ফলপ্রকাশের উচ্ছ্বাসে। শনিবার ডাবলিনে। ছবি: রয়টার্স।
সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই খুলে গিয়েছিল ফটক। আয়ার্ল্যান্ডের ‘ডাবলিন কাসল’-এর ভিতরে সবে শুরু হয়েছে গণনা। বাইরে তখনই প্রচুর উৎসাহী মুখের ভিড়। প্রশ্ন একটাই। দীর্ঘ আন্দোলন আর লড়াইয়ের পরে যে গণভোটে সরকার রাজি হয়েছিল, তার ফল আসলে কী হতে চলেছে?
উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হয়নি বেশি ক্ষণ। মোটামুটি ১৬টা কেন্দ্রের ভোট গোনা শেষ হতেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যায়। সমকামী বিয়েতে আজই সিলমোহর লাগিয়ে দিলেন আয়ার্ল্যান্ডের অধিকাংশ মানুষ। প্রায় ৬৫ শতাংশ দেশবাসী ভোট দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, একই লিঙ্গের দুই মানুষের বিয়েতে কোনও আপত্তি নেই তাঁদের। ডাবলিন, লিমেরিক, ওয়াটারফোর্ড— সর্বত্র হইহই করে জিতেছেন ‘ইয়েস’পন্থীরা। আর এই ফলাফলের জেরে খুব তাড়াতাড়ি সংশোধন করা হবে দেশের সংবিধানও।
আজকের এই রায় চমকে দিয়েছে অনেককেই। অতি রক্ষণশীল দেশ হিসেবে বরাবর পরিচিত আয়ার্ল্যান্ড। এখানকার ক্যাথলিক সমাজ সব সময় দূরে সরিয়ে রেখেছে সমকামী বিয়ে বা গর্ভপাতের মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আয়ার্ল্যান্ডে সমকামিতা ছিল আইনত অপরাধ। ২০১০ সালে বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর সেনেটে বিল পাশ করে শুধু সমকামীদের একসঙ্গে থাকাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাথলিকদের চাপে সমকামী বিয়ের বিষয়টি ধামাচাপাই পড়ে ছিল।
তবে কি পুরোপুরি বদলে গিয়েছে মানসিকতা?
অনেকেই বলছেন, এই গণভোট আসলে বর্তমান প্রজন্মের মানসিকতার প্রতিফলন। গত কাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভোটের লাইনে যাঁদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগেরই বয়স কুড়ি থেকে তিরিশের কোঠায়। আর তাই এই ফল অপ্রত্যাশিত নয় একেবারেই। দীর্ঘদিন ধরে সমকামী বিয়ে নিয়ে আন্দোলন করেছেন ডেভিস নরিস। সত্তরের দশকে মূলত তাঁর উদ্যোগেই আয়ার্ল্যান্ডে এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আজকের রায়ের পরে ডেভিস বলেছেন, ‘‘আয়ার্ল্যান্ডের মানুষ একটা বড়সড় প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছে গোটা বিশ্বের কাছে। তাঁরা বলছেন, এটাই ভবিষ্যতের রাস্তা।’’
চলছে গণভোট। ফলপ্রকাশের আগে আশাবাদী সমকামী বিবাহ সমর্থকেরা। শনিবার ডাবলিনে। ছবি: এএফপি।
তবে ডেভিসদের এই লড়াইয়ের পথটা সহজ ছিল না মোটেও। ‘ইয়েস’দের সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করেছেন ‘নো’পন্থীরাও। আসলে কয়েক মাস ধরেই আয়ার্ল্যান্ড দু’টো সত্তায় ভাগ হয়েছিল। ‘ইয়েস’ আর নো। উদারপন্থী ‘ইয়েস’দের সঙ্গে পদে পদে ঠোক্কর লেগেছে গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী ‘নো’পন্থীদের। আজ সকালে হাওয়া বুঝে যাওয়ার পরেই রক্ষণশীল ‘ইয়োনা ইনস্টিটিউট’-এর শীর্ষ পদাধিকারী জন মারে এই ফলকে ‘হতাশাজনক’ আখ্যা দিয়ে ফেলেন। পরে অবশ্য ওই ইনস্টিটিউটই অভিবাদন জানিয়েছে ‘ইয়েস’দের।
অভিনন্দন এসেছে রাজনৈতিক স্তরেও। আয়ার্ল্যান্ডের সমানাধিকার বিষয়ক মন্ত্রী এ ও রিওডেন টুইট করে বলেছেন, ‘‘আইরিশ হিসেবে নিজেকে গর্বিত বলে মনে হচ্ছে আজ।’’ এই আন্দোলনকে অবশ্য বরাবরই সমর্থন করে এসেছে রাজনৈতিক দলগুলি। বিরোধী থেকে শাসক দল। আইরিশ কনজারভেটিভ পার্টি থেকে সিন ফিয়েন— সব পক্ষের শুভেচ্ছা বার্তায় ভেসে গিয়েছেন ‘ইয়েস’পন্থীরা।
অবশ্য উৎসবের জন্য গত কাল থেকেই এক রকম প্রস্তুত হচ্ছিল রাজধানী ডাবলিন। গত কয়েক দিন ধরেই বিভিন্ন সমীক্ষা বলে আসছিল, সমকামী বিয়ে বৈধ হচ্ছে এ বারই। আজ জয়ের ছবিটা পরিষ্কার হওয়ার পর-পরই ডাবলিনের চেনা রাস্তাগুলোই অচেনা হয়ে গিয়েছে। পানশালা হোক বা রেস্তোরাঁ, রামধনু রঙা পতাকায় আজ ঢেকে গিয়েছে গোটা আয়ার্ল্যান্ডই। সমকামী পুরুষ আর মহিলাদের দেখা গিয়েছে আলিঙ্গনরত। চুম্বনরত। অধিকাংশেরই গায়ে এক সাদা টি-শার্ট। উপরে বড় বড় করে লেখা ‘ইয়েস’। আর তলায় ‘ইকুয়ালিটি’। করাও হাতে ইয়েস লেখা বেলুন। কেউ আবার হাতে ধরে বিয়ারের মগ। চার বছর ধরে একসঙ্গে থাকেন নিয়াম হেরিটি এবং এওফে ডয়েল। ডাবলিনের এই প্রেমিকা যুগল ঠিক করেছেন বিয়ে করবেন শীঘ্রই। ‘‘দু’বছর আগে বাগদান হয়ে গিয়েছে আমাদের। আমরা উচ্ছ্বসিত যে আয়ার্ল্যান্ড মান বাঁচাল। দেশবাসীদের জন্য আমরা গর্বিত,’’ বললেন হেরিটি।
শুধু কি আয়ার্ল্যান্ড? সমকামী বিয়ে এখন বৈধ বিশ্বের অনেক দেশেই। গত সপ্তাহেই নিজের দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে বিয়ে করেছেন লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার বি মাসিয়ের। তালিকা তো শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নয়। গায়ক এলটন জন থেকে শুরু করে টেনিস তারকা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা— সমকামী সঙ্গীদের বিয়ে করে নতুন চিন্তাধারার পথ খুলে দিয়েছেন এমন অনেক সেলিব্রিটিই। আমেরিকার সব জায়গায় না হলেও আপাতত ৩৮টি রাজ্যে সমকামী বিয়ে বৈধ।
কিন্তু ভারত? এ দেশে সমকামিতা এখনও ‘অপরাধ’। বিয়ে তো দূর অস্ত্। খুব সম্প্রতি মুম্বইয়ের এক দৈনিকে বিয়ের বি়জ্ঞাপন দিয়েছেন এক দক্ষিণী মহিলা। ছেলের জন্য পাত্রী নয়, উপযুক্ত পাত্র খুঁজছেন তিনি। তা হলে কি মানসিকতা বদলাচ্ছে ভারতেরও? উত্তরটা বোধহয় খুব একটা সদর্থক নয়। সমকামী আর রূপান্তরকামীদের হয়ে বহু বছর ধরে আন্দোলন করছেন পশ্চিমবঙ্গের রঞ্জিতা। তিনি রূপান্তরিত। দাবি করেন, বিয়েও করেছেন এক পুরুষকে। রঞ্জিতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, দেশের আইনকে ভয় পান না? ভারতে তো সমকামী বা রূপান্তরকামীদের বিয়ে নিষিদ্ধ? উত্তরে রঞ্জিতা পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, ‘‘আমাদের দেশে তো নারী পাচার আর যৌন পেশাও নিষিদ্ধ। তা হলে সে সবও কি এখন বন্ধ হয়ে আছে?’’ আয়ার্ল্যান্ডের রায় শোনার পরে হতাশার সুরে বললেন, ‘‘আমাদের দেশে রূপান্তরকামীদের স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ দেয় আদালত। কিন্তু বিয়েতে নয়।’’
মুম্বইয়ের ওই মহিলা হয়তো সত্যিই ব্যতিক্রম! তবে রঞ্জিতারা হতাশ হলেও আয়ার্ল্যান্ডের কিলকেনি কাউন্টির ৪২ বছরের নিক ও কোনেসের মুখে বহু দিন পরে হাসি ফুটেছে। ডাবলিনের এক পানশালায় বসে বললেন, ‘‘আমি ভাবছি, এত দিন ধরে যে সব ছেলে-মেয়ে সমকামিতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের কথা। আজকের এই রায় তাঁদের জন্যও বটে।’’ সেই সঙ্গেই আর একটা কথা বলতে ভুললেন না নিক— ‘‘অন্য দেশের সঙ্গে আয়ার্ল্যান্ডের পার্থক্য একটাই। আমাদের এই সুযোগ করে দিয়েছেন দেশের মানুষ। আইনসভা নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy