ধর্মান্ধতার ঘেরাটোপ থেকে বার করে দেশকে একটা নতুন পথ দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। চার দেওয়ালের গণ্ডি ভেঙে সকলের সঙ্গে এক সারিতে আনতে চেয়েছিলেন মেয়েদের। বিজ্ঞানের অগ্রগতি যে কোনও দিন ধর্মের রাস্তায় বাধা হতে পারে না, এই বিশ্বাসে তৈরি করেছিলেন ‘ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।’ তিনি সৌদি আরবের রাজা আবদুল্লা বিন আবদুলাজিজ আল সৌদ। ৯০ বছর বয়সে শুক্রবার জীবনাবসান হল তাঁর।
ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে ৩১ ডিসেম্বর রিয়াধের একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আজ ভোররাত থেকেই স্থানীয় সব টিভি চ্যানেলে কোরান পাঠ শুরু হয়ে যায়। রাজপরিবারের কারও মৃত্যুসংবাদ এ ভাবেই দেওয়া হয় সৌদি আরবে। তার পর আবদুল্লার সৎভাই সলমন মৃত্যুসংবাদটি ঘোষণা করেন। আবদুল্লার মৃত্যুর পরে এই সলমনই সিংহাসনে বসলেন। অসুস্থ আবদুলাজিজের মৃত্যুসংবাদ অপ্রত্যাশিত নয়। তবু খবর পেয়ে শোকস্তব্ধ হয়ে যায় গোটা দেশ। সাধারণ মানুষের মুখে শোনা যায় খেদোক্তি, “আমরা আমাদের আপনজনকে হারালাম!” তবে সুন্নি মুসলিম প্রথা মেনে দেশে কোনও রকম শোকপালন করা হয়নি। অর্ধনমিত করা হয়নি জাতীয় পতাকাও। আজই রাজার অন্ত্যেষ্টি হয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই রাজা আবদুল্লার মৃত্যুতে খুশি বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী। সোশ্যাল মিডিয়াতে উদ্যাপনও শুরু করে দিয়েছে তারা। আবদুল্লা বরাবরই কঠোর হাতে সন্ত্রাসদমন করে এসেছেন। অবশ্য জঙ্গিদমন নীতির আড়ালে তিনি হামেশাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন, এ রকম অভিযোগও শোনা গিয়েছিল। আবদুল্লা প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আজ বলেন, “নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন নির্ভীক ও আত্মবিশ্বাসী।” আমেরিকার সঙ্গে বরাবরই বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখে চলতেন আবদুল্লা। তাই ৯/১১-র হামলার পরে যখন জানলেন যে ১৯ জন জঙ্গির মধ্যে ১৫ জনই তাঁর দেশের সেটাই বোধহয় সব চেয়ে কঠিন সময় ছিল সৌদি রাষ্ট্রনেতার!
আর এখন? সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়াই আপাতত সৌদি আরবের সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। উত্তরে আইএস-এর আগ্রাসন আর দক্ষিণে ইয়েমেনে আল কায়দার বাড়বাড়ন্ত এই দুইয়ের ফাঁকে সৌদি আরবের অবস্থা এখন বড়ই সঙ্গিন। তা ছাড়া, আরব দুনিয়ায় আধিপত্য কায়েমের জন্য বহু দিন ধরেই ইরানের সঙ্গে টক্কর চলছিল সৌদি আরবের। আজ দায়িত্ব নিয়েই রাজা সলমন বার্তা দেন, “রাজা আবদুল্লার দেখানো পথ থেকে আমরা সরব না। তাঁর চালু করা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ নীতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা হবে।”
ছোট থেকেই বাবা আবদুল আজিজের কঠিন শাসনে মানুষ আবদুল্লা। বাবা সন্তানদের এমন শিক্ষা দিয়েছিলেন, যাতে তারা খালি পায়ে হাঁটতে পারে, ভোর হওয়ার দু’ঘণ্টা আগেই ঘুম থেকে উঠতে পারে বা জিন ছাড়াই ঘোড়ায় চড়তে পারে। আসলে শৈশব থেকে কঠিন পরিস্থতিতে মেরুদণ্ড সোজা করে রাখার শিক্ষাই আবদুল্লা পেয়ে এসেছেন। রাজা আবদুল আজিজকে বলা হতো ‘সৌদি আরবের জনক’। ১৯৫৩ সালে মারা যান তিনি। তার পর একের পর এক সিংহাসনে বসেছেন তাঁর ৪৫ জন ছেলের কেউ না কেউ। ২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসেন আবদুল্লা। অবশ্য তৎকালীন রাজা ফাহিদের দীর্ঘ অসুস্থতার জন্য তার ১০ বছর আগে থেকেই বকলমে দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন তিনি। মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে হেঁটে বারবার পদক্ষেপ করার জন্য তাঁকে ‘আধুনিক সৌদি আরবের রূপকার’ তকমা দেওয়া হয়।
মৌলবাদী চিন্তা-ভাবনার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পিছপা হননি আবদুল্লা। আল কায়দার বিরোধিতা করেছিলেন। পাঠ্যবইয়ের কট্টরপন্থী ভাষায় পরিবর্তন এনেছিলেন। প্রায় ৯০০ জন ইমামকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তবে কট্টরপন্থী মতবাদের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছেন বেশ কয়েক বার। প্রশাসনিক স্তরে কিছু পরিবর্তন আনলেও স্রোতের বিরোধীতা খুব একটা করেননি।
তাই সিরিয়া-ইরাকের বহু অংশে আইএস যখন হামলা চালিয়েছে, তিনি ছিলেন প্রায় নীরব।
সৌদি আরবের প্রেক্ষিতে তাঁর বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতিহাস মনে রাখবে। মেয়েদের ধর্মের ঘেরাটোপ থেকে কিছুটা বার করে এনেছিলেন। তাঁর আমলেই মহিলারা দোকানে বসে জিনিসপত্র বিক্রি করেছেন, এমন কী, এক মহিলা মন্ত্রীও হয়েছেন। তবে, সব আশ্বাস পূরণ করতে পারেননি রাজা। ২০০৫ সালে একটি সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, কিছু দিনের মধ্যেই দেশে গাড়ি চালাতে পারবেন মহিলারা, সৌদি আরবে যেটি গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ। তাঁর এই মন্তব্য আলোড়ন ফেলেছিল দেশ-বিদেশে। শেষ পর্যন্ত কথা রাখতে পারেননি তিনিও।
আশ্বাস দিয়েছিলেন, মহিলারা ভোটে প্রার্থী হতে পারবেন। সেই কথাও রাখতে পারেননি।
তেলের দাম বাড়ালেও তিনি কখনওই তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে চাননি। আবার সৌর শক্তি নিয়ে গবেষণাতেও ব্যয় করেছেন প্রচুর। ধর্ম-সহিষ্ণুতা বাড়াতে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মগুরুদের নিয়ে ২০০৮ সালে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু সৌদি আরবে তো ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও ধর্মের আচার পালন করা নিষিদ্ধ। তাই সম্মেলনটির আয়োজন করেছিলেন স্পেনের মাদ্রিদে। আসলে, কখনও স্রোতের সঙ্গে, কখনও বা তার বিপরীতে হেঁটে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে রাজত্ব চালানোই ছিল আবদুল্লার প্রধান নীতি।
ক্ষমতায় এসে নতুন রাজা সলমন যে বৈপ্লবিক কিছু করে বসবেন না, তা অনুমান করা যেতেই পারে। শুধু প্রাক্তনের দেখানো পথে চলে বর্তমান সমস্যার সমাধান তিনি কী ভাবে করেন, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy