রবিবার চেন্নাইয়ে। ছবি: পিটিআই।
ভারতীয় ক্রিকেটে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টিম চ্যাপেলে প্রত্যাবর্তনের কাহিনিকে বলা হয় ‘ফাদার অব অল কামব্যাক্স’।
ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনে জগমোহন ডালমিয়ার প্রত্যাবর্তনের কাহিনিকে এর পর কী বলা হবে? একই সঙ্গে ‘ফাদার এবং মাদার অব অল কামব্যাক্স’?
ন’বছর আগের জয়পুর যে অসম্মান, অপমান আর কাঁটার গ্লানিতে ধ্বস্ত করে দিয়েছিল ডালমিয়াকে, তা এক রকম উল্টো গাধার পিঠে চাপিয়ে মাথায় ঘোল ঢেলে দেওয়ার মতো। ২০০৫-এ কলকাতার বোর্ড বৈঠক থেকেই চিরপ্রতাপশালী ডালমিয়া ব্রাত্য হয়ে যান। কিন্তু তাঁর অসম্মান চরমে পৌঁছয় এক বছর বাদে জয়পুরে বোর্ডের বৈঠকে। বোর্ড ২৯-১ ভোটে তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। মুম্বইয়ের আদালত জামিন অযোগ্য পরোয়ানা জারি করে। জয়পুরের সেই বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিদের মনে হয়েছিল, ব্যাট-প্যাড ছাড়া চার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলার সামলাতে গেলে যা ভবিতব্য, সে দিন তা-ই হয়েছিল ডালমিয়ার। বৈঠকের পর জয়পুর থেকে বিমানের জন্য অপেক্ষা না করে গাড়িতে দিল্লিগামী হন ডালমিয়া। তাঁকে ওই রকম রক্তাক্ত মানসিক অবস্থায় দেখে সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন দিল্লি ক্রিকেট সংস্থার এক পদস্থ কর্মী। জয়পুর থেকে দিল্লি, তিনি স্বেচ্ছায় সহযাত্রী হয়ে যান। রোববার সন্ধ্যায় ডিডিসিএ-র সেই রবি জৈন নয়াদিল্লি থেকে ফোনে বলছিলেন, “এত বড় একটা লোক সে দিন গাড়িতে কথা বলতে পারছিল না। কী করে ওকে সান্ত্বনা দেব সারা রাস্তা ভেবে উঠতে পারিনি। খালি বলছিল, এত অপমান করল আমায়!”
জাম্পকাট ২০১৫, চেন্নাই।
গোটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহল যখন সোমবারের মারকাটারি ক্রিকেট বোর্ড নির্বাচনের দিকে বিস্ফারিত তাকিয়ে, তখন তিনি, জগমোহন ডালমিয়া চব্বিশ ঘণ্টা আগেই কাহিনি সমাপ্ত করে দিয়ে বসে রয়েছেন। যেখানে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন ও শরদ পওয়ার দুই মহারথীর ভাগ্যই দোদুল্যমান অবস্থায় থেকে গেল, সেখানে ডালমিয়া কি না বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রেসিডেন্ট পদে একমাত্র প্রার্থী! তাঁর আনুষ্ঠানিক নির্বাচন মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। প্রায় এক দশক বাদে ভারতীয় ক্রিকেটের মগডালে তাঁর এই বিহ্বল করা প্রত্যাবর্তন সম্ভব হল শ্রীনির পৃষ্ঠপোষকতায়। কিন্তু পরিস্থিতির এমনই চাপান-উতোর ছিল যে, তিনি অনায়াসে পওয়ারেরও প্রার্থী হতে পারতেন। গড়পড়তা টি-টোয়েন্টি ম্যাচের যা বৈশিষ্ট্য থাকে, তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন নিয়ে এ দিন ডালমিয়ার ক্ষেত্রে তা-ই দেখা গেল। একটা সহজ সমাধানে পৌঁছতে থাকা ম্যাচ আচমকা অন্য দিকে ঘুরে গিয়েছিল। ভারতীয় ক্রিকেটের অলিন্দে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে, ডালমিয়াকে সেই পেট্রন হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বিজেপি ও শ্রীনির বিশেষ আনুকূল্যে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন অনুরাগ ঠাকুর। তার পর দুই সিএবি কর্তা বিশ্বরূপ দে ও সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় পরিস্থিতি সামলান। ডালমিয়ার মসনদে বসার সামান্য অনিশ্চয়তা তৈরি হতে হতেও মেঘ কেটে যায়। তিন বছরের জন্য মনোনয়ন চূড়ান্ত করে ফেলেন ডালমিয়া।
এর আগে শ্রীনি চেয়েছিলেন নিজের পছন্দের এমন কাউকে মসনদে বসাবেন, যে ছ’আট মাস বাদে তিনি মামলামুক্ত হলেই পদত্যাগ করবে। অর্থাৎ ভরতের রাজত্ব। কিন্তু ডালমিয়া মোটেও ‘রামচন্দ্রের পাদুকা’ শ্রীনির রাজত্বভার বইবেন না। তিনি অন্য কোনও প্রশাসকের জন্য বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার বান্দাই নন। সুতরাং ডালমিয়াকে আনা মানে তিন বছরের জন্য শ্রীনি এবং পওয়ার দুজনেরই ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
এই অবস্থায় ডালমিয়াকে এক রকম সর্বসম্মত বেছে নেওয়া থেকে পরিষ্কার, ভাগ্য ও চাতুর্য, দু’টোই সমানে মেশাতে পেরেছেন সত্তরোর্ধ্ব শিল্পপতি। অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ড, পাকিস্তান থেকে মালয়েশিয়া, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহল রবিবার তাঁর প্রত্যাবর্তনের খবরে অতি বিস্মিত। কেউ কেউ বলছিলেন এটা রূপকথার কামব্যাক। একজন ক্রিকেটারের তবু রান করে, উইকেট নিয়ে দলে ফেরার সুযোগ থাকে। সত্তরোর্ধ্ব কোনও মানুষের, যাঁকে মনে হচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের মমি, বা অবসরে চলে যেতে বাধ্য হওয়া লালকৃষ্ণ আডবাণী তাঁর এ ভাবে ফেরা সম্ভব কেউ ভাবেনি। বরঞ্চ সাধারণ রটনা ছিল, তাঁর আগের ক্ষিপ্রতা নেই, শারীরিক ভাবেও বোর্ড চালানোর মতো শক্তসমর্থ নন। এ দিন মনোনয়নের পরেও সমালোচকরা কেউ কেউ বলছিলেন, যতই প্রেসিডেন্ট হোন না কেন, প্যানেলটা তো ডালমিয়ার নয়। তাঁকে বোর্ড চালাতে হবে শ্রীনি বা শশাঙ্ক মনোহরের মর্জি মেনেই।
এঁরা হয়তো ভারতীয় ক্রিকেটের সংবিধান খেয়াল করেননি। যেখানে সমস্ত ক্ষমতাই কার্যত প্রেসিডেন্টের হাতে। আর সেই ক্ষমতা স্বেচ্ছায় ডালমিয়া বিসর্জন দেবেন, মনে করার কোনও কারণ নেই। তা হলে ২০০৬-এর জয়পুর থেকে ২০১৫-র চেন্নাই, এতটা রাস্তা তিনি গাড়ি উজিয়ে আসতে পারতেন না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy