Advertisement
০৪ মে ২০২৪

গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, পায়ের তলায় মাইন কোথায় পোঁতা জানি না...

একুশ শতকে পা ফেলার সময়েও যা ছিল, এখনও সেই পরিস্থিতির তেমন হেরফের হয়নি আফগানিস্তানে। এখনও কাবুলের আশপাশের এলাকায় গেলে ভয়ে গা ছমছম করে। ভারত সরকারের সহযোগিতায় একটি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই আফগানিস্তানে রয়েছেন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার হিল্লোল বিশ্বাস। জানালেন, তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।

হিল্লোল বিশ্বাস
হেরাত শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ১৭:৪১
Share: Save:

জুডিথ ডি’সুজার এখনও কোনও খবর নেই। জুডিথ আদৌ বেঁচে রয়েছেন কি না, সেটাও কি খুব নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এরই মধ্যে কাবুলে তালিবান মানববোমার হামলায় কম করে ৪০ জন প্রাণ হারালেন। তার মধ্যে সাধারণ নাগরিক তো রয়েছেনই, প্রচুর পরিমাণে রয়েছে আফগান পুলিশও।

ঘটনাচক্রে, জুডিথ আর আমার মধ্যে একটা জায়গায় বড়ই মিল। সেটা হল, আমরা দু’জনেই আদতে কলকাতার বাসিন্দা। কিন্তু কর্মসূত্রে কোনও না কোনও ভাবে আমাদের আসতে হয়েছে, থাকতে হয়েছে বেশ কিছু দিন আফগানিস্তানে। এখনও থাকতে হচ্ছে। মিল রয়েছে আরও একটা জায়গায়। জুডিথ যাদের ‘শিকার’ হয়েছেন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, কর্মসূত্রে আফগানিস্তানে আসার পর থেকে আমাকেও প্রতি মুহূর্তে তাদের ভয়েই কাটাতে হয়েছে। কাজের সূত্রে আমাকে এমন অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে আর সেই সব জায়গায় একটা গোটা রাত কাটাতে হয়েছে, যেখানে আমি সারা রাত চোখের দু’পাতা এক করতে পারিনি। তালিবানদের ভয়ে। সব সময়ে ভেবেছি, এই বোধহয় আমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে কেউ বা কারা আমাকে ‘তুলে’ (অপহরণ) নিয়ে গেল! একা একা রাস্তায় হাঁটতেও ভয় পেতাম। এত দিন পর, এখনও ওই ভয়টা পাই। হয়তো পিছন থেকে আচমকা কোনও গাড়ি এসে আমাকে পিষে দিয়ে চলে গেল! এখনও রাস্তায় হাঁটার সময় মাঝে-মধ্যে পিছন ফিরে দেখে নিই। তা সে কাবুলই হোক, বা আফগানিস্তানের কোনও প্রত্যন্ত প্রান্তের কোনও এলাকা। একটা সময় তো (যুদ্ধ-পরবর্তী সময়) মাটিতে পা ফেলতেও গায়ে কাঁটা দিত! এই বুঝি মাটিতে পোঁতা কোনও মাইন ফাটল! আফগানিস্তানের রাস্তায় রাস্তায়, এখানে ওখানে তখন মাটির তলায় মাইন পোঁতা। হেরাত থেকে চিস্তে শরিফ হাইওয়ে-টার দূরত্ব ১৬৫ কিলোমিটার। ওই সময় গোটা হাইওয়ের কোনও অংশেই কোনও পিচ ছিল না। গাড়িতে যেতে সময় লাগত ৬ ঘণ্টারও বেশি। সেই এবড়োখেবড়ো হাইওয়ে দিয়ে ‘ইশাফ’ (তখন থেকে কিছু দিন আগে পর্যন্তও আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক ভাবে নিরাপত্তা রক্ষার তদারকিতে ছিল ‘ন্যাটো’র ‘ইন্টারন্যাশনাল সিকিওরিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ফোর্স’ বা ‘ইশাফ’)-এর কনভয় যেত টহল দিতে দিতে। চিস্তে শরিফ ছাড়িয়ে চেকচরনের দিকে। মাঝে মাঝে রাস্তায় কালভার্ট থাকলে কনভয় সেখানে থামিয়ে রাস্তা পরীক্ষা করে, তবেই রাস্তা পেরত কনভয়। বরাবরই তালিবানদের টার্গেট থাকত সেই রাস্তা। আর সেই রাস্তার যেখানে সেখানে মাইন পুঁতে রাখত তালিবানরা। যুদ্ধের পর দেখা যায়, আফগানিস্তানের প্রায় সর্বত্রই মাটির তলায় মাইন পোঁতা। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ‘আনম্যাক’ ওই মাটিতে পোঁতা মাইন খুঁজে বের করে তা নিষ্ক্রিয় করার কাজটা করত।

আমি আফগানিস্তানে এসেছিলাম ‘ভারত-আফগান মৈত্রী বাঁধ’ (যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল এই জুনেই, র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে) বা ‘সালমা ড্যাম প্রোজেক্ট’-এর উপদেষ্টা হিসেবে। ওই প্রকল্পের ভাবনাটা অবশ্য শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকেই। কিন্তু ওই সময় আফগানিস্তানে শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। তাই সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, সেই সময় কাবুলে কর্মরত দুই ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারকে তড়িঘড়ি দেশে ফিরে আসতে হয়। যুদ্ধ মিটে গেলে ফের ভারত সরকারের ‘ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ শুরু হয় ২০০২-২০০৩ সালে। তালিবানদের হাত থেকে তত দিনে কিছুটা রেহাই মিলেছে আফগানিস্তানের। নতুন স্বপ্ন নিয়ে দেশটা পথ চলা শুরু করেছে। কিন্তু সেই কাজটা খুব সহজ ছিল না। যদিও পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভারত সহ পৃথিবীর অনেক দেশই তখন আফগানিস্তানের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল।

‘সালমা ড্যাম প্রোজেক্ট’টা হল একটি বহুমুখী প্রকল্প। যেটা বাঁধ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর চিস্তে শরিফ থেকে হেরাত পর্যন্ত বিদ্যুৎপ্রবাহের জন্য ১৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ট্রান্সমিশন লাইন বানানোর কাজ। যা ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের আর্থিক সহায়তায় শুরু হয় ভারতীয় প্রযুক্তি আর কারিগরি দিয়ে। হেরাত আফগানিস্তানের পশ্চিম প্রান্তের একটি ছোট্ট শহর। আর তা ‘ইউনেসকো’র একটি ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ও।

৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হারি রুদ নদীর সমভুমিতে গড়ে ওঠা এই শহরটি পরে আলেকজান্ডার জয় করেছিলেন। হেরাত শহর থেকে প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার দূরে চিস্তে শরিফ আসলে একটা জেলা। যদিও তা আদতে ছোট্ট একটা গ্রাম। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, আলেকজান্ডারের যুগে এসে পড়েছি! উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও হয়নি সেখানে। সেটা ছাড়িয়ে আরও ৫ কিলোমিটার দূরে হারি রুদ নদীর ওপরেই এই ‘সালমা ড্যাম প্রোজেক্ট।

দশকের পর দশক ধরে গৃহযুদ্ধে দীর্ণ হেরাত আদতে ‘ওয়ার লর্ড’ বা ‘যুদ্ধবাজ’দের এলাকা। হেরাত-রক্ষার ভার নিয়েছিলেন এমনই এক জন ‘ওয়ার লর্ড’, যাঁর নাম- ইসমাইল খান। যিনি পরে হামিদ কারজাই সরকারের শক্তি মন্ত্রী হয়েছিলেন। ওই প্রকল্পকে সফল করে তোলার ব্যাপারে মূল ভূমিকাটা ছিল তাঁরই। আমি যখন এখানে প্রথম কাজ করতে এসেছিলাম, তখন কাবুল, হেরাতে মোবাইল ফোন চালু হলেও চিস্তে শরিফ পর্যন্ত তা পোঁছয়নি। সেখান থেকে ভারতে আমার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একমাত্র ভরসা ছিল ‘স্যাটেলাইট ফোন’ই। আফগানিস্তানের অন্য বহু জায়গার মতো এখানে পাহাড় কেটে গুহা-ঘর বানিয়ে থাকার চল নেই। বামিয়ান উপত্যকা থেকে দুরের পাহাড়ের ওপর এ রকম বহু গুহা-ঘর দেখতে পাওয়া যায়। চিস্তে শরিফে থাকার জায়গা বলতেও তেমন কিছুই তখন ছিল না বললেই হয়। আমার জন্য সেখানকার গভর্নর স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দু’টি ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেখানে থেকেই আমি ২০০৩ সালে আমি ‘সালমা ড্যাম প্রোজেক্ট’-এর জন্য প্রথম সার্ভের কাজটা শুরু করি। শুনেছি, হেরাতেই মোল্লা ওমরের বাগানবাড়ি ছিল। যেখানে ১৯৯৮ সালে ওসামা বিন লাদেনের অবস্থান ‘ট্র্যাক’ করে ক্রুইজ মিসাইল ছুঁড়েছিল মার্কিন সেনাবাহিনী।

সার্বিক ভাবে তালিবানরা উন্নয়নের বিরোধী হওয়ায় ভারতীয় সহায়তার কোনও প্রকল্প হলেই, তারা সেটাকে ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করত। তাই চিস্তে শরিফ হাইওয়ের ওপরেও তাদের নজর পড়তে দেরি হয়নি। ওই রাস্তায় লুকিয়ে বিস্ফোরক রাখতে শুরু করেছিল তালিবানরা। ভারতীয়দের অপহরণেরও চেষ্টা হয়েছে বেশ কয়েক বার। এক সময় হেরাত-চিস্তে শরিফ হাইওয়ে দিয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু দিনের জন্য। তাই সব সময়েই থাকতাম ভয়ে ভয়ে। ভরসা ছিল শুধুই হেলিকপ্টার। কিন্তু সেই সুবিধেটা রোজ পাওয়া যেত না। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় তা আরও অনিয়মিত হয়ে পড়ত।

এক বার বামিয়ানে গিয়ে একেবারে ফাঁকা একটা গেস্ট হাউসে আমাদের কয়েক জনকে রাত কাটাতে হয়েছিল। আফগান সরকার থেকে সেখানে রাতে এক জন পাহারাদার দিয়েছিল। কিন্তু সেই রাতে আমরা কেউই ঘুমনোর কথা ভাবতে পারিনি। এক ঘরে দরজা বন্ধ করে কোনও মতে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকালেই আমরা অন্যত্র চলে গিয়েছিলাম।

আরও পড়ুন- ইস্তানবুলের পর কাবুল! তালিবান মানববোমায় হত অন্তত ৪০

আফগানিস্তানে থাকা মানে সারা ক্ষণই ভয়ের সঙ্গে ঘর করা!

হয়তো একেবারেই সাধারণ দেখতে একটা রোগা-পাতলা কম বয়সী লোকের সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে গেল রাস্তায়। সে হয়তো প্রথমে আপনাকে বলবে, ‘’শুমো (আপনি) খুব (ভালো আছেন)?”

আর তার পরেই সে চলে যাবে হ্যান্ড গ্রেনেড বানানোর গল্পে। বলবে, এক সময় সে হ্যান্ড গ্রেনেড বানাতো, খুব নীচ দিয়ে চলে যাওয়া সোভিয়েত হেলিকপ্টার নামানোর জন্য! ভাবুন!

হ্যাঁ, এটাই আফগানিস্তান! এখনও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE