আতঙ্কের ছুট। বুধবার দুবাই বিমানবন্দরে পিটিআইয়ের ছবি।
কাঁটায় কাঁটায় বেলা পৌনে ১টা। পরিষ্কার আকাশ, ঝকঝকে রানওয়ে। ৩০০ সওয়ারি নিয়ে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামছিল তিরুঅনন্তপুরম থেকে আসা এমিরেটসের বোয়িং ৭৭৭।
বড়জোর কয়েক সেকেন্ডের ফাঁক। পাক খেয়ে ওঠা ধোঁয়া ছড়িয়ে সেই বিমান যখন রানওয়েতে ঘষটাতে ঘষটাতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনও অনেকে বুঝে উঠতে পারেননি, ঠিক কী ঘটে গেল এইটুকু সময়ে। বিমান পুরোপুরি থামার পর খুলে গেল আপৎকালীন দরজাগুলো। পিলপিল করে বেরিয়ে আসা মানুষগুলো ছড়িয়ে পড়লেন রানওয়ে জুড়ে।
তত ক্ষণে আগুন পুরোপুরি গিলে ফেলেছে বিমানটাকে। হঠাৎ কানফাটানো বিস্ফোরণ। লাফ দিয়ে উঠল আগুনের শিখা। ওই এক মুহূর্তেই দেখা গেল, বিমানের ছাদটা উড়ে বেরিয়ে গেল বিস্ফোরণের দাপটে। বিমানবন্দরের দমকলগুলো আগুন পুরোপুরি নেভানোর পর দেখা গেল, পড়ে রয়েছে বিমানের একটা আস্ত কঙ্কাল।
তার পরেও স্বস্তি!
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে দিলেন, এমিরেটসের বিমানের ২৮২ জন যাত্রী এবং পাইলট ও বিমানকর্মী মিলিয়ে ১৮ জনের প্রত্যেকেই নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। যদিও রাতের দিকে জানা যায়, আগুন নেভাতে গিয়ে মারা গিয়েছেন দুবাইয়ের এক দমকলকর্মী। দুই বিমানকর্মী-সহ মোট ২২৬ জন ভারতীয় ছিলেন বিমানে। ছিল সাতটি শিশুও। অক্ষত প্রায় সকলেই। শুধু আগুনে অল্পবিস্তর পোড়া ও ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়া জনা দশেক যাত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করাতে হয়েছে। ভর্তি করতে হয়েছে এক জনকে।
স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটা উঠেছে তা হল— ঠিক কী হয়েছিল বিমানে? দুবাইয়ে নামার আগে কোনও গণ্ডগোল কি ধরা পড়েছিল? এমিরেটসের তরফে এ নিয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে দু-এক জন যাত্রী সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিংয়ের কোনও ঘোষণা করেননি পাইলট। আজ সকাল ১০টা ১৯ মিনিটে এমিরেটসের ওই ‘ইকে-৫২১’ উড়ানটি কেরলের তিরুঅনন্তপুরম বিমানবন্দর থেকে ওড়ার পর মোটের ওপর মসৃণই ছিল যাত্রাপথ। নামার মুহূর্তেই হঠাৎ গণ্ডগোল। ভাস্কর নামে ওই যাত্রী বলেছেন, ‘‘নামতে নামতে হঠাৎ যেন বিমানটা একটু উঠেই ফের গোঁত্তা খেয়ে পড়ল। তত ক্ষণে যে আগুনও ধরে গিয়েছে, আমরা বুঝতে পারিনি। গোটা কেবিন গরম ধোঁয়ায় ভরে যেতে দেখে শুরু হল দরজার দিকে দৌড়। আপৎকালীন দরজাগুলোও প্রথমে খুলছিল না। শেষ পর্যন্ত ওগুলো খোলা হতেই বেরিয়ে এলাম।’’
সোশ্যাল মিডিয়া আর একাধিক সংবাদমাধ্যমের দৌলতে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও দেখে প্রাথমিক ভাবে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ, বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার অর্থাৎ পিছনের কোনও একটি চাকায় সম্ভবত কোনও সমস্যা হয়। কারণ নামার পরে দেখা যাচ্ছে, বিমানের ডান দিকে ডানা মাটিতে ঘষা খাচ্ছে। হতে পারে, চাকা সময়মতো খোলেনি। কিংবা সেটি রানওয়ে ছুঁয়েই ভেঙে গিয়েছিল। তদন্তের আগে তা নিশ্চিত ভাবে বলা মুশকিল।
এমিরেটস-সূত্রের দাবি, নামার আগে ককপিটে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটির সঙ্কেত পাননি পাইলট। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষ মুহূর্তে ল্যান্ডিং গিয়ারের সমস্যার কথা পাইলট যদি টের পেয়েও থাকেন, তখন আর তাঁর কিছু করার ছিল না। কারণ প্রায় মাটি ছুঁয়ে ফেলার পর বোয়িং ৭৭৭-এর মতো বিশাল বিমানকে আবার উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। ২০১০-এ ম্যাঙ্গালোর বিমানবন্দরে যে চেষ্টাটা করেও সফল হননি দুবাই থেকে আসা এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের বিমানের পাইলট। ওই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ১৫২ জন।
এখানেই এমিরেটসের চালককে কৃতিত্ব দিচ্ছেন যাত্রীরা। কেউ কেউ বলছেন, মাটি ছুঁয়ে বিপদ বুঝে ফের উড়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা হয়তো তিনিও করেছিলেন। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় যে ভাবে তিনি ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিং’ করেছেন, এবং গোটা বিমান ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও কোনও যাত্রী বা বিমানকর্মীর প্রাণহানি এড়িয়েছেন, সেটাই কুর্নিশ করার মতো কৃতিত্ব। অনেকের মনে পড়ছে ২০০৯-এর আমেরিকার একটি ঘটনা। নিউ ইয়র্কের ঘিঞ্জি বসতি এড়িয়ে বিকল এয়ারবাসকে হাডসন নদীতে নামিয়ে এনেছিলেন পাইলট। সে বারও প্রাণ যায়নি কারও।
বিমানটির ব্ল্যাক বক্স অক্ষত। তাই আশা করা হচ্ছে, অল্প সময়েই জানা যাবে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ। দুর্ঘটনার পর দুবাই বিমানবন্দর আপাতত বন্ধ। ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে থেকে অন্তত ডজনখানেক উড়ান বাতিল হয়েছে এ দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy