Advertisement
০৯ মে ২০২৪

শাপভ্রষ্ট এক নায়কের মঞ্চে অপার্থিব বিরাট

বড় ফাইনাল নয়! নকআউট ম্যাচ নয়! নিছক এশিয়া কাপের রাউন্ড রবিন লিগের খেলা। গোটা টুর্নামেন্টের রূপরেখা নির্ণয়ে যার আদৌ হয়তো কোনও ভূমিকা থাকবে না। ভারত যতই পাঁচ উইকেটে জিতে ৬ মার্চের ফাইনালের দিকে আরও একটা বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ করুক! ওটা তো এক ম্যাচের নকআউট। তার আগে পদ্মা আর বুড়িগঙ্গা দিয়ে কোন কোহলি-স্রোত বয়ে গেছে, তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।

মারমুখী বিরাট। শনিবার ঢাকায় ভারত-পাক ম্যাচে। ছবি: এএফপি।

মারমুখী বিরাট। শনিবার ঢাকায় ভারত-পাক ম্যাচে। ছবি: এএফপি।

গৌতম ভট্টাচার্য
ঢাকা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৫
Share: Save:

বড় ফাইনাল নয়! নকআউট ম্যাচ নয়! নিছক এশিয়া কাপের রাউন্ড রবিন লিগের খেলা। গোটা টুর্নামেন্টের রূপরেখা নির্ণয়ে যার আদৌ হয়তো কোনও ভূমিকা থাকবে না।

ভারত যতই পাঁচ উইকেটে জিতে ৬ মার্চের ফাইনালের দিকে আরও একটা বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ করুক! ওটা তো এক ম্যাচের নকআউট। তার আগে পদ্মা আর বুড়িগঙ্গা দিয়ে কোন কোহলি-স্রোত বয়ে গেছে, তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।

এতগুলো ‘না’-এর পরেও শনিবার মীরপুর মাঠের অদ্ভুতুড়ে সারফেস এমন ইন্দো-পাক ম্যাচের জন্ম দিয়ে গেল, যা দু’দেশের ইতিহাসে খুব কম খেলা হয়েছে। পাকিস্তানের ইনিংস ৮৩ রানে শেষ হওয়ার সময় স্ট্যাটিস্টিশিয়ানদের সঙ্গে চেক-টেক না করেই বোঝা যাচ্ছিল, এটা ভারতের বিরুদ্ধে তাদের সর্বনিম্ন রান হতে বাধ্য। কিন্তু প্রত্যুত্তরে ভারত যখন মহম্মদ ‘আমেরশাহি’ রাজত্বে ৮-৩, টুইটারে একটা অদ্ভুত তথ্য দেখলাম।

ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদদের জগতে যিনি সিধুজ্যাঠা, সেই মোহনদাস মেনন জানাচ্ছেন, ভারতের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে এত কম রানে প্রথম তিন উইকেট কখনও যায়নি। আগের রেকর্ড ছিল ১৭-৩। এটা ৮-৩ শুধু নয়, ভয়ঙ্কর চাপে পড়ে কাতরাচ্ছে তাদের ব্যাটিং।

সুরেশ রায়না এমন বিস্ফোরক পিচে ব্যাট করার লোক ভিডিও গেমসেও হতে পারেন না। তবু বাঁ-হাতি বলে ধোনি তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। যাতে ডানহাতিদের বিরুদ্ধে আমেরের স্বাভাবিক সুবিধে পাওয়া বন্ধ হয়। কিন্তু যে পিচ অতীতের বার্বেডোজ বা পারথের মতো জীবন্ত, যেখানে কিপার স্টাম্পের এত পেছনে দাঁড়িয়ে যে, মোবাইলে শর্ট কভারের ছবি তুলতে গেলে জুম করেও পাবে না, সেখানে রায়নার উপর কোনও ক্রিকেট বিমা কোম্পানি টাকা ঢালবে না। প্রতি মুহূর্তেই তিনি ঠকঠকিয়ে, এই বুঝি শর্ট বল এল!

তাঁর বিদায়ে অন্য দিন হয়তো ধোনি নামতেন। কিন্তু আমেরের কোটা তখনও শেষ হয়নি। তাই যুবরাজ। যাঁর ক্যানসার থেকে বাইশ গজে ফেরা যতই অতিমানবীয় হোক, ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন বোলিং সামলানোর দিন যে চলে গিয়েছে সেটা তো মানতেই হবে। পরিষ্কার কথা, ভারত তখন চূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায়। আকস্মিক হারের দোড়গোড়ায় টোকেন নিচ্ছে। তাদের ম্যাচের সিংহাসন ছিনিয়ে নেওয়াটা যেমন রোমাঞ্চকর ভাবে ঘটেছিল, দেখা গেল রাজত্ব থেকে পতনও ঘটছে তেমনই বিহ্বলতার মেজাজে।

আশিস নেহরা আর জসপ্রীত বুমরাহকে ম্যাচ শুরুতে মনে হচ্ছিল অসামান্য। মহম্মদ আমের দেখালেন, এঁদের অসামান্য ভাবলে তাঁদের জন্য কোন শব্দগুচ্ছ রাখা হবে? আক্রমের আদলে তিনি নিজেকে গড়েছেন। আজ দেখে মনে হল আর আক্রম-আলখাল্লার প্রয়োজন নেই তাঁর। মীরপুরের আজকের রাত থেকে তিনি নিছক আমের। গড়াপেটার শাপভ্রষ্ট এক নায়ক, যে জীবনে ফেরার পাকদণ্ডী আজকের মীরপুরে চার ওভারে আবিষ্কার করে ফেলেছে!

ঐতিহাসিক ভাবে আরও একটা ভূখণ্ড জেতা নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়াছুড়ি চলত ভারত-পাক ক্রিকেটের মধ্যে। প্রথমে সেটা ছিল গাওস্কর-ইমরান। পরে হয় আক্রম বনাম সচিন। প্রাচীন ঢাকা শহর ইন্দো-পাকের আধুনিকতম দ্বন্দ্বযুদ্ধ তুলে ধরল। কোহলি বনাম আমের।

বিরাট কোহলির কথা আগে বলিনি। স্রেফ তাঁর জন্য দৃশ্যকল্পটা কী মারাত্মক কঠিন হয়ে তৈরি ছিল, সেটা বোঝানোর জন্য। শুনলাম, বাংলাদেশের কোচের মর্জিমতো নাকি এই সারফেস তৈরি করা। যাতে তাঁদের পেস বোলার-নির্ভর আক্রমণের সুবিধে হয়। টি-টোয়েন্টি মহাকাশে এমন পিচ অবিশ্বাস্য। গোটা ম্যাচে একটাও ছয় হল না। যা নাকি গোটা টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে এ নিয়ে মাত্র পাঁচ বার ঘটল। বল এত লাফিয়েছে, সিম করেছে এবং জোরে গিয়েছে যে, কে বলবে উপমহাদেশীয় পিচ? মনে হচ্ছিল, পুরনো আমলের বার্বেডোজ বা পারথ। কোহলির প্রতিভা ঠিক এই পরিবেশে নিজেকে আরও বাড়িয়ে নিয়ে গেল। কখনও কখনও মনে হচ্ছিল, যুবরাজের ক্রিজে থাকাটা ইলিউশন। বিভ্রম। পাড়া ক্রিকেটের মতো এক দিকেই খেলা হচ্ছে।

কোহলি বনাম পাকিস্তান। যারা জিতবে, ম্যাচ তাদের।

ভুল আম্পায়ারিং ভরা ম্যাচে আম্পায়ারের আরও একটা জঘন্য সিদ্ধান্ত তাঁকে ৪৯ রানে ফিরিয়ে দিল তো কী! আজকের হিরের ইনিংস তাঁর পাকিস্তানের সঙ্গে এই শহরে ম্যাচ জেতানো ১৮৩-র চেয়েও বেশি। আমেরের যেমন আক্রমের সঙ্গে তুলনার আর প্রয়োজন নেই। কোহলিরও প্রয়োজন নেই ভিভের সঙ্গে বারবার দাঁড়িপাল্লায় বসার। তিনি, কোহলি আধুনিক ক্রিকেটের নতুন সম্রাট। উনি, ভিভ পুরনো ক্রিকেটের অবিসংবাদী সম্রাট।

সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট যদি সামান্য কোনও নমুনাও হয়, শনিবার রাতের রোমাঞ্চকর জয় তুফান তুলে দিয়েছে গোটা দেশে। জেএনইউ বিতর্ক, কানহাইয়া কুমারের জামিন না পাওয়া বা স্মৃতি ইরানির তথাকথিত ‘আন্টি ন্যাশনাল’ বক্তৃতা অন্তত আজ রাতের জন্য বিস্মৃত। আর ক্রিকেট-রোম্যান্টিকের মনে হবে টি-টোয়েন্টি তো কী, ম্যাচের প্রচণ্ড দড়ি টানাটানির সময় ওয়াহাব রিয়াজের বলে কোহলির একটা কভার ড্রাইভ যে স্বস্তি দিল, তা অপার্থিব!

এটাও তো অপার্থিব, সীমান্তে বেয়নেটের আস্ফালনের বিরুদ্ধে ক্রিকেট ব্যাট যে পাল্টা স্টেনগানের স্বস্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারে!

পাকিস্তান: ৮৩ (১৭.৩ ওভার)

ভারত: ৮৫-৫ (১৫.৩ ওভার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE