Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
International

ভারত-পাক সংঘাতের নয়া কেন্দ্র চিরবিদ্রোহী বালুচিস্তান

জাতিস্মরের সন্ধানে গিয়ে মন্দার বসু ‘দ্বিতীয়’ মুকুলকে বলেছিলেন, যে তাঁরা বালুচিস্তান থেকে আসছেন, তাই কলকাতার রাস্তাঘাট ভাল চেনেন না! সোনার কেল্লা ছবির অনেক দৃশ্য এবং সংলাপের মতোই এটিও চার দশক আগে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছিল। তবে সেই বালুচিস্তানের উল্লেখ ছিল নেহাতই মজামাখানো!

বালুচ বিদ্রোহীরা। ছবি-ইন্টারনেট।

বালুচ বিদ্রোহীরা। ছবি-ইন্টারনেট।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৬ ২১:০৫
Share: Save:

জাতিস্মরের সন্ধানে গিয়ে মন্দার বসু ‘দ্বিতীয়’ মুকুলকে বলেছিলেন, যে তাঁরা বালুচিস্তান থেকে আসছেন, তাই কলকাতার রাস্তাঘাট ভাল চেনেন না!

সোনার কেল্লা ছবির অনেক দৃশ্য এবং সংলাপের মতোই এটিও চার দশক আগে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছিল। তবে সেই বালুচিস্তানের উল্লেখ ছিল নেহাতই মজামাখানো!

সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান কূটনৈতিক দ্বৈরথে কিন্তু সেই বালুচিস্তানের প্রসঙ্গই ফিরে ফিরে আসছে, যেখানে শুধুই রক্তপাত, সংগ্রাম এবং বারুদের গন্ধ। কাশ্মীরের পাল্টা দিতে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যে পাটকেলটি ছুড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তা সেই বালুচিস্তান সংক্রান্ত। যেখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে স্বাধীনতার পর থেকেই কার্যত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের সেই গলার কাঁটাটিকে উস্কে দিয়ে লালকেল্লা থেকে কার্যত বালুচবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তাই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, অদূর ভবিষ্যতে এই বালুচিস্তান হয়ে উঠতে চলেছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের নতুন একটি সংঘর্ষবিন্দু।

প্রকাশ্যে বালুচ প্রসঙ্গ তুলে ধরে, সেখানকার পাক-সরকার বিরোধী আন্দোলনে ভারতের ভূমিকার কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন ভারতীয় নেতৃত্ব। এই পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে ভারতকে অদূর ভবিষ্যতে চরম বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলতে চলেছে কি না তা নিয়ে দেশের ভিতরেই শুরু হয়ে গিয়েছে বিতর্ক। সেই বিতর্ক এবং রাজনৈতিক চাপানউতোর চলতেই থাকবে। কিন্তু তারই ফাঁকে এক বার দেখে নেওয়া যাক বালুচিস্তানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাসটিকে।

১৬৬৬ সালে আফগান সাম্রাজ্যের অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত কালাট প্রদেশের (যা আজকের বালুচিস্তান) পত্তন যা পরে ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ দখল করে নেয়। এই কালাট প্রদেশই আজকের বালুচিস্তান। সেখানকার খান, সর্দার এবং কালাট (আদি বাসিন্দা) এই তিনটি গোষ্ঠী এরই মধ্যে নিজেদের মধ্যে অস্তিত্বরক্ষার যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ব্রিটিশরা যথারীতি চালিয়ে যায় তাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি। বিশ শতকের গোড়ায় শিক্ষিত বালুচেরা ব্রিটিশ মুক্ত বালুচিস্তানের জন্য লড়াই শুরু করে। ১৯৩১ সালে তৈরি হয় স্বাধীনতাকামী জিহাদি সংগঠন ‘আঞ্জুমান–ই-ইত্তেহাদ-ই বালুচিস্তান’। এই আঞ্জুমান পরবর্তী সময়ে নাম বদলে হয় কালাত স্টেট ন্যাশনাল পার্টি বা (কেএসএনপি)। কেএসএনপি-কে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পর তাদেরই কিছু নির্বাসিত নেতা বেরিয়ে গিয়ে তৈরি করেন বালুচিস্তান মুসলিম লিগ, যারা মুসলিম লিগের শরিক দল হিসাবেই নিজেদের ঘোষণা করে।

সমস্যার সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালের পর যখন বালুচিস্তানের চারটি করদ রাজ্যের মধ্যে তিনটি (মাকরান, লাস বেলা, খারান) পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। চতুর্থ প্রদেশ কালাটের খান নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে বসে। মহম্মদ আলি জিন্না অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করেন যাতে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে চলে আসে, কিন্তু কালাটের খান আহমেদ ইয়ার খান সময় চেয়ে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখেন। ধৈর্য হারিয়ে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান কালাটকে তার অধীনস্থ হিসাবে ঘোষণা করে। এপ্রিলে সামরিক অভিযান হয়। যুদ্ধে হেরে গিয়ে আহমেদ ইয়ার খান সন্ধিচুক্তি সই করেন ঠিকই কিন্তু তার দু’ভাই আঘা আবুদিল করিম বালুচ এবং মহম্মদ রাহিম বন্দুক নামাতে রাজি হন না। পাকিস্তান সেনার উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন।

এর পর বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের স্রোত ক্রমশ বেড়েছে বই কমেনি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে পাকিস্তান সরকারকে বালুচিস্তানের স্থানে স্থানে নতুন সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে হয়েছে। ’৭৩ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ফের সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন বালুচিস্তানে। সেখানকার প্রাদেশিক সরকারকে ফেলে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা হয়। দমন যত বাড়ে ততই বাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গেরিলা আক্রমণের ধার।

২০০৪ সালে গদর বন্দরে হামলা করে জিহাদিরা, নিহত হন সেখানে কর্মরত বেশি কিছু চিনা ইঞ্জিনিয়ার। বালুচ জাতীয় আন্দোলনের তৎকালীন নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি (যার নাতি বালুচ আন্দোলনের বর্তমান নেতা) পনেরো দফা দাবি সনদ পাঠান পাক সরকারকে। যার মধ্যে ছিল বালুচিস্তানের সম্পদ এবং প্রশাসনের বৃহত্তর অধিকার, পাক সেনাবাহিনীর দূর হঠার মতো বিষয়গুলি। কিন্তু রাজনৈতিক দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া দূরস্থান, পাক সামরিক অভিযান এবং তার মোকাবিলা— অর্থাৎ, গৃহযুদ্ধ বেড়ে যায়। ২০০৬ সালের অগস্টে আকবর খান বুগতি খুন হন পাক সেনার হাতে। সেই সঙ্গে প্রাণ হারান ৬০ জন পাক সেনা এবং ৭ জন অফিসার।

মূলত এই সময় থেকেই ইসলামাবাদ অভিযোগ করতে শুরু করে, বালুচ জঙ্গিদের এই সামরিক সক্রিয়তায় ভারতের মদত রয়েছে। ভারতীয় নৌসেনার প্রাক্তন কমান্ডার কূলভূষণ যাদবকে পাকস্তান সে দেশ থেকে গ্রেফতার করে প্রচার করে যে তিনি আসলে বালুচ বিদ্রোহে মদত দিতে ভারতের হয়ে চরবৃত্তি করছিলেন। এই সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ তারা কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনকেও দেয়, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি।

আরও পড়ুন- ঢাকায় জেএমবি নেত্রী সহ চার ছাত্রী গ্রেফতার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Baluchistan India PM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE