আম্মানে জর্ডনের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লার সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়। ছবি: এএফপি।
বহুমেরু কূটনীতিতে ভারসাম্য রাখাটা সহজ নয়। ভারতের আর্থিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার শত প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিক দৌত্যে সহজ কথাটা সব সময় সহজ ভাবে বলাও সহজ নয়। বিশেষ করে দৌত্যের রূটম্যাপে যদি একই সঙ্গে রাখা থাকে তিন গন্তব্য-জর্ডন, প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েল।
তবু ঝুঁকি নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। ভারসাম্যের কূটনীতির দায়িত্ব নিয়ে আজ আম্মানে এসে পৌঁছলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাইসিনা পাহাড়ে বসে দু’দিন আগে মৌলবাদী সন্ত্রাস দমনে জর্ডন-রাজ আবদুল্লার দেওয়া সাত সূত্রের প্রশংসা করেছেন প্রণববাবু। রানি আলিয়া বিমানবন্দরে নেমে আজ হুসেনি প্রাসাদে গিয়ে সেই আবদুল্লার রাজকীয় অভ্যর্থনা গ্রহণ করলেন রাষ্ট্রপতি। মধ্যাহ্নভোজে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আবহ রচনা করলেন তাঁরা। আজ ও কাল আম্মানে থেকে পরশু প্যালেস্তাইন পৌঁছবেন প্রণববাবু। তার পরের আড়াই দিন ধরে তিনি থাকবেন ইজরায়েলে।
ইতিমধ্যেই ইতিহাসে প্রবেশ করে গিয়েছে রাষ্ট্রপতির এই সফর। আশির দশকে শেষ দিকে তবু জর্ডন সফরে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনৈতিক দিক থেকে সব থেকে স্পর্শকাতর দুই ভূখণ্ড, ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনে এই প্রথম পা রাখবেন কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রপতি। সেখানেই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে এই সফর।
আরব বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ। কিন্তু এখন ইজরায়েলের সঙ্গেও কৌশলগত সম্পর্ক আরও মজবুত করতে বিশেষ আগ্রহী মোদী সরকার। এই দু’টি বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কঠিন কাজ করতেই এসেছেন প্রণববাবু।
সাউথ ব্লকের কূটনীতিকরা এটা বুঝতে পারছেন যে, এখানে রাষ্ট্রপতির বলা প্রতিটি শব্দের উপরে নজর রাখবে আরব দেশগুলি। আবার নয়াদিল্লির কূটনৈতিক বার্তার বিচার হবে ঘরোয়া রাজনীতিতেও, যেখানে সংখ্যালঘু ভোট এখনও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
কূটনীতিকদের মতে, এই ধরনের ভারসাম্যের বার্তা দিতে প্রণববাবু অভ্যস্ত। বস্তুত তাঁর পরামর্শেই সফরসূচিতে যোগ করা হয়েছে প্যালেস্তাইন। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিবিরের একাংশও অবশ্য স্পষ্টই মনে করছে, মোদীর মূল লক্ষ্য ভারত-ইজরায়েল সম্পর্ক। কারণ, জনসঙ্ঘের সময় থেকেই ইহুদি জনজাতির লড়াইয়ের সঙ্গে একাত্মবোধ করেন হিন্দুত্ববাদী নেতারা। তা ছাড়া গুজরাত দাঙ্গার পরে যখন মোদীর মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল আমেরিকা, তখন ইজরায়েলই প্রথম মোদীকে স্বাগত জানিয়েছিল। ইজরায়েলের সঙ্গে গুজরাতের বিনিয়োগ ও কৃষিক্ষেত্রে সহযোগিতার শুরু তখন থেকেই। প্রধানমন্ত্রী হয়ে জাতীয় স্তরে সেই সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে চান মোদী। ইজরায়েলও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে এই সফরকে। তাই সে দেশের জাতীয় আইনসভা ‘নেসেটে’ বক্তৃতাও দেবেন প্রণববাবু।
কিন্তু আরব জগতের স্পর্শকাতরতার কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে সাউথ ব্লককে। তাই সফর শুরু হয়েছে জর্ডন দিয়ে। মৌলবাদী পথে না হেঁটে মধ্যপন্থা নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলেছেন জর্ডনের রাজারা। এমনকী ১৯৪০-এর দশকে আরব-ইজরায়েলি যুদ্ধের আগেও ইহুদি নেত্রী গোল্ডা মায়ারের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলেন বর্তমান জর্ডন-রাজের পিতামহ আবদুল্লা। তাঁদের সেই
বৈঠক যুদ্ধ থামাতে পারেনি। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদি জাতির রাষ্ট্রগঠনের সম্ভাবনার কথা স্বীকার করেছিলেন আবদুল্লা। তাঁর সেই বাস্তববাদী মনোভাবের তারিফ করেছিলেন ইহুদি নেতৃত্বও।
এ হেন জর্ডনের পাশের দেশেই এখন প্রবল দাপট মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন আইএসের। যে গোষ্ঠীর কাজকর্ম নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারত সরকারও। মৌলবাদী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাই জর্ডনকে মুখ্য ভূমিকায় দেখতে চায় নয়াদিল্লি। দু’দিনের সফরে জর্ডনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি ছাড়াও শিক্ষা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা হবে।
শুধু জর্ডন নয়, আরব বিশ্বের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা হবে রাষ্ট্রপতির প্যালেস্তাইন সফরেও। প্যালেস্তাইনে নতুন স্কুল, কলেজ পুনর্গঠনে আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার করে রাষ্ট্রপতি বোঝাতে চাইবেন, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে সার্বভৌম প্যালেস্তাইন গঠনে নয়াদিল্লির সমর্থন অটুট রয়েছে। ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করলেও নয়াদিল্লি-প্যালেস্তাইন আত্মিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক কখনওই নষ্ট হবে না।
কিন্তু আরব বিশ্বকে কি খুশি করা যাবে? সাউথ ব্লকের এক কূটনীতিকের কথায়, ‘‘ভারতের আর্থিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রয়োজনের কথা আরব মিত্রেরাও বুঝবে বলে আমাদের আশা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy