Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
শিশুমেধ

পরনে সেনার পোশাক, ছয় জঙ্গি ঢুকে পড়ল ক্লাসঘরে

ছেলেমেয়েগুলোর পরনে স্কুলের পোশাক। রোজকার মতো ফিটফাট হয়ে স্কুলেই গিয়েছিল ওরা। ফিরল কাঠের বাক্সে শুয়ে। কারও বুক, কারও মাথা ফুঁড়ে দিয়েছে জঙ্গিদের গুলি। পাকিস্তানে জঙ্গি নাশকতা কোনও নতুন ঘটনা নয়। বিশেষ করে পেশোয়ার, করাচি, ওয়াজিরিস্তান বা সোয়াট উপত্যকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই নাশকতার ঘেরাটোপে বসবাস করছেন। কিন্তু মঙ্গলবার পেশোয়ারের সেনা স্কুলে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) জঙ্গিরা ঠান্ডা মাথায় যে নারকীয় শিশুমেধ ঘটাল, সেটা পাকিস্তানের কাছেও নজিরবিহীন।

স্কুল থেকে এই ভাবেই ফিরল ছেলে। ছবি: রয়টার্স

স্কুল থেকে এই ভাবেই ফিরল ছেলে। ছবি: রয়টার্স

সংবাদ সংস্থা
পেশোয়ার শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

ছেলেমেয়েগুলোর পরনে স্কুলের পোশাক। রোজকার মতো ফিটফাট হয়ে স্কুলেই গিয়েছিল ওরা। ফিরল কাঠের বাক্সে শুয়ে। কারও বুক, কারও মাথা ফুঁড়ে দিয়েছে জঙ্গিদের গুলি।

পাকিস্তানে জঙ্গি নাশকতা কোনও নতুন ঘটনা নয়। বিশেষ করে পেশোয়ার, করাচি, ওয়াজিরিস্তান বা সোয়াট উপত্যকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই নাশকতার ঘেরাটোপে বসবাস করছেন। কিন্তু মঙ্গলবার পেশোয়ারের সেনা স্কুলে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) জঙ্গিরা ঠান্ডা মাথায় যে নারকীয় শিশুমেধ ঘটাল, সেটা পাকিস্তানের কাছেও নজিরবিহীন। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কন্যা মরিয়ম তাই বলে উঠছেন, “এত বড় ট্র্যাজেডি আমাদের দেশ বোধহয় আগে দেখেনি।” একসঙ্গে ১৩৩টি সন্তানহারা বাবা-মায়ের আর্ত শোক এ ভাবে আকাশবাতাস খানখান করে দেয়নি।

জনস্মৃতিতে হানা দিচ্ছে ৯ অক্টোবর, ২০১২। সোয়াট উপত্যকার একটি স্কুলবাসে উঠে সে দিন জঙ্গিরা গুলি করেছিল ১৫ বছরের কিশোরী মালালা ইউসুফজাইকে। মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিল সে। তালিবানি হুমকি অগ্রাহ্য করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার লড়াই থেকে সরে আসেনি। গত সপ্তাহেই নোবেল শান্তি পুরস্কার হাতে নিয়েছে মালালা। এ দিনের আক্রমণ যেন তারই প্রতিশোধ, বলছেন দেশবিদেশের বহু মানুষই।

মালালাকে ‘ইসলামি সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা সেনানী’ বলে মনে করে টিটিপি। তাদের মুখপাত্র মহম্মদ উমর খোরাসানি বলেছিল, “শিক্ষা-টিক্ষা সব বাজে কথা, মালালার আসল কাজ হল পশ্চিমের হয়ে প্রচার করা।” এ দিনও টিটিপি-র হয়ে মুখ খুলেছে সেই খোরাসানি-ই। মালালার নাম অবশ্য মুখে আনেনি আজ। শুধু বলেছে, পাক সেনাবাহিনীকে চরম শিক্ষা দিতেই তাদের এই হামলা। তার বক্তব্য, “উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সেনা-অভিযান (জর্ব-এ-আজব) চালিয়ে যারা ভেবেছিল আমাদের শেষ করে দেওয়া যাবে, এই উপহার তাদের জন্য। সরকার আমাদের পরিবারের উপরে চড়াও হয়েছে। তাই আক্রমণের জন্য সেনা স্কুলটাই বেছে নিয়েছি আমরা। ওরাও বুঝুক, যন্ত্রণা কাকে বলে।” খোরাসানি এও দাবি করেছে, একটু বড় বয়সী পড়ুয়াদের হত্যা করাই নাকি জঙ্গিদের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অত বাছবিচার করা যায়নি। ফলে শিশু থেকে কিশোর, আক্রান্ত সকলেই।

পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলটা ওয়ারসাক রোডের উপরে। একটু পিছনেই সামরিক অফিসারদের আবাসন। স্কুল ছাড়িয়ে কিছুটা এগোলে সেনা স্টেডিয়াম। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ নিয়মমাফিক স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গিয়েছিল এ দিন। কোথাও শুরু হয়ে যায় ক্লাস, কোথাও পরীক্ষা, কোথাও অন্য অনুশীলন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী মিলিয়ে ভিতরে ছিলেন অন্তত ৫০০ জন। পড়ুয়াদের বয়স গড়পড়তা ১০-১৮। এক ফাঁকে স্কুল-লাগোয়া কবরখানা হয়ে পিছন দিককার গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল ছ’জন। ওই জায়গাটা এমনিতেই ফাঁকা ফাঁকা। তার সঙ্গে পরনে ফৌজি উর্দি থাকায় আলাদা করে সন্দেহ করেনি কেউ।

এক জঙ্গির শরীরে বাঁধা ছিল বিস্ফোরক। প্রথমে সে-ই ঢোকে একটা ক্লাসঘরে। মুহূর্তখানেক পরেই বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ। নিমেষে জ্বলে খাক হয়ে গেল ৬০ জন ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকের দেহ। জঙ্গিটিও। গোটা স্কুল তখন কাঁপছে দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়া আওয়াজে, আতঙ্কে। বাকি জঙ্গিরাও তত ক্ষণে তাদের ‘কাজ’ শুরু করে দিয়েছে। যে যেমন পারছে ঢুকে পড়ছে এক-একটা ঘরে, গুলি চালাচ্ছে। জ্বালিয়ে দিচ্ছে। প্রতিরোধ করতে এলে ঢাল করে নিচ্ছে বাচ্চাদেরই। একটা ক্লাসে পড়ুয়াদের চোখের সামনেই জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল এক শিক্ষককে। আবার অন্য ঘরগুলোয় টিপ করে বাচ্চাদের বুক আর মাথায় গুলি চালাচ্ছিল বাকি জঙ্গিরা।

আগের দিনই অস্ট্রেলিয়ায় সিডনির লিন্ড কাফেতে ষোলো ঘণ্টা ধরে জঙ্গি অবরোধ দেখেছিল সারা পৃথিবী। সেই বিহ্বলতার ঘোরটুকু না কাটতেই আজ সকালে যে আরও ভয়ানক দৃশ্য অপেক্ষা করছে, তা কেউই ভাবেনি তখনও। কিন্তু স্কুলের ভিতর থেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ আসতেই হইহই পড়ে যায়। আধ ঘণ্টার মধ্যে স্কুলের সামনে হাজির হয়ে যায় পাক সেনা।

গোটা স্কুলবাড়ি ঘিরে ফেলে তারা। আকাশে চক্কর কাটতে শুরু করে সেনা কপ্টার। কিন্তু হলে কী হবে, নিহতের সংখ্যা তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এলাকা জুড়ে শুধু কালো ধোঁয়া আর বোমার শব্দ। অনেকেই জানাচ্ছেন, অন্তত দশটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গিয়েছে স্কুল থেকে। তার একটি অবশ্য ঘটিয়েছে সেনাই। কারণ স্কুলের একটি দেওয়াল উড়িয়ে দিয়ে স্কুলে ঢুকতে হয়েছিল তাদের। এর পরে জঙ্গি-সেনা লড়াই চলেছে টানা সাত ঘণ্টা। জখম পড়ুয়া বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। কেউ কেউ বেরিয়ে আসতে পেরেছেন অক্ষত দেহেও। দিনের শেষে পাক সেনার মুখপাত্র আসিম বাজওয়া জানান, মারা পড়েছে পাঁচ জন জঙ্গি। এক জন আগেই নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছিল।

পাক সেনার হিসেব বলছে, এ দিন প্রাণ হারিয়েছেন মোট ১৫১ জন। সেনার মতে, অল্প সময়ে অনেক বেশি প্রাণ নেওয়াই লক্ষ্য ছিল জঙ্গিদের। পণবন্দি করার পরিকল্পনা করে ওরা ঢোকেনি। সেনারা যাতে সহজে ঢুকতে না পারেন, তার জন্যই শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে হত্যালীলা চালিয়ে গিয়েছে জঙ্গিরা।

২০০৭ সাল থেকে টিটিপি পাকিস্তানে শয়ে শয়ে মানুষ মেরেছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে এই পেশোয়ারেই একটি গির্জায় অসংখ্য শিশু-সহ বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে তারা। গত বছরই শেষ দিকে মার্কিন ড্রোন হানায় নিহত হয় তেহরিক ই তালিবানের নেতা হাকিমুল্লা মেহসুদ। তার পরে এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের উত্তর-পশ্চিমে টিটিপি-র ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্রমাগত বোমারু বিমান থেকে আঘাত শুরু করে আমেরিকা। এর পরে জুন থেকে টিটিপি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক অভিযান শুরু করে পাক সেনাও। সব মিলিয়ে নানা দিক থেকেই কোণঠাসা হতে শুরু করেছিল টিটিপি। তাই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে বড়সড় কিছু ঘটানোর অপেক্ষায় ছিল। শেষমেশ যার বলি হল একশোরও বেশি নিরপরাধ শিশু। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তালাত মাসুদ বলছেন, “কৌশলগত ভাবে জঙ্গিরা এই হামলা চালিয়েছে। তাই সেনার পরিজনদের মেরে তাঁদের মানসিক ভাবে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করছে ওরা।” অপারেশন শেষে এ দিন সেনা অফিসাররা যখন স্কুল থেকে বেরোচ্ছেন, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন তাঁরা।

গত সপ্তাহেই একটি রিপোর্টে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছিল, ২০১৪ সালটা শিশুদের জন্য অন্যতম খারাপ বছর। তবে সেই পর্যবেক্ষণ ছিল পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার কথা মাথায় রেখে। আজ পেশোয়ারে যা ঘটল, তাতে এ বার হয়তো পাকিস্তানের নামটাও জুড়বে। ২০১০ সাল থেকে এক হাজারেরও বেশি স্কুল ধ্বংস করেছে তালিবান। কিন্তু আজ যে ভাবে বেছে বেছে শিশুদের হত্যা করা হল, এমন জঘন্য নজির পাকিস্তানেও তেমন নেই। দেশে তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। রাজধানী ইসলামাবাদ ছেড়ে আজই পেশোয়ারে রওনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। বলেছেন, “আমি এখানে বসে থাকতে পারব না। ওরা আমার সন্তান, এটা জাতীয় বিপর্যয়।”

নওয়াজকে এ দিন রাতে ফোন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। তার আগেই নিজের নিন্দা-বার্তায় মোদী বলেন, “এই নারকীয়তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। স্বজনহারা সবার পাশে আছি।” দিনের শেষে তিনি নওয়াজকেও বলেছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত সঙ্গে আছে। একই বার্তা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং মর্মাহত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।

তালিবানের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান বন্ধ হবে না বলেই জানাচ্ছে পাকিস্তানও। প্রধানমন্ত্রী শরিফের কথায়, “জর্ব-এ-আজব চলবেই। আমাদের লড়াই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছে। আমাদের পাশে থাকুন।” যদিও এই হামলার পরে পাক সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে কিছুটা ধন্দ তৈরি হয়েই যাচ্ছে। কারণ তালিবান আজ যাদের নিশানা করেছে, তাদের অনেকেই পদস্থ সেনা অফিসারের পুত্র বা কন্যা। মাত্র দু’মাস আগেই দায়িত্ব নেওয়া পাক গুপ্তচর সংস্থার প্রধান রিজওয়ান আখতারও কিছুটা কোণঠাসা। কারণ রাজনৈতিক স্তরে আইএসআইয়ের সঙ্গে পাক সেনাবাহিনীর আঁতাঁত সুবিদিত। আবার গত দশ বছরে টিটিপি-র বাড়বাড়ন্তেও আইএসআই-এর প্রচ্ছন্ন মদতকে উড়িয়ে দিতে চান না পাক-বিশ্লেষকরা। তাই সেই টিটিপিই যখন সেনাবাহিনীর পরিজনদের হত্যার পথ বেছে নেয়, তখন স্বভাবতই আঙুল উঠবে আইএসআইয়ের দিকে। এই দ্বন্দ্বে দুই প্রতিষ্ঠান কোন পথে এগোয়, দেখতে চান কূটনীতিকরা।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE