Advertisement
১৭ মে ২০২৪

শাজাহান হয়েই লড়ছেন ঝাড়খণ্ডের গুরুজি

অনেকটা মুঘল সম্রাট শাজাহানের শেষ জীবনের গল্প। রাজ্যপাটের দায়িত্ব ছেলের হাতে। যেন আগরার কেল্লায় ‘নজরবন্দি’ হয়ে দিন কাটাচ্ছেন ক্ষমতাচ্যূত শাহেনশা। দুমকার এয়ারপোর্ট রোডের ওই বাড়িতে ঢোকার পর চোখের সামনে ভাসল ইতিহাসের সেই কাহিনীরই ‘কোলাজ’! ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। বাড়ির দেওয়ালে সবুজ রঙে লেখা তাঁর ছেলের নাম। সবুজ তাঁরই তৈরি দলের রঙ।

দুমকার বাড়িতে শিবু সোরেন। রাজকুমার উপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

দুমকার বাড়িতে শিবু সোরেন। রাজকুমার উপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
দুমকা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৫
Share: Save:

অনেকটা মুঘল সম্রাট শাজাহানের শেষ জীবনের গল্প।

রাজ্যপাটের দায়িত্ব ছেলের হাতে। যেন আগরার কেল্লায় ‘নজরবন্দি’ হয়ে দিন কাটাচ্ছেন ক্ষমতাচ্যূত শাহেনশা।

দুমকার এয়ারপোর্ট রোডের ওই বাড়িতে ঢোকার পর চোখের সামনে ভাসল ইতিহাসের সেই কাহিনীরই ‘কোলাজ’!

ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। বাড়ির দেওয়ালে সবুজ রঙে লেখা তাঁর ছেলের নাম। সবুজ তাঁরই তৈরি দলের রঙ। তির-ধনুক আঁকা সবুজ পতাকাতেও তাঁর মুখ। লোহার ফটক পেরিয়ে বাড়ির উঠোনে পৌঁছে ভিড় ঠেলে এগোতেই দূর থেকেই দেখা গেল সাঁওতাল পরগনার ‘দিশম গুরু’কে।

তিনি শিবু সোরেন। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার (জেএমএম) প্রতিষ্ঠাতা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই নেতা এখন বৃদ্ধ। যত্ন করে আঁচড়ানো কাঁচা-পাকা চুল নেমে গিয়েছে ঘাড় পর্যন্ত। পাকা দাড়িও পরিপাটি। বেগুনি পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাঝেমধ্যে হাত যাচ্ছিল সাদা গোঁফে। কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলছিলেন না। কেউ সামনে দাঁড়ালে ঘোর লেগে থাকা চোখে তাকাচ্ছিলেন। প্রণাম করলে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ। ব্যস শুধু এটুকুই।

দূর থেকেই দেখা গেল, পরিচিত এক অনুগামীর মোবাইল ফোন চেয়ে নিলেন গুরুজি। সেই যুবকই পরে জানালেন, মোবাইলে নিজের যৌবনের সময়ের ছবি দেখছেন। হয়তো মনে পড়ছিল পুরনো দিনের ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের কথা। কিন্তু তাঁকে এ সব সরাসরি জিজ্ঞাসা করার কোনও উপায় নেই। অন্তত সংবাদ মাধ্যমের কোনও প্রতিনিধির তো নয়ই। বাড়ির অন্দরমহল থেকে নির্দেশ না-মিললে, তাঁর সঙ্গে কথা বলা অসম্ভব। অনুমতি পাওয়া গেলেও প্রশ্নোত্তর-পর্বের সময় অন্দরমহলের কেউ গুরুজির পাশে ঠায় বসে থাকবেন।

অন্দরমহলের নির্দেশের অপেক্ষায় সকাল থেকে এয়ারপোর্ট রোডের ওই বাড়িতে বসেছিলেন সাঁওতাল পরগনার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের জনাবিশেক সাংবাদিক। কানাঘুষোয় শোনা গেল, দিশম গুরু নন, জেএমএম এখন নিয়ন্ত্রিত হয় বাড়ির ভিতরের ওই ঘর থেকেই।

সেখানেই যে থাকেন শিবুর ছেলে হেমন্ত সোরেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক পরামর্শদাতারা।

জেএমএম শিবিরের খবর, দলে এখন দু’রকম চিন্তাধারার মানুষ। এক পক্ষের লোক গুরুজি-পন্থী। যাঁরা শিবুর মতোই সাধারণ জীবনযাপন করেন। ভোটের সময় শিবুর প্রচারে গ্রামে গ্রামে ছুটে যান। অন্য পক্ষ মুখ্যমন্ত্রী হেমন্তের তরফে। যাঁদের বিলাসবহুল গাড়ির সারি দাঁড়িয়ে থাকে রাঁচিতে জেএমএম-এর দলীয় কার্যালয়ের বাইরে।

মতাদর্শের ওই ফারাকেই এ বার ভোটের আগে ঘর ভেঙেছে জেএমএম-এর। দলের পুরনো দুই বিধায়ক গিয়েছেন বিজেপি-তে। শিবুর ঘনিষ্ঠ বিধায়ক তথা রাজ্যের এক সময়ের মন্ত্রী সাইমন মরান্ডি যোগ দিচ্ছেন ঝাড়খণ্ড বিকাশ মোর্চায় (জেভিএম)। সাইমনের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন গুরুজি। অস্বস্তিতে পড়তে হয় দলের ‘বর্তমান’ নেতৃত্বকে। দুমকা আসনে বিরোধী সেই জেভিএমের শীর্ষ নেতা বাবুলাল মরান্ডির বিরুদ্ধেই লোকসভা ভোটে লড়বেন গুরুজি। অতীতে এক বার বাবুলালের কাছে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। এ বারের ফলাফল নিয়ে তাই সংশয় রয়েছে জেএমএম শিবিরেও।

ঘড়িতে দুপুর বারোটা। দুমকার ‘চেম্বার অব কমার্স’-এর প্রতিনিধিরা গিয়ে বসলেন গুরুজির সামনে। মিনিট কয়েকের সৌজন্য বিনিময়। তারপরই তাঁরা ঢুকে গেলেন ভিতরের ঘরে। দলের এক নেতা এসে বললেন, “গুরুজির শরীর খারাপ। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। সব কিছু মনেও থাকে না। বেফাঁস কিছু বলে ফেললে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। পাণ্ডেজির নির্দেশ পেলেই গুরুজির সঙ্গে কথা বলা যাবে।”

স্পষ্ট হল, নিজের বাড়িতে এখন কার্যত ‘নজরবন্দি’ জেএমএম-প্রধান।

আরও এক ঘণ্টা পর বের হলেন সেই ‘পাণ্ডেজি’। ডাক পড়ল সংবাদ মাধ্যমের। সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্ন পছন্দ না-হলে তাঁর মুখের রেখাগুলো কঠিন হচ্ছিল।

ছেলেই তো এ বার সব কিছু করছে? প্রশ্ন শুনে কিছুটা অন্যমনস্ক দেখাল শিবুকে। প্রায় অস্পষ্ট স্বরে জবাব মিলল, “ভালই করছে। আচ্ছা হি কর রহা হ্যায়।” সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন পাণ্ডেজি, “শুনলেন তো, ছেলে ভাল কাজ করছে। গুরুজি এখন প্রচারে বের হবেন।” সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তা সেখানেই শেষ।

লোকসভার কয়েক মাস পরই ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচন। জেএমএম-এর দিকে জনসমর্থন টানতে এখনও ভরসা গুরুজিই। তাই অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গে দেড়শোর বেশি জনসভায় তাঁকে যেতে হয়েছে। অশক্ত শরীরে উঠতে হচ্ছে হেলিকপ্টারে।

বাড়ির সামনে গাড়ি তৈরি। তাতে তুলে দেওয়া হল গুরুজিকে। একা বসে রইলেন কিছু ক্ষণ। খোঁজ শুরু হল গাড়ির চালকের। ধারে কাছে যেতে দেওয়া হল না সাংবাদিকদের। পাণ্ডেজিই চালককে ডেকে নিয়ে এলেন। বসলেন গুরুজির পাশে। প্রচারে বেরিয়ে গেলেন গুরুজি।

নজরবন্দি শাজাহান। সম্রাট বৃদ্ধ হয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

prabal ganhyopadhyay shibu soren dumka
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE