প্রিয়ঙ্কা বঢরা ও উপেন্দ্র সিংহ
বাপের বাড়ির সঙ্কটে মেয়েরা পাশে দাঁড়াবে না, তা কি হয়!
হয়তো তাই, এই মুহূর্তে বহু রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু দুই বাবা-মায়ের ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন দুই মেয়ে। দু’জনেরই বাবা প্রধানমন্ত্রী। এক জন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর কন্যা প্রিয়ঙ্কা (আজ অবশ্য মায়ের সমর্থনে মুখ খুলেছেন তিনি)। অন্য জন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মেয়ে উপেন্দ্র সিংহ।
আর দু’জনের মাঝখানে মনমোহনের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারুর সেই বিতর্কিত বই ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’।
সনিয়া গাঁধীর হাতেই সরকারের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল বলে দাবি করে বারু লিখেছিলেন, “সনিয়া গাঁধী ছিলেন সুপার প্রাইম মিনিস্টার।” আজ সাংবাদিকরা তা নিয়ে প্রশ্ন করলে প্রিয়ঙ্কা ঝটিতি জবাব দিলেন, “একমাত্র মনমোহন সিংহই ছিলেন সুপার প্রাইম মিনিস্টার।” তবে প্রিয়ঙ্কা যেমন সঞ্জয় বারুর বই-বোমার মুখে মায়ের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা উপেন্দ্র কিন্তু শুধুই রক্ষণাত্মক পথে হাঁটেননি। বাবার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খণ্ডাতে গিয়ে সঞ্জয় বারুকে পরের পর পাল্টা তোপ দেগেছেন মনমোহন-তনয়া। বলেছেন, “আস্থার অমর্যাদা করেছেন সঞ্জয় বারু। এই ঘটনা পিছন থেকে ছুরি মারারই সামিল।”
এক সাক্ষাৎকারে উপেন্দ্র বলেছেন, “বারু চূড়ান্ত অনৈতিক কাজ করেছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর হয়ে কথা বলছি না। কিন্তু শোনা কথাকে লোকের মুখে বসিয়ে দিয়েছেন লেখক।” উপেন্দ্রর দাবি, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের গতিবিধি বারুর পক্ষে জানা কখনওই সম্ভব ছিল না। কারণ, বারুর স্তরের কোনও আমলার কাছে সেই সব ফাইল যায় না। উপেন্দ্রর খোঁচা, “উনি তো প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিব ছিলেন না।”
মনমোহন-কন্যার অবশ্য দাবি, বারু যে বইটি লিখছেন তা তিনি জানতেন। সম্প্রতি একটি বিয়েবাড়িতে এ ব্যাপারে তাঁদের কথাও হয়েছিল। বারু তখন বলেছিলেন, ভোটের পরেই বই বেরোবে। উপেন্দ্রর কথায়, “বারু যে কিছু গুজব আর অসমর্থিত বক্তব্য উদ্ধৃত করবেন, যার মধ্যে কয়েকটা আমার বাবার বক্তব্য হিসেবেও থাকবে, এটা জানতাম না।”
বইটি প্রকাশের সময় নিয়েও প্রশ্ন তোলেন উপেন্দ্র। তাঁর বক্তব্য, “যে ভাবে ভোটের মাঝে বইটি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে সেটি নিরপেক্ষ নয়।” পাশাপাশি তাঁর দাবি, বারু সম্প্রতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ২০০৯-এ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে আর বহাল হতে না পেরে তিনি অসন্তুষ্ট হন। স্বভাবতই, বইয়ে তিনি কী করে নিরপেক্ষ থাকবেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন উপেন্দ্র, যিনি নিজেও বেশ কয়েকটি বইয়ের রচয়িতা।
স্বভাবতই, ভোটের বাজারে দুই কন্যার এমন আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নিয়ে চর্চা হয়েছে ভালই। প্রিয়ঙ্কার মুখ খোলাকে অবশ্য প্রত্যাশিতই বলছেন অনেকে। কারণ, তিনি বহুদিন ধরেই রাজনীতিতে সক্রিয়। বস্তুত, আজ আরও একটি বিষয়ে মায়ের বিরুদ্ধে বিজেপির আক্রমণের জবাব দিয়েছেন প্রিয়ঙ্কা।
গত রাত থেকে জাতির উদ্দেশে সনিয়া গাঁধীর একটি বক্তৃতা টিভিতে বিজ্ঞাপনের আকারে দেখানো হচ্ছে। তাতে সনিয়া বলেছেন “এ বারের ভোট হল মতাদর্শ রক্ষার লড়াই। বিভাজনের রাজনীতি বনাম সনাতন সদ্ভাবের সংস্কৃতি।” তা নিয়ে আজ কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে নরেন্দ্র মোদী বলেন, “ছেলেকে দিয়ে আর হচ্ছে না বুঝে এখন মা নেমেছেন।” জবাবে প্রিয়ঙ্কাও বলেছেন, “বিজেপি যা ইচ্ছে বলুক, ভারতে সৌভ্রাতৃত্বের পরিবেশ রক্ষার লড়াই চলবে এই ভোটে।” এমনকী মতাদর্শের প্রশ্নে স্নেহভাজন খুড়তুতো ভাই বরুণের আরও এক দফা সমালোচনা করেছেন প্রিয়ঙ্কা।
তুলনায় মনমোহনের মেয়েরা কিন্তু বরাবরই নিজেদের জগৎ নিয়ে থেকেছেন। সংবাদমাধ্যম থেকে দূরত্ব বজায় রেখে গিয়েছেন। তা হলে এই সময়ে কেন মুখ খুললেন উপেন্দ্র?
অনেকের মতে, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বারুর বইয়ের বিষয়বস্তু আগাম জানতেন মনমোহন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়ার আগে তিনি সকলকে জানাতে চান যে, তিনি নিজে চাইলেও দল ও শরিকদের হস্তক্ষেপে সুশাসন কায়েম করতে পারেননি। এই ধারণাই কংগ্রেসে প্রবল অস্বস্তি তৈরি করেছে। ফলে এমনিতেই কংগ্রেসে কোণঠাসা মনমোহন এখন প্রায় খলনায়ক হয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, এই কারণেই বাবার হয়ে বার্তা দিতে নামলেন উপেন্দ্র। বোঝাতে চাইলেন, মিডিয়া উপদেষ্টাই বিশ্বাসঘাতকতা করলে কাকে ভরসা করবেন মনমোহন?
যদিও রাজধানীর অলিন্দের কারও কারও মতে, মনমোহন-কন্যার বক্তব্যে কিছুটা অসঙ্গতিও রয়েছে। কারণ, বারুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল যেত কি যেত না, ফাইলের সম্পর্কে খোঁজ রাখার কোনও সুযোগ তাঁর ছিল কি ছিল না, সে সব উপেন্দ্রর জানার কথা নয়। তাই এই অংশটি মনে করে, বারুর বক্তব্য খণ্ডন করতে পারতেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর সচিবালয়। কিন্তু মনমোহন নিজেকে বারুর স্তরে নামিয়ে আনতে চান না বলেই মেয়ের মাধ্যমে পরোক্ষে বার্তা দিতে চেয়েছেন। বাবার পক্ষে মেয়ে সওয়াল করলে তার অন্য একটি মাত্রাও থাকে। আবেগ! যার মূল্য ভারতীয় রাজনীতিতে রয়েছে।
রাজনীতিকরা অবশ্য মনে করছেন, এর পর উপেন্দ্রকে হয়তো আর খুব বেশি সরব হতে দেখা যাবে না। কিন্তু রাজীব-কন্যা সক্রিয় থাকবেন। গত দু’মাস ধরে রাহুল গাঁধীর বাসভবনে কংগ্রেসের ওয়ার রুম সামলাচ্ছেন প্রিয়ঙ্কা। এখন অমেঠি-রায়বরেলীর প্রচারের দায়িত্বও কাঁধে নিয়েছেন। বারাণসীতে মোদীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়াননি ঠিকই, কিন্তু কে বলতে পারে, গাঁধী পরিবারের হয়ে অচিরেই হয়তো তাঁকে বৃহত্তর ভূমিকায় দেখা যাবে।
তবে ভবিষ্যতে যা-ই হোক, রোজকার রাহুল-মোদী দ্বৈরথকে আজ অন্তত নিশ্চিত ভাবেই কিছুটা ঢেকে দিয়েছেন প্রিয়ঙ্কা-উপেন্দ্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy