Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
দুই চাণক্যের লড়াই

সাদা শার্টে কালো দাগ মুছতে তৈরি চুম্বনপ্রিয় ‘মোরিনহো’

আন্তোনিও কন্তে যে কতটা ক্ষ্যাপাটে চরিত্র, ইউরো দেখতে বসে এত দিনে গোটা পৃথিবীর ফুটবল-সমাজের জানা হয়ে গিয়েছে। ইতালির খেলা পড়লে রোজ হাতেগরম দেখতেও পাওয়া যাচ্ছে।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
মার্সেই শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৬ ০৪:১১
Share: Save:

আন্তোনিও কন্তে যে কতটা ক্ষ্যাপাটে চরিত্র, ইউরো দেখতে বসে এত দিনে গোটা পৃথিবীর ফুটবল-সমাজের জানা হয়ে গিয়েছে। ইতালির খেলা পড়লে রোজ হাতেগরম দেখতেও পাওয়া যাচ্ছে। টিম জিতলে শিশুর উচ্ছ্বাস, গোল খেলে তীব্র উত্তেজিত, নব্বইয়ের মধ্যে পাঁচ মিনিটও ইতালি কোচকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে এতটা?

বছর ছয়েক আগে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে লিওনেল মেসিদের ট্রেনিংয়ের সময় বিকট এক শাস্তির উপায় আবিষ্কার করেছিলেন কোচ দিয়েগো মারাদোনা। পরিষ্কার হিসেব— প্র্যাকটিসে কেউ ভুল করলে সোজা তার পশ্চাদ্দেশে বল মারো! কন্তে মারাদোনা নন। আর দিয়েগোর পাগলামির ঈশ্বর-প্রদত্ত ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কলজে কন্তে কেন, এই গ্রহে বোধহয় কারও নেই। কিন্তু কন্তেও তাই বলে খুব পিছিয়ে নেই। বেশ বিদঘুটে একটা টিম বন্ডিং সেশন আবিষ্কার করেছেন। যুদ্ধের আগে বুফন-পেল্লেদের যা নিয়ম করে করতে হচ্ছে।

কিছুই না, চুমু খেতে হবে!

প্লেয়াররা একে অন্যকে চুমু খাবেন। তার পর কন্তে একে-একে খাবেন সবাইকে!

ইতালির এক কাগজে বৃহস্পতিবার খবরটা বেরিয়েছে। আজুরি মিডফিল্ডার আলেসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জি নানা কথা বলতে-বলতে দুম করে এটাও বলে ফেলেছেন। “ইতালিকে একটা সংসার উনি বানাতে চাইছেন। ম্যাচে নামার আগে উনি আমাকে একা নয়, সবাইকেই চুম্বন করেন!”

একজন বিদগ্ধ ফুটবল কোচ প্রাপ্তবয়স্ক ফুটবলারদের চুম্বন করেন!

ইনি জোসে মোরিনহো নাকি?

একদম মোরিনহো!

শুধু মাঠের পাগলামি নয়, মাঠের বাইরের জীবনেও কন্তের যে কত মিল প্রখ্যাত পর্তুগিজের সঙ্গে। মেসিকে আটকে দিয়ে মোরিনহো একবার বলেছিলেন, কেমন দিলাম তো মেসির সামনে এরোপ্লেন দাঁড় করিয়ে! শুনে বিশেষজ্ঞরা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। কন্তেও তেমন ইতালি ফুটবল ফেডারেশনকে মোটামুটি এক সিদ্ধান্তে উন্মাদ করে ছেড়ে দিয়েছেন। জুভেন্তাসকে ট্রফির পর ট্রফি দেওয়ার পরেও আচমকা একদিন ‘চললাম হে’ বলে আজুরি টিমের রিমোট হাতে নিয়েছিলেন কন্তে। ব্রাজিল বিশ্বকাপে প্রান্দেলি জমানার বিপর্যয়ের পর রিমোট পেতে অসুবিধেও হয়নি। ফ্রান্স ইউরো-ই কন্তের দেশকে নিয়ে তাঁর প্রথম বড় ফুটবল-যজ্ঞ। কিন্তু কোথায় কী, উল্টে আবার ‘চললাম হে’!

ইউরোর আগেই কন্তে বলে দেন ইতালির হয়ে এটাই তাঁর শেষ অ্যাসাইনমেন্ট। তিনি ফিরতে চান ক্লাব ফুটবলের ডে টু ডে ওয়ার্কের গতিময় জীবনে। জাতীয় জার্সির অলস ওয়ার্ক চার্টে আর থাকবেন না। শুনে তিতিবিরক্ত ইতালি ফুটবল ফেডারেশন এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল, প্রেসিডেন্ট কার্লো তাভেচ্চি বলে দিয়েছিলেন, “এ সব লোককে আনাই অর্থহীন। যারা নিজেদের অতীত মনে রাখে না। দুমদাম ক্লাব ফুটবলে চলে যায়।”

অতীত! অতীতই কি এমন দুমদাম অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দেয় আন্তোনিও কন্তেকে?

শনি-সন্ধেয় কোয়ার্টার ফাইনালে যে লোকটার বিরুদ্ধে নামবেন তিনি, তাঁর তো কত প্রশংসা, কত সার্টিফিকেট। জার্মানির জোয়াকিম লো-র নামে কেউ নিন্দে করে না। প্লেয়ারদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয়, য়ুরগেন ক্লিন্সম্যান ছেড়ে দেওয়ার পর বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগাররা সর্বাত্মক চেয়েছিলেন, লো দলের দায়িত্ব নিন। লো-র অভিন্নহৃদয় বন্ধু রোল্যান্ড ইটেল একবার বলেছিলেন, “ইয়োগিকে প্লেয়াররা ভালবাসে কারণ ও খবরদারি করে না। প্লেয়ারদেরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে সেটা বোঝে।”

ঠিকই বলেছিলেন। পুরনো জার্মান ফুটবল-গুরুদের দর্শনের বাইরে গিয়ে প্লেয়ারদের জন্য রিসর্টের নকশা নিজের হাতে তৈরি করেন লো। হাড়ভাঙা খাটুনির নির্দেশ নিয়ে প্লেয়ারদের উপর চড়াও হন না, বরং স্মার্ট ফুটবলের উপর জোর দেন। ঠিক করেন একটা রোনাল্ডোকে কী ভাবে আটকানো যায়, ঠিক করেন ম্যাচের মধ্যে গ্রাউন্ড পজিশনিং কী ভাবে পাল্টানো উচিত। নিজের দর্শনের সঙ্গে মেশান জার্মান জাত্যভিমান। টিমকে নিয়ে চলেন শ্রেষ্ঠত্বের একের পর এক স্টেশনে। ব্রাজিলে বিশ্বজয় এমনি আসেনি। ইউরো কোয়ার্টার ফাইনাল মঞ্চেও তিনি এমনি দাঁড়িয়ে নেই।

লো-র ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি— সেটাও তো বহু দিনের বিখ্যাত। অ্যাস্ট্রোনমার জোহানেস কেপলার, মার্সিডিজ বেনজ্ আবিষ্কারক কার্ল বেনজ্রে-র জন্মস্থান ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চলের মানুষ তিনি। ব্রাজিল বিশ্বকাপে তাঁর নিপাট ভদ্রতা, স্বভাবশান্ত মননের পরিচয়ই হয়ে গিয়েছিল তাঁর একটা শার্ট। সাদা শার্ট।

ইউরোয় লো সব সময় সাদা শার্ট আর পরছেন না। কিন্তু কন্তে চাইলেও পরতে পারবেন কি? সিয়েনায় কোচিং করানোর সময় ম্যাচ গড়াপেটার অপরাধে চার মাসের নির্বাসন হয়েছিল কন্তের। ইতালির মোরিনহোর যে কলঙ্ক নিয়ে আজও কথা হয়। ফুটবলার হিসেবে তাঁর সাফল্য, কোচ হিসেবে জুভেন্তাসে স্মরণীয় সময়ও ভুলিয়ে দিতে পারে না যে কলঙ্ক।

ইতালির কাগজে দেখা গেল ফ্লোরেঞ্জিদের নিয়ে আরও লিখেছে। কোচের উপর অগাধ বিশ্বাসে ফ্লোরেঞ্জি বলছেন, “জার্মানির এভারেস্ট আমরা ঠিক টপকাব। কন্তেই পার করে দেবেন।” কন্তের আর এক ফুটবলার ইম্মোবাইল আবার বলেছেন, “ছোঃ, জার্মানি আমাদের সামনে পড়লেই হারে।”

আন্তোনিও কন্তে মুখে যা-ই বলুন, তিনি নিজেও জানেন অতীতকে হারাতে গেলে এই ম্যাচটা জেতা বড় দরকার। ইতালি ইউরো চ্যাম্পিয়ন হোক না হোক, বিশ্বজয়ীদের পরাভূত করা খুব প্রয়োজন।

আর কলঙ্কের দাগ মুছতে সাদা শার্টের চেয়ে ভাল কী হতে পারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Germany Italy match coaches
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE