Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
লক্ষ্য ইরাক, সিরিয়ার আইএস

জাহাজের ডেক থেকে নিশুতি রাতে বিমানহানা

কার্ল ভিনসন থেকে (পারস্য উপসাগরে)পিলে চমকানো তীক্ষ্ণ শব্দ আর আগুনের তীব্র ঝলকানি। মাত্র তিনশো ফুট দৌড়ে গিয়েই অনায়াসে টেক অফ। এফ-এ এইটিন এফ সুপার হর্নেট নিমেষে উধাও হয়ে গেল উত্তর আকাশে। তখন তার আর চিহ্নমাত্র নেই নিকষ কালো রাতের অন্ধকারে। যেখানে সাগর আর আকাশ মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর রেশ কাটতে না কাটতেই এক মিনিটের মধ্যে ফের বুক কাঁপানো আওয়াজ। এ বার দক্ষিণ দিক থেকে। অভিযান শেষ করে ফিরে এল দুপুরে উড়ে যাওয়া একটি এফ-এ এইটিন সি হর্নেট। সমুদ্রে চলমান রানওয়ে বা ফ্লাইট ডেকে আগুনের ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে।

নসনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে সুপার হর্নেটের মতো বোমারু বিমান।

নসনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে সুপার হর্নেটের মতো বোমারু বিমান।

সুরবেক বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০২:৪৯
Share: Save:

পিলে চমকানো তীক্ষ্ণ শব্দ আর আগুনের তীব্র ঝলকানি। মাত্র তিনশো ফুট দৌড়ে গিয়েই অনায়াসে টেক অফ। এফ-এ এইটিন এফ সুপার হর্নেট নিমেষে উধাও হয়ে গেল উত্তর আকাশে। তখন তার আর চিহ্নমাত্র নেই নিকষ কালো রাতের অন্ধকারে। যেখানে সাগর আর আকাশ মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর রেশ কাটতে না কাটতেই এক মিনিটের মধ্যে ফের বুক কাঁপানো আওয়াজ। এ বার দক্ষিণ দিক থেকে। অভিযান শেষ করে ফিরে এল দুপুরে উড়ে যাওয়া একটি এফ-এ এইটিন সি হর্নেট। সমুদ্রে চলমান রানওয়ে বা ফ্লাইট ডেকে আগুনের ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে।

রাত সাড়ে আটটা। সাড়ে চার একর আয়তনের সুবিশাল মার্কিন এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার ‘কার্ল ভিনসন’ থেকে নিশুতি রাতের বিমানহানা শুরু হল। ইরাক আর সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের ডেরা লক্ষ করে বোমা ফেলতে ও রকেট নিক্ষেপ করতে রওনা দিচ্ছে একটার পর একটা সুপার হনের্ট। গগনবিদারী শব্দ করে। ইয়ার প্লাগ কানে গুঁজে, তার উপরে আধ কেজি ওজনের ইয়ার প্রোটেক্টর চাপিয়েও এই শব্দ আটকানো যাচ্ছে না। কিছুটা কমানো যাচ্ছে এই যা।

ঘুটঘুটে অন্ধকার আঠারো তলা কার্ল ভিনসনের সতেরো তলার এক খোলা বারান্দায়। মার্কিন নৌসেনাদের পরিভাষায় জায়গাটার নাম ‘ভালচারস ভিউ’। অর্থাৎ শকুনের দৃষ্টি। অবতরণের সময়ে পাইলটেরা এ দিকে তাকালে তাঁদের মনে হয়, মানুষ নয়, ঠিক যেন এক দল শকুন তাঁদের বিমানের উপরে নজর রাখছে। তাই এমন নাম। বারো তলায় ফ্লাইট ডেক। মেঝে রবারের। বিমানের চাকা যাতে পিছলে না যায়।

একটু আগে জাহাজের আটতলায় বসে কথা হচ্ছিল রিয়ার অ্যাডমিরাল ক্রিস্টোভার গ্রেডির সঙ্গে। গ্রেডি হলেন ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ওয়ানের কম্যান্ডার। অর্থাৎ কার্ল ভিনসন থেকে বোমারুর যত আক্রমণ শানানো হচ্ছে, সেই সবের সর্বেসর্বা তিনিই। গ্রেডি বলছিলেন, “আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ইরাক ও সিরিয়ার আকাশে হানা দেওয়া আমাদের ফাইটার জেটগুলোর এক-তৃতীয়াংশই উড়ছে কার্ল ভিনসন থেকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘অপারেশন ইনহেরেন্ট রিজ়লভ’-এ কার্ল ভিনসন-এর গুরুত্ব কতটা।”

আগে আফগান যুদ্ধের নাম ছিল ‘অপারেশন এনডিওরিং ফ্রিডম’, ইরাক যুদ্ধের নাম ছিল ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’। তেমনই আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে গত জুনে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন জোটের সামরিক অভিযানের নাম পেন্টাগন দিয়েছে ‘অপারেশন ইনহেরেন্ট রিজ়লভ’। সেই অভিযানে শুধু কার্ল ভিনসন থেকেই হয়েছে হাজারের বেশি বিমানহানা।

অপারেশনের শীর্ষ অফিসার গ্রেডির কথায়, “রোজ কমপক্ষে ২৫টি ফাইটার জেট কার্ল ভিনসন থেকে উড়ে ইরাক ও সিরিয়ায় গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে ফিরে আসছে।” রোজকার অপারেশনের সময়সীমা সাধারণত সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা। এর মধ্যে কোনও দিন তিন দফা বা কোনও দিন চার দফায় ফাইটারদের অভিযান শুরু হয়ে যায়। দুপুর থেকে রাতের মধ্যে তিন বার সুযোগ হল বোমারু বিমানের ওঠানামা দেখার। ফ্লাইট ডেক থেকে উড়ে ইরাক বা সিরিয়ার আকাশে পৌঁছে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে ফিরতে ফাইটারদের সময় লাগে গড়ে চার থেকে ছ’ঘণ্টা। সিরিয়ার কয়েকটি জায়গায় হানা দিতে সময় লাগে একটু বেশি। এর মধ্যে মাঝ আকাশেই বার চারেক জ্বালানি ভরতে হয় এক-একটি ফাইটারে। জ্বালানি ভরার জন্য নিযুক্ত একাধিক বিমান। ফাইটার জেট ওড়াতে অন্য দেশের ভূখণ্ড যেমন প্রয়োজন নেই, মাঝপথে তেল ভরতে নামার গল্পও নেই।

ভাসমান এই ছোটখাটো শহরটায় জীবনধারণের যাবতীয় উপকরণ থাকলেও ক্রুজ বা প্রমোদতরণীর মতো বিলাসিতার সুযোগ নেই, আছে কৃচ্ছ্রসাধন। আঠারো তলা জাহাজের এক তলা থেকে অন্য তলায় যাওয়ার লিফ্ট নেই, শুধু সিঁড়ি। ভুল বললাম, স্টিলের খাড়াই মই। অসতর্ক হলে অবধারিত পা ভাঙবে, আরও বড় কিছুও হতে পারে। এমন খাড়াই মই বেয়ে বার বার ওঠানামার মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে হয় বলে এখানে কর্মরত প্রায় পাঁচ হাজার অফিসার ও কর্মীর জন্য বরাদ্দ রোজ অন্তত চার হাজার ক্যালোরির খাবার। কারও চোট লাগলে বা কেউ আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়লে বিশেষ এলিভেটরে তাঁকে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুরে নৌসেনাকর্মী যে মহিলা ফ্লাইট ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইটারদের ওঠানামা প্রথম বার দেখাতে, বিকেলে তিনিই মই বেয়ে নামার সময়ে খেয়াল না করায় ডান পায়ে চোট পেয়ে সোজা এক্স-রে রুমে। তাঁকে নামিয়ে আনা হল বিশেষ এলিভেটরে করে। এলিভেটর বাধ্যতামূলক ভাবে ব্যবহার হয় পাঁচ তলার ম্যাগাজিন (অস্ত্রাগার) থেকে বোমা ও রকেট বারো তলার ফ্লাইট ডেকে ওঠাতে। ওই এলিভেটর এক এক বারে ১০ হাজার ৫০০ পাউন্ড ওজনের বোমা ওঠাতে পারে। এর দায়িত্বে থাকা মার্টিনেজ জানালেন, এফ-এ এইটিন সি হর্নেট ১০ হাজার পাউন্ড ও এফ-এ এইটিন এফ সুপার হর্নেট ১৬ হাজার পাউন্ড বোমা নিয়ে উড়তে সক্ষম।

লেসার কিংবা জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) চালিত যে সব মিসাইল আইএসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে তীব্র গতিসম্পন্ন ‘ম্যাভেরিক’। এটি জিপিএস নিয়ন্ত্রিত ও পাঁচশো পাউন্ডের বোমা বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্র জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন (জেডিএএম)। কয়েক ঘণ্টা আগে হামলা চালিয়ে ফেরা সুপার হর্নেট-এর পাইলট, কলোরাডোর ২৯ বছরের লেফটেন্যান্ট জেপেটো বললেন, “আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে হামলায় জেডিএএম-ই সবচেয়ে কার্যকরী। কয়েক ঘণ্টা আগেই একটা ফেলে এলাম।” জেপেটোর সঙ্গেই ওই অপারেশনে আরও দু’টি সুপার হর্নেট নিয়ে যান লেফটেন্যান্ট সি ব্যাস ও লেফটেন্যান্ট জুনো। দু’জনেই মহিলা। ওঁরা দু’জনও একটি করে জেডিএএম নিক্ষেপ করেছেন প্রায় একই সময়ে।

কিন্তু কোথায় মিসাইল ছুড়লেন? ইরাক না সিরিয়ায়? “উঁহু, যুদ্ধের সময়ে এ সব বলা মানা”, বলে জেপেটো এবং জুনোরা ফের প্রস্তুতি নেন সুপার হর্নেট নিয়ে ওড়ার। অকূল দরিয়ার জল কেটে এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার এগোতে থাকে। জানা নেই এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে বা আদৌ হবে কি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

carl vinson surbek biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE