Advertisement
১১ মে ২০২৪

বিদেশে খাওয়া তেতো ওষুধেই এ বার ক্রিকেট মক্কায় পাল্টা মার

পাঁচের দশক হোক কিংবা সাত, আটের দশক হোক বা নয়, ভারতীয় ক্রিকেট টিম বিদেশে যাওয়া মানে এত দিন একটা ওষুধ বরাদ্দ থাকত। নয়ের দশকেই থামব কেন, বছর আট আগে পর্যন্তও ওষুধটা একই ছিল। টিম ইন্ডিয়া বিদেশে নামা মানে উপহার হিসেবে দিয়ে দাও একটা সবুজ পিচ। পাঁচ দিন সেখানে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের উপর শর্ট বোলিংয়ের বুলডোজার চালিয়ে মানসিক এবং ক্রিকেটীয় দিক থেকে টিমটাকে চুরমার করে দাও।

সাতটি উইকেট নিয়ে বিধ্বংসী মেজাজে ইশান্ত শর্মা। ছবি: গেটি ইমেজেস

সাতটি উইকেট নিয়ে বিধ্বংসী মেজাজে ইশান্ত শর্মা। ছবি: গেটি ইমেজেস

দীপ দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

পাঁচের দশক হোক কিংবা সাত, আটের দশক হোক বা নয়, ভারতীয় ক্রিকেট টিম বিদেশে যাওয়া মানে এত দিন একটা ওষুধ বরাদ্দ থাকত। নয়ের দশকেই থামব কেন, বছর আট আগে পর্যন্তও ওষুধটা একই ছিল। টিম ইন্ডিয়া বিদেশে নামা মানে উপহার হিসেবে দিয়ে দাও একটা সবুজ পিচ। পাঁচ দিন সেখানে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের উপর শর্ট বোলিংয়ের বুলডোজার চালিয়ে মানসিক এবং ক্রিকেটীয় দিক থেকে টিমটাকে চুরমার করে দাও। চার ক্যারবিয়ান ফাস্ট বোলার হোক, বা লিলি-টমসন, নয়ের দশকে ওয়াসিম-ওয়াকার, ডোনাল্ড-ফ্যানি ডে’ভিলিয়ার্স বা তারও পরে ম্যাকগ্রা-ব্রেট লি কোথাও-ই অস্ত্রটা পাল্টায়নি। আট-দশ বছর আগেও বিদেশে ইন্ডিয়া মানে ছিল, ব্যাটসম্যানের থুতনি টার্গেট করে শর্ট। অবধারিত চিন মিউজিক শোনানোর গল্প!

লর্ডসের ঐতিহাসিক মঞ্চে সোমবার ভারতীয় ক্রিকেটের শুধু একটা ঐতিহাসিক জয় দেখলাম, তা বলব না। কেন জানি না মনে হচ্ছে, লর্ডস ভারতীয় ক্রিকেটের একটা ঐতিহাসিক ট্রেন্ডেরও জন্ম দিয়ে গেল! যে টোটকায় আমাদের এত দিন ইংরেজ-অস্ট্রেলীয়রা মারত ওদের দেশে, সেই টোটকায় কি না এখন আমরা ওদের চোখে অন্ধকার দেখিয়ে দিচ্ছি! ইশান্ত শর্মার শর্ট পিচড ডেলিভারি খেলতে গিয়ে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছে ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা! কেউ একগুঁয়ের মতো চালাচ্ছে আর ফিল্ডারের হাতে জমা করে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার নিজেকে বাঁচাতে চোখ-টোখ বন্ধ করে প্রায় ক্রিজেই শুয়ে পড়ছে! এক-এক সময় দেখতে দেখতে অবিশ্বাস্য ঠেকছিল যে সাদা জার্সিটায় সত্যিই ভারত খেলছে কি না! আরে, এ তো মিচেল জনসন করে আমাদের সঙ্গে। জিমি অ্যান্ডারসন করে আমাদের সঙ্গে। ডেল স্টেইন-মর্নি মর্কেল করে থাকে। আর ওরা নিজেদের মধ্যে ম্যাচ হলে করে। জনসনের পাল্টা দেয় স্টেইন। অ্যান্ডারসনকে মর্কেল। আমরাও সেই পৃথিবীতে তা হলে ঢুকে পড়লাম নাকি?

মনে হচ্ছে, পড়লাম। আমার মনে হয়, লর্ডস টেস্ট পরবর্তী ভারতীয় টিম বিদেশে যখন নামবে, সাহেবরাই আমাদের দেখে ভয় পাবে। উদাহরণ চাই? অ্যালিস্টার কুকের ইংল্যান্ডই তো আছে। সাউদাম্পটনে পরের টেস্টে কী উইকেট রাখবে ইংল্যান্ড? বাউন্সি? ধোনি একটা ইশান্ত শর্মাকে আবার ছেড়ে দেবে। পাটা? আমাদের একটা মুরলী বিজয়-অজিঙ্ক রাহানে-চেতেশ্বর পূজারা থাকবে। সুইং-উপযোগী উইকেট? ঠিক আছে, তা হলে একটা ভুবনেশ্বর কুমার থাকল।

আঠাশ বছর পর লর্ডসে টেস্ট জেতার পর অনেককে বলতে শুনছি, এটা কী ভাবে সম্ভব হল? একটা নয়, কারণ একাধিক। প্রথমত, অত্যন্ত ভাল হোমওয়ার্ক। টিমটা যখন ইংল্যান্ডে খেলতে যাচ্ছে, কেউ ভাবেওনি কিছু করতে পারবে এরা। অনেককে বলতে শুনেছি, কুড়িটা উইকেট তোলার মতো বোলার নেই, টেস্ট কী জিতবে! আজ ইশান্ত শর্মা বার করে দিল, কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন টেস্টটা জিতিয়েছে কিন্তু চার-পাঁচ জন মিলে। ইশান্ত, ভুবি, বিজয়, রাহানে, জাডেজা এদের মধ্যে যে কোনও একজনকে বেছে নিলে খুব অভিযোগের কিছু থাকত কি? আর এই শর্ট বল থিওরির স্ট্র্যাটেজিটা আমার মনে হয় ধোনিরা নিয়েছে জনসনের থেকে। গত অ্যাসেজে শর্ট পিচড ডেলিভারির সামনে কুকের ইংল্যান্ডের কী অবস্থা হয়েছে, কেউ ভোলেনি। মিচেল জনসনের ওই ভয়াবহ গতির শর্টের সামনে পড়ে তো জোনাথন ট্রটের ক্রিকেট-কেরিয়ারটাই শেষ হয়ে গেল! অর্থাৎ, ধোনিরা জেনেই গিয়েছিল যে শর্ট বল নিয়ে ইংরেজদের অবচেতনে একটা ভয় থাকবে। ধোনি সেটাকেই কাজে লাগিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।

দেখুন, যে যত বড় ব্যাটসম্যানই হোক, যে দেশ থেকেই সে আসুক না কেন, শরীর তাক করে যদি ঘণ্টায় একশো চল্লিশ কিলোমিটার গতিতে বল করা হয়, সমস্যায় পড়বেই পড়বে। যার টেকনিক ভাল, সে সামলে দেবে। যার ভাল নয়, তার দুর্দশা বেরিয়ে পড়বে চোখের সামনে। এত দিন কী হত? উপমহাদেশে যে সব পিচে খেলে খেলে ক্রিকেটাররা বড় হত, সে সব পিচে বল কোমর পর্যন্ত আসত বড়জোড়। ঠিক সেই বলটাও বাইরে আসত বুক উচ্চতায়। ভারতীয়রা ড্রাইভ, কব্জিকে ব্যবহার করে শট, স্পিনারকে স্টেপ আউট করে ফেলে দেওয়া এ সব শটে এত দিন মন দিয়ে আসত। কিন্তু দিনের পর দিন বাইরে রগড়ানির পর আমাদের ক্রিকেট-প্যাটার্নটা পাল্টেছে অনেকটাই। বোর্ড থেকে বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রত্যেকটা রাজ্য ক্রিকেট সংস্থাকে অলিখিত নির্দেশ দেওয়া থাকে যে, পিচে চার মিলিমিটার ঘাস রাখতে হবে। রঞ্জি ট্রফিতে ক’টা ম্যাচ এখন পাটায় খেলা হয়? ইডেনেও তো বাংলা খেলে পুরোপুরি গ্রিন টপে। রঞ্জি ট্রফির সেরা পাঁচ বোলারের মধ্যে এখন দেখবেন, চারটে পেসার থাকে। এতে ভারত থেকে ভাল স্পিনার বেরোনো যেমন বন্ধ হয়েছে, তেমন ব্যাটসম্যানরা ছোট থেকে সবুজ পিচে খেলাটাও অভ্যেস করে ফেলতে পারছে। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকায় কিন্তু আর একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে বসছে না ভারতীয় ব্যাটিং। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও গত বছর কিন্তু আমরা টেস্ট জেতার খুব কাছাকাছি জায়গায় চলে এসেছিলাম।


২৮ বছর পরে ফের লর্ডস-জয় । ছবি: এএফপি

আর বাইরে হচ্ছে এখন পুরো উল্টো। মাঝেমধ্যেই ক্রিকেট সম্পর্কিত কাজকর্মের জন্য আমাকে ইংল্যান্ড যেতে হয়। কী ভাবে ওরা এখন ক্রিকেটার তৈরি করে সেটা দেখেওছি। আগে ওদের ক্রিকেটার তৈরির একটা নিয়ম থাকত যে, প্রথমেই তোমাকে কাট-পুল মারা শিখতে হবে। ব্যাকলিফটে তোমাকে ভাল হতেই হবে। ইংল্যান্ডে এটা হত, অস্ট্রেলিয়াতে হত। রিস্ট কপ বলে একটা ব্যাপার আছে যার উপর জোর দিতে বলা হত। মানে, শটের জন্য ব্যাট তোলার সময় কনুই যেমন তোমার ভাঙবে, তেমনই কব্জিটাও ভাঙবে। ব্যাটটা থাকবে বলের উপর। আসলে ওরা যে ধরনের পিচে খেলত, সেখানে কাট বা পুল ভাল না মারতে পারলে তুমি ক্রিকেটারই নও। এখন ওদের দেশে তো পিচের ধরনই পাল্টে গিয়েছে। পারথ আর আগের মতো নেই। নটিংহ্যামের সঙ্গে ভারতীয় পিচের কোনও তফাত পেয়েছেন? লর্ডস সবুজ থেকেও শেষে দেখা গেল বিশাল বিশাল টার্ন হচ্ছে। অর্থাৎ, বিদেশের পিচ আর আগের মতো নেই। তাই ওদের এখনকার যে সব প্লেয়ার উঠছে তারা কাট-পুলের জন্য তৈরি হয়ে আসছে না। মইন আলিকেই ধরা যাক। ইশান্তের একটা শর্ট বলে কোনও মতে মাথা বাঁচিয়ে অদ্ভুত একটা খোঁচা ফরোয়ার্ড শর্ট লেগকে দিয়ে গেল। মানে, শর্ট খেলার টেকনিক নেই। আবার ম্যাট প্রায়রকে দেখা যাক। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে যদি শর্ট করা হয়, তার মানে হচ্ছে অ্যাঙ্গেলের উল্টো দিকে পুল মারতে হবে। যেটা খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু যেহেতু ওদের একটা এত দিনের প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল যে, আমরাই সবচেয়ে ভাল পুল খেলতে পারি, তাই প্রায়রকে দেখলাম ফিল্ডার দেখেও অহেতুক পুল মারতে গেল। শুধু ও কেন, তিন জন ইংরেজ ব্যাটসম্যান ফিল্ডার দেখেও পুল মারতে গিয়েছে। যেটা গোঁয়ার্তুমি ছাড়া আর কিছু নয়। আর ইংল্যান্ডে আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। কার কোন দিকটা ভাল সেটা এখন চোদ্দো-পনেরো বছরেই ওরা নির্ধারণ করে ফেলে। ওরা এখন আর ভেবে দেখে না, যে ছেলেটা পনেরো বছরে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলছে, সে আঠারোয় গিয়ে ততটা ভাল না-ও থাকতে পারে। মাসুলও তো দিতে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে চূর্ণ হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ওদের হারিয়েছে। ভারত এখন ওদের মাঠে দাদাগিরি দেখাচ্ছে। ইংল্যান্ড এখন হারছে শর্ট বলের সামনে টেকনিকের অভাবে, প্রতিভার অভাবে, আর হারছে পুরনো গর্ব নিয়ে গোঁয়ার্তুমি দেখাতে গিয়ে। ২০১৪-তে দাঁড়িয়ে কেউ আর বলতে পারবে না যে, শর্ট বল শুধু ভারত-পাকিস্তান খেলতে পারে না। ওটা এখন আর সাহেবরাও খেলতে পারে না!২০১৪-তে দাঁড়িয়ে কেউ আর বলতে পারবে না যে, শর্ট বল শুধু ভারত-পাকিস্তান খেলতে পারে না। ওটা এখন আর সাহেবরাও খেলতে পারে না!

লর্ডসের স্কোরবোর্ড

ভারত প্রথম ইনিংস ২৯৫
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস ৩১৯
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস ৩৪২
ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ১০৫-৪)

রুট ক বিনি বো ইশান্ত ৬৬
আলি ক পূজারা বো ইশান্ত ৩৯
প্রায়র ক বিজয় বো ইশান্ত ১২
স্টোকস ক পূজারা বো ইশান্ত ০
ব্রড ক ধোনি বো ইশান্ত ৮
প্লাঙ্কেট ন.আ ৭
অ্যান্ডারসন রান আউট ২
অতিরিক্ত ৩২
মোট ২২৩
পতন: ১৭৩, ১৯৮, ২০১, ২০১, ২১৬, ২২৩।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ১৬-৭-২১-০, শামি ১১-৩-৩৩-১, ইশান্ত ২৩-৬-৭৪-৭, জাডেজা ৩২.২-৭-৫৩-১, বিজয় ৪-১-১১-০, ধবন ২-০-২-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

india england test match deep dasgupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE