গে গেলে সুবিধাজনক জায়গায় থাকবে দল, তাকেই কাছে টেনে নেবে বিজেপি। যুক্তি হিসেবে বিজেপি বলছে, অতীতে এঁদের সকলের সঙ্গেই ঘর করেছে তারা। তাই আবার ঘর করতে সমস্যা নেই।
বস্তুত, বিজেপিকে বাদ রেখে জম্মু-কাশ্মীরে যে সরকার গঠন প্রায় অসম্ভব, সেটা বুঝতে পারছেন সংশ্লিষ্ট সকলেই। তবে পিডিপি থেকে ন্যাশনাল কনফারেন্স, সকলেই অমিত শাহদের হাত ধরা নিয়ে দ্বিধায়। ওমর আবদুল্লা তো আবার জানিয়ে দিয়েছেন, মেহবুবা সইদ যদি ডাকেন তবে তাঁরা দু’দল মিলে সরকার গড়তে পারেন। তিনি নীতীশ কুমার ও লালু প্রসাদের বন্ধুত্বের উদাহরণও দিয়েছেন। কিন্তু মেহবুবা এখনও কোনও বার্তা দেননি। তিনি কি বিজেপিকে বাদ দিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করবেন? উপত্যকায় এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy