Advertisement
১১ মে ২০২৪

ভারতীয় ক্রিকেটের এই আজ্জুর মূলধন সততা

আতঙ্কিত মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ!

গৌতম ভট্টাচার্য, নয়াদিল্লি
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:০২
Share: Save:

ওয়াংখেড়ে স্টে়ডিয়ামে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীর সেই সর্বাত্মক হাহাকারের দিন! সচিন তেন্ডুলকর একটু আগে বিদায় নিয়েছেন ক্রিকেট থেকে।

ড্রেসিংরুমের মধ্যে নিজেকে সামলানোর সময়টা চলে গিয়েছে। আবেগ অপেক্ষাকৃত নিয়ন্ত্রণে। এ বার তেন্ডুলকর ডাকলেন টিমের দুই মুম্বইকর রোহিত শর্মা আর অজিঙ্ক রাহানেকে। বললেন, ‘‘আমি চললাম। আজ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুম্বই ক্যাপের মর্যাদা রাখার দায়িত্ব তোমাদের। কথা দাও রাখবে।’’ রোহিত এটা শুনেও সংযত ছিলেন কিন্তু রাহানে কেঁদে ফেলেন।

ড্রেসিংরুমে কিছু পরে ঢুকেছিলেন অঞ্জলি তেন্ডুলকর। ওই বিশেষ ম্যাচে সচিন পরিবারকে ম্যাচের পর ড্রেসিংরুমে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল। রাহানের চোখে জল দেখে বিস্মিত অঞ্জলি জানতে চান, কী হয়েছে? সব শুনেটুনে তাঁকে সান্ত্বনা দেন, ‘‘সত্যি তো এ বার থেকে তোমার দায়িত্ব। সচিন আর আমি তোমাকে নিয়ে খুব আলোচনা করি। দু’জনেই মনে করি তুমি পারবে।’’

শেন ওয়ার্ন নাম দিয়েছিলেন জিঙ্কস। অনেকে তাই ডাকে।

কিন্তু মুম্বই ক্রিকেটমহল তাঁকে ডাকে ‘আজ্জু’ বলে। আর সেই নামটাই এখন বেশি ছড়িয়ে গিয়েছে।

ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন আজ্জু তিনি। দু’বছর হল টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন কিন্তু গোড়ায় তাঁর ওপর কারও নজরই পড়েনি। ধারাবাহিক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রান করেও তারকার কোনও দ্যূতি নেই তাঁর ওপর। অবাক হয়ে গেলাম আজ টেস্টের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির পরেও সাংবাদিক সম্মেলনে এলেন না দেখে। যে কেউ হলে জীবনের এত বড় দিনে মিডিয়ার সামনে আসার সুযোগ ছাড়ত না। কাল তো আর সেটা হবে না। শেষ দিন ক্যাপ্টেনের প্রেস কনফারেন্স।

কিন্তু দু’হাজার পনেরোর ডিসেম্বর অবধি রাহানে লিখতে গেলে এই চরিত্রকেই লিখতে হবে। রোহিত আর তিনি উত্তর মেরু আর দক্ষিণ। রোহিত থাকেন বান্দ্রার পালি হিলে বান্ধবীর সঙ্গে। নিয়মিত পার্টি করেন। ওয়ান ডে শটের মতোই ফ্ল্যামবয়েন্সে বিশ্বাস করেন। রাহানে ঠিক উল্টো। সাবেকি সেই মরাঠি ক্রিকেটারদের মতো। তাঁদের মতো দক্ষিণ মুম্বইয়ের দাদর বা মাতুঙ্গা থেকে উত্থান নয়। তিনি থাকেন মুলুন্দে। মুম্বইয়ের নৈহাটি। নৈহাটি থেকে অবশ্য এয়ারপোর্ট যেতে পৌনে দু’ঘণ্টা লাগে না। মুলুন্দের বাড়ি থেকে তাঁর যা লাগে। প্র্যাকটিস করেন বান্দ্রা কুর্লায়। সেটাও সওয়া ঘণ্টা।

ঘনিষ্ঠরা বহু বুঝিয়েছে, তুইও রোহিতের মতো বান্দ্রা ওয়েস্টে চলে আয় না। বউকে নিয়ে চলে আয়। সামর্থ্যের তো অভাব নেই। কিন্তু আজ্জু হলেন পুরনো মানসিকতা সম্পন্ন। যে বাবা-মা তাঁকে তুলে আনার জন্য মধ্যবিত্ত সঙ্গতির মধ্যেও প্রাণপাত করেছেন তাঁদের ছেড়ে তিনি কী করে চলে যান? বাবা-মা যদি পুরনো পাড়া ছাড়তে না চান তো তিনিও মহল্লা ছাড়বেন না।

রাহানে কাহিনিতে সবচেয়ে অনবদ্য তাঁর সমালোচনা নেওয়ার ধরনটা। যা বিনয়ী শিক্ষার্থীর মনন ছাড়া সম্ভবই না। এই কোটলায় তাঁর আউট হওয়ার ভঙ্গি দেখে কটাক্ষ করেছিলেন সুনীল গাওস্কর। খাঁটি মুম্বই ব্যাটসম্যান কেন এমন হুড়ুমতাল চালিয়ে আউট হবে? রাহানেকে বন্ধুরা পরে এ কথা জানায়। তিনি বলেন, ‘‘উনি তো ঠিকই বলেছেন। মুম্বই ব্যাটসম্যান এই ভঙ্গিতে আউট হয় না। পরবর্তী কালে আমার লক্ষ্য থাকবে মজবুত ব্যাটিং করে ওঁকে দেখানো যে, স্যর আমি পেরেছি।’’

ধোনির বেলাতেও তাই। ধোনি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বিতর্কিত মন্তব্য রাহানে সম্পর্কেই বলেছেন যে, ওয়ান ডে-তে রাহানে দ্রুত মারতে পারেন না। তাঁর স্ট্রাইক রেট অনেক ভাল করা জরুরি, এই সব। বলে এক-আধ বার বাদও দিয়েছেন টিম থেকে। রাহানে এখন টেস্ট টিমের ভাইস ক্যাপ্টেন। টিমে গ্রহণযোগ্যতা খুব ভাল। সহজেই এটা নিয়ে ঘোঁট পাকাতে পারতেন। সে রাস্তাতেই যাননি। বরং ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, ‘‘আমি যখন নীচের দিকে নামি তখন ফিল্ড স্প্রেড হয়ে যায়। ওপেন পাঠালে স্ট্রাইক রেট অনেক বেটার হত। কিন্তু সেটা যথেষ্ট যুক্তি নয়। আমাকে এখন শিখতে হবে ফিল্ড পিছনে থাকলে যে ধরনের স্ট্রোক খেলতে হয়, তাতে আরও কন্ট্রোল আনা।’’

বারবার নিজেকে এই ভাবে চ্যালেঞ্জ করে এগোন রাহানে। লর্ডস টেস্টের আগে তাঁকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেছিল, এই সেই মাঠ যেখানে তোর সচিন পাজিও হান্ড্রেড পায়নি। দেখ চেষ্টা করবি কি না। রাহানে পরের দিন সেঞ্চুরি করেন। প্রথম বিবিএমে যাঁর মেসেজ দেখতে পান তিনি সচিন। ‘আমি জানতাম তুই এটা পারবি।’ এর আগে জীবনে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি যখন মাত্র চার রানের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেলে আসেন সেই সচিনই তাঁকে মেসেজ করেছিলেন, বুঝলি জীবনে চার রানটাও কত ভাইটাল। রান কোনও দিনও নষ্ট করবি না। এক রানও না।

এমনিতে তাঁর কোচ প্রবীণ আমরে, যিনি ভারতীয় ক্রিকেটে অনেকেরই পথপ্রদর্শক। তফাতের মধ্যে রাহানেকে কোচিং করিয়ে আমরে কখনও টাকা নেননি। তাঁর মনে হয়েছে এই ছেলেটির জন্য আমি আলাদা মনোভাব নিতেই পারি। ও তার যোগ্য।

এত কষ্ট করে এত সাধনার পর উঠে এসেছেন রাহানে। কিন্তু ভাগ্য একদিক থেকে তাঁর যাবতীয় সীমাবদ্ধতা ধুয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে তিনি পাশে পেয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের ব্রহ্মা-বিষ্ণুকে। সচিন আর দ্রাবিড়।

বন্ধুদের মজা করে রাহানে বলে থাকেন, ‘‘আমার লাকটা ভাব। সারা বছর আমরে স্যর। কোনও অসুবিধেয় পড়লে সচিন পাজি। আর আইপিএলে টানা দেড় মাস রাহুল ভাই। যে কোনও টেকনিক্যাল সমস্যার দ্রুত সমাধান আমি পেয়ে যাই।’’

শুনছিলাম ট্যুরে যখন যান, সঙ্গে থাকে নানা মোটিভেশনাল বই। তার মধ্যে অনিবার্য ভাবে একটা শিবাজি জীবনচরিত। শিবাজির সাহস দেখে নাকি অনুপ্রেরণা নেন রাহানে। কোথাও যেন তিনি ক্রিকেটে সেই মুম্বইয়ের পুরনো স্কুলেরই প্রতিনিধি। সেই একই চেতনা। একই দর্শন। এক রকম সাহস।

ভারতীয় ক্রিকেট তার দ্বিতীয় আজ্জুকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখছে শুধু একটা শর্তের ওপর ভিত্তি করে। যা পূরণে প্রথম আজ্জু ব্যর্থ। ক্রিকেট সততা। রাহানে ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, এটা থাকবেও। ঘুরলে এত দিনে মাথা ঘুরে যেত। ও সে রকম নয়।

না হওয়াটাই তাঁর সেরা সুগন্ধী। প্রথমটার তিক্ত অভিজ্ঞতার পর ক্রিকেটমোদী হয়তো আপাতত শব্দটা ব্যবহার করতে চাইবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE