আসরফ ঘানি
ভুল থেকে ভুল বোঝাবুঝি তো হয়েই থাকে। কিন্তু ভুলও অনেক সময় মাধুর্য ছড়াতে পারে। এমনকী উত্তেজনাপূর্ণ টানটান কূটনৈতিক সম্পর্কেও! নিঃশব্দে এমনই এক অভিনব চিত্রনাট্য তৈরি হল ভারত-আফগানিস্তানের মধ্যে! কিংবা বলা ভাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসরফ ঘানির মধ্যে।
ভুল করে নির্দিষ্ট দিনের তিন মাস আগেই টুইটারে ঘানিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বসেছিলেন মোদী! ভুল ধরিয়ে দিলেও আগাম শুভেচ্ছায় যে তিনি খুশি, সে কথাও গোপন রাখেননি ঘানি। এর পরে গত বৃহষ্পতিবার, তাঁর আসল জন্মদিনে ফের মনে করে শুভেচ্ছা জানান মোদী। এ বারও খুশি হয়ে ফের তার জবাব দিয়েছেন ঘানি।
টুইটপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনেতাদের জন্মদিনে সাবেকি কায়দায় বার্তা না পাঠিয়ে সরাসরি শুভেচ্ছা জানাতেই বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু ২০১৪ সালের শেষে আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসা আসরফ ঘানির জীবনপঞ্জীর হোমওয়ার্কে কিঞ্চিৎ ভুল করে ফেলেছিল তাঁর কার্যালয়। আর তাই এ বছর গত ১২ ফেব্রুয়ারি মোদী টুইট করে বসেন, ‘‘শুভ জন্মদিন আসরফ ঘানি। আপনার দীর্ঘ জীবন, দুর্দান্ত স্বাস্থ্য এবং আনন্দময় ভবিষ্যৎ কামনা করি।’’ কিছুক্ষণের মধ্যেই জবাবে ঘানি লেখেন, ‘আমার জন্মদিন যদিও ১৯মে, কিন্তু তবু এই মর্যাদাপূর্ণ শব্দগুলির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।’’ এর পর স্বাভাবিক ভাবেই নিরুত্তর থাকেন মোদী। তবে ১৯ মে-সকালেই আবার ঘানিকে টুইট করতে ভোলেননি তিনি। বরং একটু বাড়তি মজা করে লিখেছেন, ‘‘শুভ জন্মদিন প্রেসিডেন্ট ঘানি। এ বার তারিখটা ঠিক লিখেছি!’’ সঙ্গে একটি ‘স্মাইলি’ও জুড়ে দিয়েছেন তিনি।
জবাবে ঘানি রোমানে টাইপ করে লিখেছেন, ‘‘বহুৎ ধন্যবাদ পিএম!’’ তার পর ইংরাজিতে তাঁর উত্তর, ‘‘আপনার মতো পরম বন্ধুর কাছ থেকে শুভেচ্ছা পাওয়া সর্বদাই আনন্দের। আপনি আমার দেশবাসীর জোরদার সমর্থকও বটে।’’
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘানি এবং মোদী ‘পরম মিত্র’— বিষয়টা ঠিক এ রকম নয়। বরং তাঁর পূর্বসূরি হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত ছিলেন ভারতবন্ধু হিসেবে। বছরে বার তিনেক ভারত সফরে আসতেন। তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্যও ছিল সর্বজনবিদিত। ইসলামাবাদের চোখ রাঙানি সত্ত্বেও তালিবানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতকে সর্বতো ভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন কারজাই।
কিন্তু ২০১৪ সালের অক্টোবরে ঘানি ক্ষমতায় এসে প্রথমেই যেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তা হল, তিনি পূর্বসূরির পথে হাঁটবেন না। প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে পাকিস্তানকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তার পর চিন! এতেই সর্তক হয়ে যায় নয়াদিল্লি। কারণ, কৌশলগত এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে কাবুল ভারতের কাছে
খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘানির ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিও যথেষ্ট প্রচারিত ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে।
আফগান নেতৃত্বের মনোভাবের বদল বুঝে ক্রমশ কাবুলের সঙ্গে কূটনৈতিক দৌত্য জোরদার করতে শুরু করে মোদী সরকার। আফগান প্রেসিডেন্টের স্ত্রী রুলা ঘানি সে দেশে নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। তাঁকে আমন্ত্রণ করে ভারতে নিয়ে আসা হয়। সে সময় ভারতে মহিলা উদ্যোগপতি, সমাজকর্মীদের সঙ্গে বেশ কিছু বৈঠক করেন রুলা। এই বামা-কূটনীতির পর গত বছর এপ্রিলে নয়াদিল্লি আসেন আসরফ ঘানি। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক সহজ করার চেষ্টা শুরু হয়। সে সময় রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পটির সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেন ঘানি।
এর পরেও একাধিক বার তালিবান হামলা ঘটেছে ভারতীয় দূতাবাসের উপরে। কখনও তা সফল হয়েছে, কখনও হয়নি। কিন্তু ঘানি সরকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চলার ফল মিলেছে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপও করা সম্ভব হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী আজই তাঁর প্রথম ইরান সফরে রওনা হলেন। তেহরানে বহুপ্রতীক্ষিত চাবাহার বন্দর নিয়ে ঘানি, ইরানের প্রেসিডেন্ট রৌহানি এবং প্রধানমন্ত্রী ত্রিপাক্ষিক সমঝোতাপত্রে সই করতে চলেছেন। এর ফলে পাকিস্তানকে এড়িয়ে কাবুলের সঙ্গে বাণিজ্যের একটি নতুন পথ খুলতে চলেছে ভারত। তৈরি হতে চলেছে ভারত-আফগানিস্তান অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সম্পর্কের নতুন অধ্যায়।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রে তাই ঠাট্টা করে বলা হচ্ছে, বছরে দু’বার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর ভ্রান্তিবিলাসে ক্ষতি কী? যদি তাতে আশাতীত ফল পাওয়া যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy