Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

স্লো টার্নারে পাঠ নিয়ে ক্যাপ্টেন কোহলির বিরাট হওয়ার যুদ্ধ

দৃশ্য হিংস্রতার সঙ্গে অদৃশ্য সংকল্প যোগ না করলে ব্যাখ্যা বোধহয় অসম্পূর্ণ থাকবে। মহানদী পাড়ের বরাবাটি। দেশের আবহাওয়ার আইন মেনে সকালে বেশ শীত-শীত। ঝকঝকে রোদে আগুন কম, আমেজ বেশি। ম্যাচেরও দু’দিন বাকি, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামের কেউ গালে খোঁচাখোঁচা সাদা দাড়ি সমেত আবির্ভূত হচ্ছেন না, প্রতিপক্ষ পৌঁছল বিকেলে, যারা এল তাদের মধ্যেও লাসিথ মালিঙ্গা বা রঙ্গনা হেরাথ বলে কেউ নেই এমন প্রেক্ষাপটে যদি আবহে ঢিলে পড়ে, বিশেষ কিছু বলার থাকে না। সিরিজ ওপেনারের পরিচিত উত্তাপটাই তো তৈরি হয়নি।

কটকে কোহলির ছবি তুলেছে পিটিআই

কটকে কোহলির ছবি তুলেছে পিটিআই

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কটক শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৫
Share: Save:

দৃশ্য হিংস্রতার সঙ্গে অদৃশ্য সংকল্প যোগ না করলে ব্যাখ্যা বোধহয় অসম্পূর্ণ থাকবে।

মহানদী পাড়ের বরাবাটি। দেশের আবহাওয়ার আইন মেনে সকালে বেশ শীত-শীত। ঝকঝকে রোদে আগুন কম, আমেজ বেশি। ম্যাচেরও দু’দিন বাকি, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামের কেউ গালে খোঁচাখোঁচা সাদা দাড়ি সমেত আবির্ভূত হচ্ছেন না, প্রতিপক্ষ পৌঁছল বিকেলে, যারা এল তাদের মধ্যেও লাসিথ মালিঙ্গা বা রঙ্গনা হেরাথ বলে কেউ নেই এমন প্রেক্ষাপটে যদি আবহে ঢিলে পড়ে, বিশেষ কিছু বলার থাকে না। সিরিজ ওপেনারের পরিচিত উত্তাপটাই তো তৈরি হয়নি।

ভুল। সকাল সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু এগারোটা একত্রিশ থেকে তো সিরিজ উদ্বোধনের ঢাক বাজিয়ে দিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’।

কোহলি, ক্যাপ্টেন কোহলি।

অমিত মিশ্রকে নির্দয় ভাবে নেটে তুলে-তুলে ফেললেন। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ক্যারম বলও তো দেখা গেল বেশ সহজপাচ্য! ইশান্ত শর্মা আবার বিদ্যুত্‌গতির কভার ড্রাইভটা ফলো থ্রুতে আটকাতে না গেলেই ভাল করতেন বোধহয়। ঝাড়া দেড় মিনিট হাত ঝাড়তে হল তো তার পর! সব দেখেশুনে ওড়িশা-দর্শকের চিলচিত্‌কার আর কান ঝালাপালা।

ধর্মশালার সেঞ্চুরিতে তা হলে শেষ পর্যন্ত ব্যাটের শাপমুক্তি? অফস্টাম্পের বাইরে তা হলে বরাবরের মতো অনিশ্চয়তার শেষ? ক্যাপ্টেন্সির মুকুট-প্রাপ্তিতে ব্যাটে বাড়তি বারুদ ঠাসার ইঙ্গিত?

একটারও উত্তর বোধহয় নিঃসন্দেহে দেওয়া যাবে না। স্পিনারদের বিক্রম দেখালেন ঠিকই, কিন্তু উমেশ যাদব আজও বিরাটকে দু’বার ফার্স্ট স্লিপে পেলেন। অনিশ্চয়তার সরণি ধরেই। বিরাটও বিরক্তিতে হাঁটা দিলেন কোচ ডানকান ফ্লেচারের দিকে। কিটব্যাগ থেকে আরও দু’টো ব্যাট বার করে কী সব দেখলেন। আর তাঁর ক্যাপ্টেন্সির ব্যালান্স শিটও বেশ ভ্রমাত্মক।

ক্রিকেট পরিসংখ্যান বলবে, ক্যাপ্টেন বিরাটের রেকর্ড ঈর্ষণীয়। এক ডজন ম্যাচ খেলে পঁচাত্তর শতাংশ জিতে বসে আছেন। ক্যাপ্টেন হিসেবে ব্যাটটাও বেশ ভাল চলে। গড় তো পঁয়ষট্টি!

ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বলবেন, শাহিদ আফ্রিদির কাছে তিনি এশিয়া কাপে হেরেছেন। আফ্রিদির সামনে তাঁর শেষ ওভার অশ্বিনকে দিয়ে করানোর স্ট্র্যাটেজি হেরেছে। বলবেন, ন’টি জয়ে দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষ পাননি। বড় টুর্নামেন্টে নামেননি। এশিয়া কাপ ছিল মাঝারি মাপের, সেটাও দিতে পারেননি দেশকে। বলবেন, গেইল-যুবরাজ-ডে’ভিলিয়ার্স নিয়েও তাঁর আইপিএল-স্বপ্ন অধরাই রয়েছে। এমএসডি থাক। গৌতম গম্ভীরও সাধারণ টিম নিয়ে তুখোড় ক্যাপ্টেন্সি করে বেরিয়ে গিয়েছেন।

আসন্ন সিরিজের মাহাত্ম্য বুঝেই নাকি বিরাট এ বার প্রস্তুতিতে কোনও ফাঁক রাখেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পর এক দিনও নাকি বসে থাকেননি। ওয়েস্ট দিল্লি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে পড়ে থেকেছেন ছোটবেলার কোচ রাজকুমার শর্মার সঙ্গে। যেখানে স্লো টার্নার তৈরি রাখা হয়েছিল বিরাটের জন্য। কারণ আর কিছুই না। শ্রীলঙ্কা ভাল হোক খারাপ হোক, স্পিনার-বোঝাই হয়ে আসবে। ভারতের উইকেটে যাদের বধ করা মানে সিরিজ পকেটে। স্লো টার্নারে স্পিনারদের মারণমন্ত্র তাই আগেভাগে বার করে রাখা।

“মিডিয়া তো শুধু ওর ফর্ম নিয়েই লাফাল। খাটাখাটনিটাও দেখে গেলে পাারত,” শুক্রবার দুপুরে নয়াদিল্লি থেকে ফোনে বলছিলেন রাজকুমার। নয়াদিল্লিতে কয়েক দিন প্র্যাকটিসের পর আবার মুম্বই চলে যান বিরাট। ভারত ‘এ’-র সঙ্গে প্র্যাকটিসও করেন। “দেখুন, ও বর্ন লিডার। একটা দু’টো ম্যাচ বা একটা দু’টো সিরিজ দিয়ে ওকে বিচার করবেন না। ওর ব্যাটিং নিয়ে এত কথা হল। আবার তো সেঞ্চুরি করেছে। ক্যাপ্টেন হিসেবেও ও ভাল করবে। আসলে নামটা বিরাট বলেই লোকে প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া রেখে দেয়। দু’টো ম্যাচে না পারলেই কথা শুরু হয়। কিন্তু ওকেও একটু সময় দিতে হবে। আমি বলে রাখছি, ও ভাল ক্যাপ্টেন। খুবই ভাল ক্যাপ্টেন। গাঙ্গুলি টাইপের। গাঙ্গুলির আগ্রাসনটা আমি দেখতে পাই ওর মধ্যে। আর ও যে ভাল ক্যাপ্টেন সেটা এ বার বিরাট প্রমাণ করে ছাড়বে,” একটানা বলে গেলেন রাজকুমার। কোচকে নাকি বিরাট বলেও দিয়েছেন, ক্যাপ্টেন হিসেবে এই তিনটে ম্যাচ আমার কাছে বিশাল সুযোগ। অনেক বেশি দায়িত্ব এ বার নেব।

পরিস্থিতি, পরিবেশও বিরাটের দিকে। প্রথমত, প্রতিপক্ষ। যারা শ্রীলঙ্কা এবং যারা বরাবর বিরাটের বশ্যতা স্বীকার করে এসেছে। যুদ্ধের মঞ্চ উপমহাদেশ হোক কিংবা তার বাইরে, বীরত্বের রাজমুকুট বিরাটের হাত থেকে খুব বেশি খসেনি। শুধু শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেই ৫৫ ম্যাচে তাঁর পাঁচ সেঞ্চুরি সমেত দেড় হাজারের উপর রান আছে। গড় ৫২। ক্রিকেট বিশ্বে মালিঙ্গাকে সবচেয়ে ভাল তিনিই খেলেন। সেই মালিঙ্গাই এ বার শ্রীলঙ্কা টিমে নেই। সাম্প্রতিকে দুর্দান্ত বল করা স্পিনার রঙ্গনা হেরাথও না। ব্যাটিংয়ে গভীরতা দিতে জয়বর্ধনে-সঙ্গকারা-দিলশান আছেন। কিন্তু স্পিন বোলিং? যা শ্রীলঙ্কার পরিচিত মারণাস্ত্র? এরাপল্লি প্রসন্নকে তো সবাই চেনেন। কিন্তু সেকুগে প্রসন্নকে চেনেন কেউ? ম্যাথেউজের মতো কেউ কেউ আগাম বলে রেখেছেন, সিরিজের প্রস্তুতিটাই তাঁরা ঠিক মতো নিতে পারেননি। খুব বেশি প্রত্যাশা না করাই ভাল। দ্বিতীয়ত, বরাবাটি পিচ। কিউরেটর বললেন, শিশির-প্রভাব থাকবে। তবে তিনশো উঠবে। আর ভূমিপুত্র দেবাশিস মোহান্তি তাতে দুপুরে যোগ করে দিলেন, “বিরাটের ভারত জিতবে। ওরা অনেক এগিয়ে।”

অতএব?

অতএব, আগামীকাল মহানদী পাড়ে যেমন শুরু হচ্ছে টিম ইন্ডিয়ার ‘অপারেশন ওয়ার্ল্ড কাপ’, বিশ্বকাপের আগে ভারতবর্ষে শেষ ওয়ান ডে সিরিজে যেখানে দেখে নেওয়া হবে ঋদ্ধিমান সাহাদের (সুস্থ, নেটে ব্যাট করলেন, খেলছেন) মতো ‘নেক্সট লাইন অব ডিফেন্স’-কে, ঠিক তেমনই খোঁজা হবে ধোনি-সাম্রাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকার।

আগামীকাল থেকে ক্যাপ্টেন কোহলির সত্যিই বিরাট হয়ে ওঠার যুদ্ধ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rajarshi gangopadhyay cricket Virat Kohli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE