কিংবদন্তি: ভারতের আতঙ্ক ছিলেন এভার্টন উইকস। —ফাইল চিত্র।
শুক্রবার সকালে যখন টিভির সুইচ অন করলাম তখনই আতঙ্কটা মনের মধ্যে ফিরে এল। পুণের পর রাঁচীতেও কি ভারতীয় বোলাররা স্টিভ স্মিথকে আউট করতে পারবে না?
দিনের শেষে দেখলাম মনের মধ্যে ঢুঁ মারা সেই প্রশ্নটাই সত্যি হয়ে গেল। ভারত-অস্ট্রেলিয়া চলতি সিরিজে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক স্টিভ স্মিথকে যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ভারতের মাটিতে বহু ক্রিকেটারকেই দাপটে খেলতে দেখেছি। যার মধ্যে এভার্টন উইকস, কলিন কাউড্রি, স্যার গারফিল্ড সোবার্স, রোহন কানহাই থেকে জাহির আব্বাস, ক্লাইভ লয়েড হয়ে এই জমানার কেভিন পিটারসেন, মাইকেল ক্লার্ক দাগ কেটেছেন আমার মনে। কিন্তু এভার্টন উইকস এবং গ্যারি সোবার্সকে আমি একটু অন্য উচ্চতায় রাখি। এ বার স্টিভ স্মিথের ব্যাটিং দেখে আমার কিন্তু সেই এভার্টন উইকসের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
উইকসের কথা উঠলেই নস্ট্যালজিয়ায় ভুগি। সেটা ১৯৪৮ সাল। আমার বয়স তখন দশ। মোহনবাগান ক্লাব থেকে মেন্টর বলাইদাস চট্টোপাধ্যায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন গডার্ডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের খেলা দেখতে। তার আগে ক্যারিবিয়ানদের সেই বিখ্যাত থ্রি ডব্লিউ— ক্লাইড ওয়ালকট, এভার্টন উইকস এবং ফ্র্যাঙ্ক ওরেল সম্পর্কে প্রচুর গল্প শুনেছি। সে বার ওরেল আসেননি। তাই উইকস আর ওয়ালকটকে দেখতেই মাঠে গিয়েছিলাম। ইডেনে দু’ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেছিলেন উইকস। যা আজও অমর হয়ে রয়েছে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে, সেই ম্যাচেরই একটা অন্য ছবি। তা হল ভারতের বিনু মাঁকড়কে হাঁটু মুড়ে বসে উইকসের কভার ড্রাইভ। ম্যাচে একই ভাবে পর পর পাঁচটা চার মেরেছিলেন উইকস। তাঁর কব্জির মোচড়় ও ফুটওয়ার্ক আজও মনে পড়ে যায়।
বিদেশি ঘাতক
• স্টিভ স্মিথ (অস্ট্রেলিয়া): ভারতের বিরুদ্ধে টেস্টে ছ’নম্বর সেঞ্চুরি হল। ৯ টেস্টে রান ১২৮০। গড় ৯১.৪২। সর্বোচ্চ ১৯২।
• এভার্টন উইকস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ): ১০ টেস্টে সাতটা সেঞ্চুরি-সহ ১৪৯৫ রান করেছেন ভারতের বিরুদ্ধে। সর্বোচ্চ ২০৭।
• জাহির আব্বাস (পাকিস্তান): ১৯ টেস্টে ভারতের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ অপরাজিত ২৩৫। গড় ৮৭। সেঞ্চুরি করেছেন ৬টি।
• গ্যারি সোবার্স (ওয়েস্ট ইন্ডিজ): ১৮ টেস্টে আটটা সেঞ্চুরি আছে ভারতের বিরুদ্ধে। মোট রান করেছেন ১৯২০। গড় ৮৩.৪৭। সর্বোচ্চ রান ১৯৮।
ভারতের বিরুদ্ধে চলতি সফরে ব্যাট করার সময় স্টিভ স্মিথও সেই বিখ্যাত ফুটওয়ার্ককেই যেন মনে করাচ্ছে। কানহাই, লয়েড, মিঁয়াদাদ, ক্লার্কদের মতো সফলদের ছাপিয়ে উইকসের সঙ্গে স্টিভ স্মিথের তুলনাটা এ কারণেই। উইকসকে স্পিন খেলার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি যে স্পিন ভাঙার আগেই শট নিতেন। উইকস মূলতঃ ছিলেন ফ্রন্টফুটের ব্যাটসম্যান। অশ্বিনদের স্পিন খেলতে গিয়ে সেটাই আরও নিখুঁত ভাবে করতে দেখছি দেখছি স্মিথকে। স্মিথও উইকসের মতোই হয় স্পিন ভাঙার আগে শট খেলছে, না হলে ব্যাকফুটে গিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করছে বলের জন্য।
দু’জনের খেলার মধ্যে তফাত-ও আছে। ফ্রন্টফুট ভাল থাকায় উইকসের কভার ড্রাইভ ছিল ছবির মতো। ভারতের মাটিতে সফরকারী দলের এ রকম আগ্রাসী মনোভাবের ব্যাটসম্যান আমি দেখিনি বললেই চলে। তবে ওঁর ডিফেন্স অতটা ভাল ছিল না। তাই ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে অনেক সময় সমস্যায় পড়তেন উইকস।
স্টিভ স্মিথ আবার আগ্রাসনের বদলে জমাট রক্ষণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফ্রন্টফুট, ব্যাকফুট দু’টোতেই সমান দক্ষ। তাই উইকেটের সব দিকেই শট খেলছে স্মিথ। খেলার সময় স্মিথের ডান পা ভিতরের দিকে ঢুকে যায়। দেখলে মনে হবে বোল্ড বা এলবিডব্লিউ হতে পারে। কিন্তু স্ট্রোক নিতে গিয়ে স্কোয়ার কাট বা মিড উইকেট অ়ঞ্চলে বল পাঠিয়ে স্কোরবোর্ডকে ঠিক সচল রাখে। স্কোরিং শটের মধ্যে সুইপটাকেও ঢুকিয়ে নিয়েছে ভারতে এসে।
ভারতীয় ক্রিকেটকে প্রায় সাত দশক দেখার পর আমার উপলব্ধি, এ দেশে সফরকারী সফল ব্যাটসম্যানদের ত্রাস বলতে বেদি, প্রসন্ন, চন্দ্রশেখর-রাই ছিলেন। ওঁরা ভাল পিচে লুপ, ফ্লাইট দিয়ে ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করতেন। জাডেজা, অশ্বিনরা ম্যাচ জেতাচ্ছে। কিন্তু ওদের কেরামতি বেশির ভাগই টার্নিং ট্র্যাকে।
ভারতের মাটিতে ভারতের ত্রাস হিসেবে উইকস-কে যদি একশোয় পঁচাশি দিই, তা হলে স্মিথকেও পঁচাশি দেব। কারণ, উইকস-এর অস্ত্র ছিল ফ্রন্টফুট। স্মিথ ফ্রন্টফুটের সঙ্গে ব্যাকফুটেও সমান ঝলমলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy