Advertisement
১১ মে ২০২৪
শতাব্দীর শাপমুক্তি, ঈশ্বরের নয়

লো-র টাফ ফুটবল ধার করে মেসিকে আটকে দিল চিলি

এক বছর আগে মারাকানায় দেখেছিলাম এক অসহায় মেসিকে। যন্ত্রণাকাতর এক ফুটবলারকে। ভেবেছিলাম সে দিনের যন্ত্রণাই মেসিকে ফাইনালে বাড়তি শক্তি জোগাবে। যারা বলে মেসি দেশের জার্সি পরলেই নাকি হারিয়ে যায়, তাদের উচিত জবাব দেবে। কিন্তু স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেল। আবার দেখলাম সেই অসহায় মুখ। সেই ছলছলে চোখ। মনে হল যেন মারাকানার অ্যাকশন রিপ্লে দেখছি।

সুব্রত ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৫ ০২:৪৭
Share: Save:

আর্জেন্তিনা ০(১)
চিলি ০(৪)

এক বছর আগে মারাকানায় দেখেছিলাম এক অসহায় মেসিকে। যন্ত্রণাকাতর এক ফুটবলারকে। ভেবেছিলাম সে দিনের যন্ত্রণাই মেসিকে ফাইনালে বাড়তি শক্তি জোগাবে। যারা বলে মেসি দেশের জার্সি পরলেই নাকি হারিয়ে যায়, তাদের উচিত জবাব দেবে। কিন্তু স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেল। আবার দেখলাম সেই অসহায় মুখ। সেই ছলছলে চোখ। মনে হল যেন মারাকানার অ্যাকশন রিপ্লে দেখছি।

কোপা ফাইনাল শেষ হওয়ার পর একটা প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে। কী এমন স্ট্র্যাটেজি নিল সামপাওলি, যে মেসি পুরো বাক্সবন্দি হয়ে গেল?

সামপাওলির ছক দেখে মনে হল, অনেক দিন থেকেই নির্দিষ্ট একটা প্ল্যানিং করেছেন। মেসির প্রতিটা মুভমেন্ট, প্রতিটা ড্রিবল খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলেন। পরীক্ষিনিরীক্ষা চালিয়েছিলেন মেসিকে আটকানোর। নিটফল, মারাকানার জার্মানির মতোই দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছিল সান্তিয়াগোর চিলি। দুটো দলের মধ্যে ক্লাসের অনেক তফাত। জার্মানির মতো ফুটবলারও নেই চিলিতে। কিন্তু তাতে কী? দেখে তো মনে হল, সামপাওলি অনেকটাই ছক কষেছেন জোয়াকিম লো-কে দেখে। মেসিকে আটকাতে সেই ‘টাফ’ ফুটবলটাই খেলল চিলি। কড়া ট্যাকল। টাইট মার্কিং। নড়াচড়া বন্ধ করে দেওয়া। একজন ফুটবলারকে মানসিক ভাবে ধাক্কা দিতে যা করা দরকার, সব কিছুই দেখলাম।

মেসির বিরুদ্ধে জোনাল মার্কিং নতুন কিছু নয়। মেসির বিরুদ্ধে টাইট মার্কিংও নতুন কিছু নয়। তবে সেটা সফল ভাবে করাটাই তো আসল চ্যালেঞ্জ। চিলি যা ভেবে এসেছিল, পরীক্ষার খাতায় সেই উত্তরগুলো একেবারে ঠিক ভাবেই দিল।

মেসিকে আটকানোর জন্য সামপাওলির তিনটে দাওয়াই ছিল:

এক) মেসির আউটসাইড ডজ বন্ধ করা। কেউ মেসির খেলা যদি ভাল করে দেখেন, বুঝতে পারবেন ওর সবথেকে মারাত্মক অস্ত্র হচ্ছে আউটসাইড ডজ। অনায়াসেই এই জিনিসটা করতে পারে মেসি। জবাবে চিলি কোচ তাই প্যারালাল মার্কিংয়ের ফাঁদে ফেলে দিল মেসিকে। ওকে কভার করছিল দু’জন। এক জন ডিরেক্ট মার্কিং। এক জন ব্লাইন্ড মার্কিং। অর্থাত্ যখন এক জন কেটে যাবে, অন্য জন পিছন থেকে এসে ট্যাকলটা করবে।

দুই) মেসির সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দেওয়া। দেখবেন, বল প্লেয়ার যারা হয়, তারা সব সময় চেষ্টা করে ছোট জায়গায় পাস দিতে। বাকি ফরোয়ার্ডদের সঙ্গে কম্বাইন করতে। কিন্তু মেসির সেই আউটলেটগুলো বন্ধ করে দেয় চিলি। ভাল জায়গায় বল পেলেও কাউকে পাস দেওয়ার জায়গাটা পাচ্ছিল না। বাকিরা যে তখন মার্কড হয়ে গিয়েছে।

তিন) মেসিকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিতে না দেওয়া। শুরু থেকে যত বারই মেসি বল পাচ্ছিল, চিলির প্লেয়াররা কড়া ট্যাকল করছিল। কোনও মুভ তৈরি করতে দিচ্ছিল না। কখনও লাথি মেরে, কখনও জার্সি টেনে ধরে ওকে রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। এটা দেখতে খারাপ লাগলেও আসলে ভাল স্ট্র্যাটেজি। যাকে বলে বিপক্ষের মেন্টাল ডিজইন্টিগ্রেশন। মানসিক ভাবে স্থিত হতে না দেওয়া।

মানলাম মেসিকে আটকে দিয়েছিল সামপাওলি। ৯০ মিনিটের মাথায় মুভটা ছাড়া সে ভাবে সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু বাকিরাও ফ্রি থেকে কী এমন করল। আর্জেন্তিনার ফরোয়ার্ড লাইন দেখলে মনে হবে, কোচ নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। এদের একসঙ্গে নামিয়ে দাও আর ম্যাচ জিতে যাও। কিন্তু এই দলটার ফরোয়ার্ড লাইনকে দূর থেকে ফেরারি মনে হলেও, মাঠে চলেছে ছ্যাকড়া গাড়ির মতো। আগেরো তো একটা হেড ছাড়া বাকি ম্যাচে কিছুই করতে পারল না। ভেবে পেলাম না এই প্লেয়ারটাই তো প্রিমিয়ার লিগের মতো কঠিন লিগে গোল্ডেন বুট জিতেছিল। পাস্তোরে আবার শ্যাডো স্ট্রাইকারে খেলে। কী শ্যাডো করল স্ট্রাইকারকে, বুঝলাম না। অ্যাঞ্জেল দি’মারিয়ার চোট পাওয়াটা খারাপ হল। ও থাকতে উইং থেকে যে আক্রমণটা হচ্ছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে গেল ২৯ মিনিটে উঠে যাওয়ায়। বিশ্বকাপ ফাইনালেও দি’মারিয়ার না খেলাটা আর্জেন্তিনাকে ধাক্কা দিয়েছিল। এখানেও দিল।

এ বার আসি গঞ্জালো ইগুয়াইনের প্রসঙ্গে। ও নাকি দারুণ স্ট্রাইকার। কিন্তু নব্বই মিনিটের মাথায় মেসির তৈরি মুভটা থেকে লাভেজ্জি ওকে যে পাসটা বাড়িয়েছিল, সেটা থেকে গোল হবে না? ইগুয়াইন তো ভুল পায়ে শটটা নিল। ডান পায়ে নিতে গিয়ে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরি করে ফেলল। বাঁ পায়ে কানেক্ট করলে গোলটা পেয়ে যায়। পেনাল্টি কিকটাও জঘন্য ছিল। মনে হল রাগবি শট নিচ্ছে। পাল্লা দিয়ে এভার বানেগাও নিজের শটটা গোলকিপারের দিকে মারল। বুঝলাম না কার্লোস তেভেজের মতো ফুটবলারকে কী করে রিজার্ভে বসিয়ে রাখা হল। ও কি এদের থেকেও খারাপ খেলত?

গোটা টুর্নামেন্টে চিলি যে রকম খেলল, ফাইনালেও তাই করল। শুরুর থেকেই প্রেস করল আর্জেন্তিনাকে। বলের উপর কোনও সময় দিল না। এক জন বল পেলেই দু’তিনজন এসে ঘিরে ফেলল। আবার নিজেদের জোনে আর্জেন্তিনাকে নিয়ে এসে বাধ্য করল ট্যাকল করতে, যাতে হাই ডিফেন্সিভ লাইনের সুযোগ নিতে পারে। আর্জেন্তিনা ডিফেন্স জানতাম খারাপ। কিন্তু এতটা খারাপ সেটা ফাইনাল না দেখলে বুঝতে পারতাম না। ওটামেন্ডি-ডেমিশেলিস মার্কিং করা তো দূর, ওদের কোনও গতিও নেই। ভারগাস-সাঞ্চেজ দেখলাম আরামসে আর্জেন্তিনার ফাইনাল থার্ডে ঢুকে যাচ্ছিল। রোখো-জাবালেতা আবার প্রমাণ করে দিল কেন ফুলব্যাকদের সমালোচনা করা হয়। ওভারল্যাপে উঠতে গিয়ে রক্ষণে ডোবাচ্ছিল। মাসচেরানোও চেনা মেজাজে ছিল না। ফুটবলে বলা হয়, একটা দলের আক্রমণ শুরু হয় ডিফেন্স থেকে। আর্জেন্তিনাকে দেখে সেটা মনে হয়নি।

চিলির আর একটা বড় প্লাস পয়েন্ট ছিল ঘরের মাঠের দর্শক। মনে হচ্ছিল, লাল পতাকায় মোড়া একটা আগুনের গোলার মধ্যে ম্যাচটা হচ্ছে। এই পরিবেশ যে কোনও দলকেই তাতিয়ে দেবে। চিলির বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের পিছনে কিন্তু ওদের বারো নম্বর প্লেয়ার— দর্শক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE