Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ডালমিয়া-জট কেটে নাটকের নতুন মশলা সচিব নির্বাচন

পার্ক শেরাটনের লবিটা এখন বেশ শুনশান। সকাল ন’টা। আরে, ওই দু’টো চেয়ারে মুখোমুখি বসে কারা? অনুরাগ ঠাকুর আর রাজীব শুক্ল না? পওয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে লোকে জানে এবং প্রথম জনকে নিয়ে গত রাত থেকে প্রচুর হল্লা চলছে। দেখা গেল, উত্তেজিত ভাবে হাত-পা নেড়ে অনুরাগকে কী সব বোঝাচ্ছেন রাজীব। পরিচিত এক সাংবাদিক ঘুরঘুর করতে-করতে গেল কাছে আর সপাটে ধাতানি, “এখানে কী? যাও এখান থেকে!”

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
চেন্নাই শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৫ ০৩:০১
Share: Save:

দৃশ্য এক

পার্ক শেরাটনের লবিটা এখন বেশ শুনশান। সকাল ন’টা। আরে, ওই দু’টো চেয়ারে মুখোমুখি বসে কারা? অনুরাগ ঠাকুর আর রাজীব শুক্ল না? পওয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে লোকে জানে এবং প্রথম জনকে নিয়ে গত রাত থেকে প্রচুর হল্লা চলছে। দেখা গেল, উত্তেজিত ভাবে হাত-পা নেড়ে অনুরাগকে কী সব বোঝাচ্ছেন রাজীব। পরিচিত এক সাংবাদিক ঘুরঘুর করতে-করতে গেল কাছে আর সপাটে ধাতানি, “এখানে কী? যাও এখান থেকে!”

দৃশ্য দুই

ক’টা হবে? দশ? কুড়ি? নাহ্, আরও বেশি। চ্যানেলের এক ঝাঁক ক্ষুধার্ত ‘বুম’ ঠায় অপেক্ষা করছে ঝাড়া পাঁচ ঘণ্টা। এক পূর্বাঞ্চল কর্তাকে হোটেল পার্কিং লটে দেখামাত্র উগ্র আক্রমণ প্যানেলটা কী? ডালমিয়াই প্রেসিডেন্ট তো? ভদ্রলোককে ‘ডালমিয়া আনঅপোজ্ড’ বলতে শুনে মুচকি হাসেন পাশে দাঁড়ানো সিএবি কর্তা। স্বগতোক্তির ঢঙে বেরিয়ে পড়ে, “জগুদা তো প্রায় কেটেই যাচ্ছিলেন। কী ভাবে ম্যাচ বার করলাম আমরাই জানি। স্নান-খাওয়ার সময়টাও আজ পাইনি!”

দৃশ্য তিন

ম্লান, ফ্যাকাশে হাসি নিয়ে সোফার এককোণে তিনি। পরপর ফোন আসছে। ধরছেন। কিন্তু ধরেও ডালমিয়া-প্রসঙ্গে কাষ্ঠহাসি, শুষ্ক উত্তর। “জগুদাদা আর শ্রীনি এক দিকে চলে যাবে না তো? কেন জানি না মনে হচ্ছে, অনুরাগ ঠাকুর কাল পারবে না। হেরে যাবে!’’ শূন্য দৃষ্টিতে মিনিট দু’য়েক চুপচাপ। তার পর আবার, “আমার ক্ষমতারও তো একটা শেষ আছে। আমি না থাকলে শ্রীনি তো নিজেই ড্যাং ড্যাং করে জিতে যেত।”

ভদ্রলোকের নাম? অতি সহজ আদিত্য বর্মা!


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাতাশি বছরের ইতিহাসে এমন মহানাটকীয় চিত্রনাট্য বোধহয় খুব কমই তৈরি হয়েছে। যেখানে বোর্ড প্রেসিডেন্টের আর্মচেয়ারে প্রার্থীর নামে সর্বসম্মত সিলমোহর পড়েও বাকি পদ নিয়ে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। কী হবে, কেউ জানে না। ওখানে যে ওঁত পেতে রক্তক্ষয়ী নির্বাচন। সরকারি রেজাল্ট আউটের আগে যা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী মানে মূর্খামিকে সসম্মানে ডেকে আনা, তা যতই শ্রীনি শিবির গর্জন তুলুক ‘আমরাই জিতছি।’ প্রায় দশ বছর পর আবার পুরোদমে বোর্ড নির্বাচন ফিরছে সোমবার। ফিরছে ২০০৫-এর পর। ফিরছে শ্রীনির আঁতুড়ঘরে, শ্রীনি বনাম পওয়ারের পেশিশক্তির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি নিয়ে।

সঞ্জয় পটেল বনাম অনুরাগ ঠাকুর। পদ বোর্ড সচিব।

অমিতাভ চৌধুরি বনাম চেতন দেশাই। পদ বোর্ড যুগ্ম সচিব।

অনিরুদ্ধ চৌধুরি বনাম রাজীব শুক্ল। পদ বোর্ড কোষাধ্যক্ষ।

সোজাসুজি নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন বনাম শরদ পওয়ার!

অদৃষ্টের আশ্চর্য ‘মাস্টারস্ট্রোকে’ এক জনই শুধু সর্বসম্মত পদাধিকারী থেকে গেলেন। পদটা প্রেসিডেন্টের এবং পদাধিকারীর নাম জগমোহন ডালমিয়া। দশ বছর আগে তাঁর সমর্থিত প্রার্থী রণবীর সিংহ মহেন্দ্রকে হারিয়ে বোর্ড মসনদে বসেছিলেন শরদ পওয়ার। দশ বছর পরের পওয়ার এ দিন সেই ডালমিয়াকেই সমর্থন দিলেন। শ্রীনিবাসন তাঁকে নিজের প্যানেলে রাখলেন ‘জামাই-আদরে’। কিন্তু ডালমিয়ার মনোনয়ন এবং সরকারি প্রতিনিধি অনুরাগ ঠাকুরের ভাগ্য নির্ধারণ নিয়ে রবিবার যে টানটান উত্তেজনার প্লট তৈরি হল, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্বকাপে ধোনির ভারত নামলে কমপক্ষে সাত গোল খাবে! নির্বাচন কোথায়, দেখলে তো মনে হবে হিচককের আস্ত থ্রিলার!

প্রার্থী ফোন বন্ধ করে বেমালুম ‘গায়েব’ হয়ে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে ঘর পাল্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যত্র। যাতে পওয়ারদের ‘দৃষ্টি’ থেকে লুকিয়ে রাখা যায়! গভীর রাতে পওয়ারের গর্জন তো ভোর ছ’টার মধ্যে শ্রীনির ধূর্ত চাল। পৌনে তিনটেয় মনোনয়ন জমা করে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে মনোনয়ন তুলে বিরোধী শিবিরে চলে যাওয়া থ্রিলার সৃষ্টিতে আর কত মোচড় লাগে?

জগমোহন ডালমিয়া তিনিও একটা সময় আচমকা বেখাপ্পা পরিস্থিতিতে পড়ে যান। শনিবার রাত থেকে পওয়ার-মনোহরদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠকে দেখা যাচ্ছিল সিএবি প্রেসিডেন্টকে। রাতের দিকে পওয়ার ঘনিষ্ঠদের বলেও দেন, রবিবার যে প্যানেল পড়বে তা চূড়ান্ত। প্রেসিডেন্ট ডালমিয়াকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে সচিব করা হবে অনুরাগ ঠাকুরকে। যিনি পওয়ার গোষ্ঠীর। যে খবর কানে যাওয়ামাত্র অগ্নিশর্মা শ্রীনি অনুরাগকেই নিজের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করে দেন। অনুরাগকে প্রস্তাব দেন, বলো কী চাও? তুমি এত দিন আমাদের সঙ্গে ছিলে। আমরা চাই, এখনও থাকো। প্রকাশ্যে অনুরাগের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় শ্রীনিকে। ডালমিয়া নিয়ে তাঁর অসূয়ার ব্যাখ্যাও দিয়ে দেন ঘনিষ্ঠদের। বলে দেন, ওঁকে গত রাতেই বলে দেওয়া হল আপনি প্রেসিডেন্ট। তার পরেও উনি কোন যুক্তিতে পওয়ারদের সঙ্গে বৈঠক করছেন? প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নিয়ে তিনি আবার ভাবছেন। শ্রীনি ঘুরছেন শোনামাত্র ডালমিয়ার ঘরে চলে যান নিরঞ্জন শাহ। সিএবি প্রেসিডেন্টকে নাকি বলে দেন, আপনি ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেলুন! শ্রীনি প্রার্থী পাল্টাচ্ছে।

পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে দ্রুত ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়েন সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে এবং যুগ্ম সচিব সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। এক দিকে শ্রীনিকে তাঁরা বোঝাতে থাকেন, মনোহর-ডালমিয়া বৈঠকের ভুল মানে করা হচ্ছে। সিএবি প্রেসিডেন্ট কোনও ভাবেই পওয়ারদের দিকে যাবেন না। আপনার খারাপ সময়ে ডালমিয়া সব সময় আপনার পাশে থেকেছেন। ডালমিয়াকে ঘর পাল্টে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অন্যত্র। আর এক দিকে তাঁকে বোঝানো শুরু হয়, আপনি যে কোনও একটা দিকে থাকুন। শ্রীনি নইলে পওয়ার। কিন্তু পওয়ারের দিকে গেলে পূর্বাঞ্চল ভোট ভাগাভাগি হয়ে যেতে পারে।

সমান্তরাল ভাবে আর একটা নাটক চালু হয় ঠাকুরকে নিয়ে। শ্রীনির সমর্থন পেয়ে আচমকাই ‘উধাও’ হয়ে যান ঠাকুর। মনোহররা তাঁর ঘরে গিয়ে আবিষ্কার করেন, হিমাচল ক্রিকেট সংস্থার প্রেসিডেন্ট বেপাত্তা। ফোনও বন্ধ। প্রায় এক ঘণ্টা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন মনোহররা। পরে যোগাযোগ সম্ভব হলে মনোহরদের ঠাকুর বলে দেন, বিজেপির উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছে। তাঁকে বলা হয়েছে শ্রীনির প্যানেলে প্রেসিডেন্ট দাঁড়াতে! যা শুনে হাঁ হয়ে যান মনোহররা। কারণ ঠাকুর শ্রীনির দিকে চলে যাওয়া মানে পওয়ার-মনোহরদের ব্যালটবক্স থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। কারণ বিজেপির সব ভোটও তখন ঠাকুরের দিকে যাবে। পাগলের মতো মনোহর শিবির যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করে বিজেপি শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে। প্রচুর চেষ্টাচরিত্রের পর জানা যায়, মোটেও সে সব কিছু নয়। ঠাকুরকে বলাই হয়নি শ্রীনির প্যানেল থেকে প্রেসিডেন্ট দাঁড়াতে! ও দিকে ততক্ষণে সিএবি কোষাধ্যক্ষকে শ্রীনি বলে দেন, ডালমিয়াই প্রেসিডেন্ট। আমি ওঁর ঘরে একটা নাগাদ যাচ্ছি। কিন্তু গণ্ডগোল হলে গ্যারান্টার তুমি থাকবে! সওয়া একটা নাগাদ ডালমিয়াকে (রাতে যাঁর ঘরে আবার ডু নট ডিস্টার্ব বোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হল) নিয়ে শ্রীনি বোর্ডরুমে ঢোকেন। পাশে বসিয়ে সই করানো হয় মনোনয়নপত্রে। দুপুর আড়াইটে নাগাদ বোর্ডরুমে ঢুকে পওয়াররা দেখেন শ্রীনি শিবির ঘিরে বসে আছে ডালমিয়াকে। ঘেঁষার কোনও উপায় নেই। প্রেসিডেন্ট পদে সমর্থন দিয়ে তাঁরা অন্যান্য পদে প্রার্থী দিয়ে চলে যান। সচিব পদে দাঁড় করানো হয় ঠাকুরকে। শ্রীনি প্রার্থী সঞ্জয় পটেলের বিরুদ্ধে।

নির্যাসে নির্বাচন।

কেউ কেউ একটা সময় আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলেন কী ভাবে শ্রীনি ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিলেন ভেবে। কারণ, ঠাকুর পওয়ারের দিকে থাকা মানে বিজেপির ভোট সে দিকে থাকা। শ্রীনি সাহস পাচ্ছেন কী ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার? শ্রীনি শিবির থেকে যে প্রশ্নকে ডে’ভিলিয়ার্সের স্টাইলে টাঙিয়ে ফেলে দেওয়া হল। বলা হল, শ্রীনি যে প্যানেল দিয়েছেন তার মধ্যে তিন জন আছেন যাঁদের কেউ কেউ বিজেপির সাংসদ, কেউ হালফিলে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন। তা হলে বিজেপির ভোট অনুরাগের দিকে শুধু আছে, কে বলল? বিকেলের দিকে পওয়ারদের প্যানেলের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পঞ্জাবের এম পি পাণ্ডব নাম তুলে নেওয়ায় শ্রীনি শিবিরের গলার জোর আরও বেড়ে যায়। বলা হতে থাকে, পাণ্ডবের শ্রীনির প্যানেলেই থাকার কথা ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। কিন্তু তাঁকে পওয়াররা কয়েক ঘণ্টার জন্য ‘গায়েব’ করে দেওয়ায় বাধ্য হয়ে তাঁর বদলে উত্তরাঞ্চল থেকে আনতে হয়েছে এমএল নেহরুকে! সঙ্গে হুমকি, অন্তত পনেরো থেকে ষোলোটা শ্রীনির দিকে। বৈঠকে নাকি সভাপতিত্ব করবেন শিবলাল যাদব অর্থাৎ যুদ্ধ কোনও ভাবে ‘টাই’ হলেও তাঁর কাস্টিং ভোট পাওয়া যাবে। অনুরাগের নাকি মান বাঁচানো কঠিন হবে!

সত্যিই কি তাই? সরকারি প্রার্থী অনুরাগকে কি হারানো এতই সহজ হবে?

শোনা যায়, চিপক স্টেডিয়ামের গায়ে যে মন্দির আছে তার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীনি। নিজের মঙ্গলার্থে। সংস্থার মঙ্গলার্থে। উত্তরটা সেই মন্দিরের বিগ্রহের কাছেও আছে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE