Advertisement
১১ মে ২০২৪

ক্রিকেট সততার মহাযুদ্ধও জিতলেন কোহলি

অম্বেডকর স্টেডিয়ামের ঠিক সামনে রঙের ছোট বাক্স নিয়ে দুই চিত্রশিল্পী ঘুরে বেড়াচ্ছে। জাতীয় পতাকার রঙে কোটলা দর্শকের মুখ রাঙাবে বলে। সোমবার সকাল ন’টা। খরচা কত? চা-বিরতির পর যখন কোহলির ভারত পরের পর উইকেট ফেলে জয়ের মুখে, তখন রেটের নড়চড় হয়েছিল কি না জানি না। কিন্তু তখন অবধি যাচ্ছিল ব্যক্তিপিছু দশ টাকা। এমনি দিনে এরাই চল্লিশ টাকা অবধি নেয়। সহজতম সঙ্কেত— সমর্থকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার দালাল স্ট্রিটে ভারত আজ খুব উজ্জীবিত অবস্থায় নেই।

ছবি: প্রেম সিংহ

ছবি: প্রেম সিংহ

গৌতম ভট্টাচার্য
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:২৬
Share: Save:

অম্বেডকর স্টেডিয়ামের ঠিক সামনে রঙের ছোট বাক্স নিয়ে দুই চিত্রশিল্পী ঘুরে বেড়াচ্ছে। জাতীয় পতাকার রঙে কোটলা দর্শকের মুখ রাঙাবে বলে। সোমবার সকাল ন’টা।

খরচা কত? চা-বিরতির পর যখন কোহলির ভারত পরের পর উইকেট ফেলে জয়ের মুখে, তখন রেটের নড়চড় হয়েছিল কি না জানি না। কিন্তু তখন অবধি যাচ্ছিল ব্যক্তিপিছু দশ টাকা। এমনি দিনে এরাই চল্লিশ টাকা অবধি নেয়। সহজতম সঙ্কেত— সমর্থকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার দালাল স্ট্রিটে ভারত আজ খুব উজ্জীবিত অবস্থায় নেই। কোটলা মাঠের পাশাপাশি যে বড় রাস্তাটা চলে গিয়েছে, সেই বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ দিয়ে ঢুকতে হয় মিডিয়া এনক্লোজারে যাওয়ার জন্য। মেটাল ডিটেক্টর বসানো পরপর চারটে গেট। মিডিয়া ছাড়াও নানান স্ট্যান্ডের লোক ঢোকে সেখানে। সব সময় তাই মিনি ভিড়। অথচ আজ সেটাই দেখাচ্ছে জটলাশূন্য।

দক্ষিণ আফ্রিকার আমদানি করা ‘ব্লকাথন’ দেশজ সমর্থকদের আবেগকে আক্রান্ত করে রেখেছে বোঝা গেল। কিন্তু তার চেয়ে ঢের আশঙ্কাজনক তখন দিল্লির আকাশ। কুয়াশায় ভরা। আলো এত কম আর ঠান্ডা-ঠান্ডা যে গুলিয়ে যাবে কোটলার রাস্তা, না কি এখনই লন্ডন টিউব করে সেন্ট জন্‌স উড স্টেশনে এসে নামলেন বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত মাঠে ক্রিকেট দেখবেন বলে!

টেনিসের ভাষায় একে বলে ডিউস। সরি, ডিউস তো সমান সমান পরিস্থিতি। এটা অ্যাডভান্টেজ আউট। একে দক্ষিণ আফ্রিকা এত ব্লক করে খেলছে। তার ওপর শেষ দিন আট উইকেটের জন্য পুরো নব্বই ওভারও পাওয়া যাবে কি না, ঘোরতর সন্দেহ। এই কুয়াশা-কুয়াশা আলোয় কোথা থেকে হবে নব্বই? অথচ এত দিনে সবাই জেনে গিয়েছে যে কোটলা টেস্ট তো নিছক জেতার জন্য খেলা হচ্ছে না। টেস্টের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একটা সুপার টেস্ট। যা ড্র হলে কেবল গাঁধী-ম্যান্ডেলা সিরিজই জেতা যাবে। সততার আদালতে বিচারাধীন মামলা জেতা যাবে না যে, ভারত টার্নার ছাড়াও আমলার দলবলকে চূর্ণ করতে পারত।

সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথ বধের মতো অতি প্রয়োজনীয় মিশন ছিল বাকি আট উইকেট ফেলা। অথচ এখানে সূর্যকে ঢাকবে কে? আমলা-ডে’ভিলিয়ার্স যে ভাবে ব্লকিং শুরু করলেন তাতে কালকেরই হুবহু অ্যাকশন রিপ্লে। কী করতে পারেন ভারত অধিনায়ক? নিজে এক ওভার বল করলেন। ও দিকে পূজারা। যদি ব্যাটসম্যান ‘ছোকরা’ বোলার দেখে প্রলুব্ধ হয়। অতঃপর যে সব ডেলিভারি তাঁদের হাত থেকে বেরোল, অনূর্ধ্ব চার টুর্নামেন্টেও কেউ আউট হবে না। আর ব্যাটসম্যানরা কি না স্বপ্নের শর্ট পিচও মারছে না। এ তো মন্থর পিচের ওপর অবস্থান ধর্মঘট।

টিয়ার গ্যাস না চালালে হবে না। আর সেই লোক তখন পাওয়া যাচ্ছে না ভারতীয় ক্যাপ্টেনকে আরও ভয়ে আক্রান্ত রেখে— এই বুঝি আলো চলে গেল।

ক্রিকেট ইতিহাস দেখাবে, আলো যাওয়ার অনেক আগেই যে প্রোটিয়া-প্রতিরোধ শেষ হয়ে গেছিল। ৩৩৭ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ওঠার পরমুহূর্তেই ভারত অধিনায়ক ঝাঁপিয়ে উঠে গেলেন ম্যান অব দ্য সিরিজের কোলে। কোহলি-অশ্বিন প্রগাঢ় আলিঙ্গনাবদ্ধ দৃশ্যটা দেখে তিরাশির বিশ্বকাপ জয়ের পর একান্তে লর্ডস ব্যালকনিতে সুনীল-কপিল মনে পড়ে গেল! হোক না সেটা বিশ্বকাপ, এটা দুই দেশীয় সিরিজ। কৌলীন্যে এ বারের ৩-০ আমলা নিধনও ভারতের সর্বকালের সেরা সিরিজ জয়ের অন্যতম।

বিশ্বের এক নম্বর টিম যারা দেশের বাইরেও গত ক’বছর অপরাজেয়, তাদের এটা স্রেফ নাকখত দিয়ে হারানো। স্টিভের টিমকে সৌরভরা হারানোর পর বলা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান অশ্বমেধের ঘোড়া থামানো গিয়েছে। পনেরো বছর পর অস্ট্রেলিয়া নামটা বদলে দেওয়া হোক।

টার্নার ছাড়া জিততে পারে না ভারত— এমন কথা সিরিজ জুড়ে আমলা এক বারও বলেননি। বরঞ্চ সপ্রশংস স্বীকার করেছেন, ওরা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল ক্রিকেট খেলেছে। তবু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বাজারে বিরুদ্ধ প্রচারটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায়। ভারত শুধু সেই ধারণাকেই হারায়নি, একটা নৈতিক যুদ্ধেও জিতেছে। গোটা সিরিজে এক বারের বেশি আমলা-তন্ত্রে দুশো রান ওঠেনি, সেটা বলছি না। এই যে কুঁকড়ে ম্যাচ বাঁচানোর জন্য ব্লকিং স্ট্র্যাটেজি নিতে হল, এটাও তো নৈতিক জয়। তোরা বিশ্বের এক নম্বর টিম। কোথায় উড়িয়ে দিবি, না প্রাণভিক্ষায় ডিফেন্স করে যাচ্ছিস।

ব্লকিং শব্দটার নেভিল কার্ডাস যুগে অন্য একটা নাম ছিল— স্টোনওয়ালিং। বিল পন্সফোর্ড সম্পর্কে সবচেয়ে ব্যবহৃত এই অভিব্যক্তি গত কয়েক বছরে একাধিক বার সফল ভাবে ব্যবহার করেছেন ডে’ভিলিয়ার্সরা। কিন্তু কোহলির এই টিম জিততে এত মরিয়া আর অশ্বিন নামক কেউ এত আগ্রাসী যে, সফরকারী দল নিস্তার পেল না। আমলা করেছেন ২৪৪ বলে ২৫। ডে’ভিলিয়ার্স ২৯৭ বলে ৪৩। ম্যাচের চতুর্থ ইনিংস দশ বছর বাদেও আজব লাগবে। ইনিংসে বল হওয়া ১৩৬ ওভারের মধ্যে ৮৭ মেডেন। আর অশ্বিন? তাঁর পরিসংখ্যানও তো আজব। সিরিজে ৩১ উইকেট। উইকেটপিছু গড় ১১। গোটা সিরিজে মাত্র একটাই ভুল করেছেন। জয়ের আবেগে ম্যান অব দ্য সিরিজ পুরস্কারটা চেন্নাইবাসীকে উৎসর্গ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। রাতে টুইটারে ভুল সংশোধন করে নিলেন। এই মুহূর্তে বোধহয় ‘অশ্বিন ক্যান ডু নো রং’।

এ সব তো জিতে ওঠার পর সুখকর দিক। চা-বিরতিতেও বোঝা যাচ্ছিল না ম্যাচ কোন দিকে ঝুঁকবে? বিদেশিরা পাঁচ উইকেটে ১৩৬। ডে’ভিলিয়ার্স ক্রিজে। আর মাত্র চব্বিশ ওভার কাটিয়ে দিলেই ম্যাচ ড্র। ভারতীয় দল ক্লোজ ইনে তখন সাত জনকে এনেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এ ভাবে সব ডেলিভারিতে ঠুকঠুক চললে পাঁচ উইকেট পড়বে কী করে? এই ব্রেকটাতেই টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী আইডিয়া দিলেন, উমেশকে দিয়ে অ্যাটাক শুরু করো। দ্যাখো ও রিভার্স সুইং পায় কি না? কোহলি খুব উদ্দীপ্ত অধিনায়কত্ব করেন। উদ্ভাবনী ফিল্ড সাজান। সারাক্ষণ জেতার জন্য ছটফট করেন। যা দেখলেও বিনোদন। কিন্তু শাস্ত্রী হলেন টিমের মগজাস্ত্র। ওঁদের কম্বিনেশনটা আবেগ আর মাথার। যা সত্যিই জমে গিয়েছে।

নায়ককে নিয়ে বিজয় উৎসব। সোমবার কোটলায়। ছবি: পিটিআই

ময়দানি ভাষায় চায়ের পর প্রথম ওভারেই উমেশ খেলাটা খুলে দিলেন। পরের ওভারে অশ্বিনের অফ স্পিন বাড়তি লাফাল এবং ঘুরল। ডে’ভিলিয়ার্স অতটা টার্ন সামলাতে পারেননি। লেগ স্লিপে জাডেজা পেলেন দুটো ক্যাচ। ডে’ভিলিয়ার্স এবং কোটলা। ম্যাচে এর পর দ্রষ্টব্য একটাই পড়ে ছিল। ঋদ্ধিমান সাহার ফার্স্ট স্লিপের সামনে ঝাঁপিয়ে অনবদ্য ক্যাচ। ঋদ্ধির এ বারের সিরিজের কিপিং তাঁর শেষ পূর্বসূরিকে ভুলিয়ে দিয়েছে। এ বার শুধু নিয়মিত ব্যাটে রান করার চ্যালেঞ্জ।

শেষ পূর্বপুরুষ বলতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে, কোহলি তো আবার কাল থেকে ভারত অধিনায়ক নন। পাকিস্তান সিরিজ হলেও ধোনি ফের ক্যাপ্টেন। ওখানে টেস্ট নেই। সিরিজ না হলেও জানুয়ারির শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় টিম নিয়ে তিনি যাবেন ওয়ান ডে সিরিজ খেলার জন্য। তার পর বিশ্ব টি-টোয়েন্টি রয়েছে। সেখানেও সম্ভাব্য নেতা তিনি। বিরাট তাঁর মসনদ ফিরে পাবেন জুলাই নাগাদ। যখন ভারত তার পরের টেস্ট সিরিজ খেলবে।

টিমের খোলনলচে যে ভাবে বদলেছেন কোহলি, তাতে ভাবাই যায় না টিমে এ বার তাঁর বিপরীতমুখী ক্রিকেট-দর্শন ঢুকবে বলে। তিনি পরপর দুটো টেস্ট সিরিজ জিতলেন। ধোনি হেরেছেন পরপর দুটো। বাংলাদেশ আর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। টি-টোয়েন্টি ধরলে তিনটে। বিশ্বকাপ ধরলে চারটে।

রাতে টিম হোটেলে শ্যাম্পেনের বোতল খোলার আগেই এই প্রসঙ্গটা অপ্রীতিকর বুদবুদ হয়ে বেরিয়ে পড়ছে। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের দর্পচূর্ণে তো র‌্যাঙ্কিংয়ে দুইয়ে ওঠা গেল, নেতৃত্বের সর্বাত্মক রাজমুকুটের জন্য কোহলি আর কত অপেক্ষা করবেন?

ভারত
প্রথম ইনিংস: ৩৩৪
দ্বিতীয় ইনিংস: ২৬৭-৫ ডিঃ

দক্ষিণ আফ্রিকা
প্রথম ইনিংস: ১২১
দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ৭২-২)

আমলা বো জাডেজা ২৫
ডে’ভিলিয়ার্স ক জা়ডেজা বো অশ্বিন ৪৩
দু’প্লেসি এলবিডব্লিউ জাডেজা ১০
দুমিনি এলবিডব্লিউ অশ্বিন ০
ভিলাস বো উমেশ ১৩
অ্যাবট বো উমেশ ০
পিয়েড ক ঋদ্ধিমান বো উমেশ ১
মর্কেল বো অশ্বিন ২
তাহির ন.আ. ০

অতিরিক্ত ১১
মোট ১৪৩
পতন: ৫, ৪৯, ৭৬, ১১১, ১১২, ১৩৬, ১৩৬, ১৪০, ১৪৩
বোলিং: ইশান্ত ২০-১২-২৩-০, অশ্বিন ৪৯.১-২৬-৬১-৫, জাডেজা ৪৬-৩৩-২৬-২, উমেশ ২১-১৬-৯-৩, ধবন ৩-১-৯-০, বিজয় ২-০-২-০, কোহলি ১-১-০-০, পূজারা ১-০-২-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE